চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার ওয়াপদাপাড়ার পাশে অবস্থিত একটি এলাকাকে স্থানীয়রা বলেন ‘বাদুড়তলা’। কারণ, এখানকার শতবর্ষী তেঁতুলগাছগুলোতে দীর্ঘ দুই শতাব্দী ধরে বসবাস করছে হাজার হাজার বাদুড়। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসংখ্য বাদুড়ের চিঁ-চিঁ শব্দে মুখর থাকে গোটা এলাকা। আর সন্ধ্যা হলেই তারা দল বেঁধে খাবারের সন্ধানে উড়াল দেয় দূর-দূরান্তে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২০০ বছর আগে ইবাদত আলী জোয়ার্দ্দার নামের এক ব্যক্তি পরিবারসহ এই এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর ছেলে ইউসুফ আলী জোয়ার্দ্দারের দুই মেয়ে সেলিমা খাতুন ও হাসিনা খাতুন পৈতৃক সম্পত্তির ওয়ারিশ হন। বর্তমানে সেলিমা খাতুন পরিবার নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় বসবাস করেন এবং এই বাদুড়তলার চারটি বিশাল তেঁতুলগাছ তাদের জমির মধ্যেই অবস্থিত।
সেলিমা খাতুনের বড় ছেলে খোকন জোয়ার্দ্দার বলেন, “১৯২৫ সালে এখানে সর্বশেষ ঈদের জামাত হয়েছিল। আমার নানা ও মা বলতেন, গাছগুলোতে বহু আগে থেকেই বাদুড়ের বসবাস। ১৯৬০ সালে এক তীব্র তাপদাহে বাদুড়গুলো মরতে শুরু করে। তখন আমার নানা ভারত থেকে পানি ছিটানোর মেশিন এনে প্রতিদিন গাছে পানি দিতেন—এতে অনেক বাদুড় প্রাণে বেঁচে যায়।”
তিনি আরও জানান, ১৯৯২ সালে তাঁর ছোট খালা কয়েকটি তেঁতুলগাছ কেটে ফেলেন, দুটি গাছ প্রাকৃতিকভাবে মারা যায়। বর্তমানে চারটি গাছে বাদুড়রা নিরাপদে বসবাস করছে। গাছগুলো দুই শতাব্দীর পুরনো এবং এগুলোতে প্রায় তিন হাজার বাদুড়ের আবাস রয়েছে।
সেলিমা খাতুনের ছেলে মধু জোয়ার্দ্দার জানান, তাঁর জমিতে থাকা তিন কাঠা জায়গা বাদুড়দের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। জমিটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় এক কোটি টাকা হলেও বাদুড়ের আবাস সংরক্ষণের স্বার্থে গাছগুলো না কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জমির মালিকের ভাই জাহিদ মিয়া বলেন, “এই প্রাণিগুলো আমাদের সন্তানের মতো। ওদের কোনো ক্ষতি হয়নি আমাদের দ্বারা, আমরাও ওদের বাঁচিয়ে রাখতে চাই। সন্তানদের বলে দিয়েছি, এই আবাস কখনো নষ্ট করা যাবে না।”
বাদুড়তলার নামে স্থানীয় বাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে “বাদুড় মার্কা” আটা, ময়দা, সুজি ও ভূসি। চুয়াডাঙ্গাসহ আশেপাশের জেলায় এই নামেই এসব পণ্য বিক্রি হয়।
বাদুড় দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে। শিশুরা বাবা-মায়ের সঙ্গে এসে চমৎকৃত হয় বাদুড়ের ঝাঁক দেখে।
রুহুল আমিন, ফতেপুর গ্রামের এক দর্শনার্থী জানান, “বাদুড়ের গল্প শুনেছি বহুবার। কিন্তু এত বাদুড় একসঙ্গে কখনও দেখিনি। এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য!”
চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তোহিদ হোসেন বলেন, “আমরা ছোটবেলা থেকে এই বাদুড়ের ডাক শুনে ঘুম ভাঙত। তারা এখনো টিকে আছে, এটাই আনন্দের। তবে বর্তমান পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তাদের লড়াই করতে হচ্ছে।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “বাদুড় একটি স্তন্যপায়ী প্রাণি। তারা ফল খেয়ে বেঁচে থাকে এবং পরাগায়নের মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশবিস্তারেও ভূমিকা রাখে। পরিবেশ রক্ষায় বাদুড়ের অবদান অনেক।”
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, “বাদুড় ফল খেয়ে বেঁচে থাকে, এবং তারা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরাগায়নের মাধ্যমে অনেক বিরল উদ্ভিদের বংশবিস্তার ঘটায়। মধু জোয়ার্দ্দার বাদুড় সংরক্ষণের দারুণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।”
চুয়াডাঙ্গার বাদুড়তলা এখন শুধু একটি স্থান নয়—এটি একটি প্রাকৃতিক ঐতিহ্য। দুইশো বছরের পুরনো বাদুড়দের এই আবাস আমাদের বলে দেয়, মানুষের চেষ্টায় প্রকৃতি বেঁচে থাকতে পারে। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতা আর দায়িত্ববোধ।
একুশে সংবাদ/চু.প্র/এ.জে