গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে নিখোঁজ হয় মাদরাসা ছাত্র মো. রিফাত হোসেন। সেদিনই জানা যায়, আশুলিয়া থানার সামনে একটি গাড়িতে পুড়ে গেছে কিছু মরদেহ। এর মধ্যে একটিকে নিজেদের ছেলে বলে চিহ্নিত করে রিফাতের বাবা-মা। সেই মরদেহ গ্রামের বাড়ি নিয়ে দাফন করে তারা। কিন্তু এর কয়েক দিন পর ফেসবুকে দেখতে পান তাদের ছেলে মাথায় বুলেট নিয়ে হাসপাতালে পাঞ্জা লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে।
এরপর অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করা হয় সেই বুলেট। হারিয়ে ফেলা ছেলেকে ফিরে পান বাবা-মা। তবে রিফাত হারিয়ে ফেলেছে তার পুরনো বেশিরভাগ স্মৃতি। তার চিকিৎসা ব্যয় ও নানাবিধ খরচের চাপে অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবারটি।
রিফাত আশুলিয়ার দারুল ইসলাম ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আশুলিয়ার পলাশবাড়ী এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকে সে। সম্প্রতি রিফাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিন কক্ষের ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস রিফাতের। ঘরের ভেতরে চৌকিতে শুয়ে এটাসেটা প্রশ্ন করছে পাশে বসা বাবা-মাকে। কখনও কখনও হাসছে, কখনও কখনও কাঁদছে। চেষ্টা করছে কিছু পড়তে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। পাশে বসে থাকা বন্ধুদের নামও মনে নেই তার। ছলছল চোখে ছেলের পাশে বসে থাকা বাবা-মা জানালেন রিফাতকে খুঁজে পাওয়ার গল্প।
পরিবার জানায়, গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় যায় রিফাত। এরমধ্যে বাবা-মায়ের সঙ্গে কয়েকবার ফোনেও কথা হয়। কিন্তু বিকেলেন দিকে হঠাৎ নিখোঁজ হয় রিফাত। তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। আশপাশের কয়েকটি হাসপাতালেও রিফাতের খোঁজ নেন বাবা-মাসহ স্থানীয় আরও অনেকেই। তবে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরদিন তারা জানতে পারেন, বাইপাইলে একটি গাড়িতে কয়েকটি মরদেহ রয়েছে। সেখানে গিয়ে একটি মরদেহের দাঁত ও পোশাক থেকে বাবা-মায়ের মনে হয় এটিই তাদের ছেলে রিফাত। সেই মরদেহ নিয়ে বগুড়ার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। লাশ দাফনের পর মিলাদ পড়িয়ে বাবা-মা ফিরে আসেন আশুলিয়ায়। এরপরই ফেসবুকে দেখতে পান, রিফাত বেঁচে আছে। হাসপাতালে ভর্তি।
নিখোঁজের পর মরদেহ পেয়ে শান্তনা পাওয়া বাবা-মা ছেলে জীবিত আছে শুনে আত্মহারা হয়ে পড়েন। তবে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ছেলে পুরনো স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে জেনে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।
রিফাতের মা পোশাক শ্রমিক পারুল বেগম বলেন, ‘ছেলের মুখে আবার মা ডাক শুনছি। ছেলেকে পাইলাম; কিন্তু ভালোমতন তো পাইলাম না।’
রিফাতের বাবা রাজমিস্ত্রী লুৎফর প্রামানিক বলেন, ছেলেকে হারিয়ে সব হারিয়ে ফেলেছিলাম। লাশ পেয়ে ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু জীবিত ছেলেকে ফিরে পেয়ে সব ফিরে পেয়েছি। কিন্তু তার কিছুই মনে নেই।
ছেলেকে ফিরে পেলেও শঙ্কায় দিন কাটছে রিফাতের পরিবারের। কাজকর্ম ছেড়ে ছেলের সেবাশুশ্রূষায় দিন কাটছে তাদের।
রিফাতের মা-বাবা জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এরপর মাথার গুলি অপসারণ করতে নেওয়া হয় ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে। দুই হাসপাতালে কোনো খরচ লাগেনি। তবে রিফাতের জন্য ওষুধ, পুষ্টিকর খাবার, তাদের ১১ বছর বয়সী এক মেয়েকে মাদ্রাসায় পড়ানো, বাড়িভাড়াসহ বিভিন্ন খাতে এখন অনেক খরচ হচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের তরুণেরা আর্থিক সহায়তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে তারা সরকারের কাছ থেকে সহায়তা চান।
রিফাতের বাবা লুৎফর প্রামাণিক বলেন, ‘আমার ছেলে তো এখন প্রতিবন্ধী হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইছিল। পড়তে পারব কি না জানি না। ভবিষ্যতে কোনো কাজ করতে পারব কি না, তা-ও জানি না। তাই সরকারের কাছে একটু সহযোগিতা চাই।’
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :