সবই আছে স্মৃতির মণিকোঠায়, নেই শুধু চৌদ্দপুরুষের ঠিকানা। মেঘনার উত্তাল ঢেউ এখনো আছড়ে পড়ছে। ভোলার রাজাপুরের শেষ স্মৃতিটুকুও আজ নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে।
সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ৪০০ বছরের প্রাচীন জনপদ রামদাসপুর। এ বিচ্ছিন্ন জনপদে জন্ম নেওয়া আলোকিত সন্তানেরা দেশের বিভিন্ন দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ পদে কর্মরত আছেন। ভোলা সদরের মধ্যে শিক্ষায় অগ্রণী ছিল রামদাসপুর। কিন্তু রাক্ষুসী মেঘনার ভাঙনে চারপাশ এখন নদীতে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্য হারিয়ে এ দ্বীপের বাসিন্দারা আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। সরকারি কোনো পদক্ষেপ না থাকায় রক্ষা করা যায়নি রামদাসপুরের মতো এত ঐতিহ্যবাহী জনপদ। ভোলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে রাজাপুরের সাতটি ওয়ার্ড, যা একসময় ছিল দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়ি ও শস্য ভান্ডার।
হাজার হাজার পরিবার ভিটেহারা হয়ে অন্যত্র বসবাস করছেন। অনেকেই সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। অথচ বিগত কোনো সরকারই এ পুরোনো জনপদকে রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমানে যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা শুধু স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। এই স্মৃতির টানেই প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফিরে আসেন এ জনপদের সন্তানরা। গত বছর আয়োজন করা হয়েছিল এক মিলনমেলার, যেখানে ছোট-বড় সকলেই শৈশবের স্মৃতিচারণায় মেতে উঠেছিলেন। সেই স্মৃতি মাখানো রামদাসপুর আজও মেঘনার ভাঙনে বিলীনের পথে।
রবিবার (৩ আগস্ট) সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বিচ্ছিন্ন রামদাসপুরে প্রায় ৪ হাজার মানুষ বসবাস করেন। এখানে রয়েছে দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কয়েকটি মসজিদ। আকাশে মেঘ দেখলেই আতঙ্কে ভোগেন স্থানীয়রা। অল্প জোয়ারেই পানি উঠে যায় বাড়িঘরে, আর অতি জোয়ারে গোটা গ্রাম পানিতে থইথই করে। সম্প্রতি নিম্নচাপের কারণে অতি জোয়ারে রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। অনেকের বাড়ির চালা উড়ে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল মালেক মাঝি, নাছির উদ্দিন, সেরাজুল হক, তছির মাঝি, মালেকা বেগম, মমতাজ বেগম, নার্গিস আক্তার ও বিবি হাজেরা জানান—রাজাপুর একসময় সমৃদ্ধশালী ছিল। কিন্তু মেঘনার ভাঙনে এখন দিশেহারা এখানকার মানুষ। অনেকেই ভিটেমাটি হারিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছেন। একসময় যারা সম্মানিত পরিবার ছিল, আজ তারা নিঃস্ব। বর্তমানে যারা রয়েছেন, তারাও ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তারা রাজাপুরবাসীকে রক্ষায় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
রূপাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কবির হোসেন বলেন, “আমাদের স্কুলটি মেঘনায় বিলীনের পথে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এ বর্ষাতেই হারিয়ে যাবে স্কুলটি।”
স্থানীয় বিএনপি নেতা মিরাজ হোসেন বলেন, “রামদাসপুরের মানুষের দুর্ভোগ সীমাহীন। পানিতে রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।”
জেলা কৃষকদলের সাধারণ সম্পাদক ও রাজাপুর ইউনিয়নের কৃতি সন্তান আবুল হাসনাত তসলিম বলেন, “ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা দেওয়া হয়েছে। চাল বরাদ্দও এসেছে, তবে আমরা টিন চেয়েছি। নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধিদের নিয়ে কয়েকবার পরিদর্শন করানো হয়েছে। তারা আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু কাজ কিছুই হয়নি। আমরা রাস্তাঘাট সংস্কার ও স্থায়ীভাবে নদী ভাঙন রোধের দাবি জানাচ্ছি।”
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়া উদ্দিন আরিফ জানান, “রামদাসপুর রক্ষায় প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলেই দ্রুত কাজ শুরু হবে।”
এক সময় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যাতায়াতে অগ্রসর রামদাসপুরের মানুষ আজ যেন আদিম যুগে বসবাস করছেন। তারা সরকারের কাছে স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধ ও রাস্তাঘাট সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। এখন দেখার বিষয়—সরকার কি শুনবে এই জনপদের মানুষের দীর্ঘশ্বাস?
একুশে সংবাদ/ভো.প্র/এ.জে