একাত্তুরের এই দিনে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে পাক হানাদার বাহিনিরা এক নৃশংস গণহত্যা চালায়। শহীদ হন ১ শ’ ৮৭ জন নিরীহ গ্রামবাসি। ধর্ষিতা হন ১৪ নারী। একটি পাড়ার সমস্ত পুরুষ মানুষকে মেরে ফেলা হয় বলে স্বাধীনতা অর্জনের পর পুরো গ্রামের নাম পাল্টে হয়ে যায় সোহাগপুর বিধবা পল্লী। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়েও ৫২ বছর আগের সেদিনের পাক সেনাদের বর্বরতার কথা ভুলতে পারেননি। সেই দু:সহ স্মৃতির কথা মনে হলে আজও শিউরে উঠেন তারা।
সোহাগপুর বেণুপাড়া গ্রামের জোবেদা। একাত্তুরে দুই মেয়ে এক ছেলের জননী। স্বামী ফজর আলী। জোবেদা জানান, ভোরের আলো ফোটার পর স্বামী ফজর আলী রোপা আমন ধান লাগাতে জমিতে যান।
কিছুক্ষণ পর প্রচন্ড গুলির শব্দে মাঠ থেকে দৌড়ে বাড়িতে ছুটে আসে স্বামী ফজর আলী, চাচা খেজর আলী, সিরাজ আলী, জেঠাত ভাই আয়ুব আলী মুন্সি, ফুফা সাহেব আলী , প্রতিবেশী হযরত আলী, জসিম উদ্দিন, রহিম উদ্দিন, আবুল হোসেন সহ নয়জন। তারা বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বন্দুক তাক করে তাদের ধরে ফেলে পাক সেনারা। সবাইকে লাইন করে দাঁড়া করিয়ে গুলি করে।
পুরো উঠোন ভেসে যায় রক্তে। গুলির প্রচন্ড শব্দে মারা যায় তার কোলের ছেলে সন্তানটিও। হায়েনার দল চলে গেলে জোবেদা চৌকির নিচ থেকে বেড়িয়ে উঠোনে পা রাখতেই তার পা রক্তে ডুবে যায়। তার বুক ফাটা আর্তনাদে ভাড়ি হয়ে উঠে আকাশ।
একই পাড়ার হাফিজা। বিয়ের দু’মাস না পেরোতেই চোখের সামনে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন স্বামী ইব্রাহীমকে। হয়েছেন নির্যাতিত। হত্যাযজ্ঞের পর চলে যান নকলা উপজেলার খারজান এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। স্বাধীনতা অর্জনের পর গ্রামে আসেন। কিন্তু ঠাঁই মেলেনা কোথাও। পরে দ্বিতীয় বিয়ে
করে আবার সংসার জীবন শুরু করেন।
বরুয়াজানী গ্রামের সিরাজ আলী চাচা আব্দুল লতিফ সহ সাতজনকে হত্যা করার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি জানান, সেসময় তার বয়স ছিল ১১ বছর। চাচার সঙ্গে গিয়েছিলেন রোপা আমন ধানের জমিতে। তিনি ক্ষেতের আইলে বসে ছিলেন। এমন সময় পাক সেনারা সোহাগপুর গ্রামের সাধুর আশ্রম থেকে প্রফুল্লের
দিঘী পর্যন্ত এলাকা ব্যারিকেড দেয়। গুলির শব্দে সবাই দৌড়ে পালাতে চাইলে চাচা আব্দুল লতিফ সবাইকে দৌড়াতে বারণ করেন।
বলেন, দৌড়ালে বরং ওরা গুলি করবে। চাচার কথা শুনে সবাই আমনের চারা রোপণ করতে থাকে। এমন সময় রক্তখেকো হায়েনার দল সিরাজ আলী সহ সবাইকে লাইনে দাঁড় করায়। এর মধ্যে পাক সেনাদের
একজন আমাকে শিশু বিবেচনায় লাইন থেকে সরিয়ে দিয়ে বাকিদের ব্রাশ ফায়ার করে। রক্তে লাল হয়ে যায় রোপা আমনের সবুজ ধানের চারা।
সোহাগপুর বেণুপাড়া গ্রামের আলাল উদ্দিন জানান, সকাল সাতটা থেকে দুপুর গড়িয়ে গেলেও যখন হত্যাযজ্ঞ থামছেনা দেখে মসজিদের ইমাম ইমান আলী মুন্সি সাহসে ভর করে পাক সেনাদের কাছে হত্যা যজ্ঞ বন্ধের অনুরোধ জানাতে মসজিদ থেকে বেরিয়ে সামনে এগুতে থাকেন। তাদের কাছাকাছি যেতেই এক রাজাকার তাকে লক্ষ করে গুলি করে। সে গুলি তার বক্ষভেদ করে এক পাক সেনার পায়েগিয়ে লাগে। পাক সেনারা সঙ্গে সঙ্গে রাজাকারটিকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে আহত সেনাকে নিয়ে চলে
যায়।
তিনি জানান, চারিদিকে তখন সুনসান নীরবতা। দিনের বেলায় যেন রাতের অন্ধকার। সূর্য তখন হেলে পড়েছে পশ্চিমে।
একজন, দু’জন করে গ্রামবাসী এগিয়ে আসে স্বজনদের খোঁজে। যেদিকেই তাকানো যায় শুধু লাশ আর লাশ। কান্না করারও সময় নেই। যে ভাবে পারে , কলাপাতা, শাড়ী, মশারি পেঁচিয়ে লাশ গুলো কোনমতে মাটি চাপা দিয়ে আবার গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।
আর এটুকুও যে লাশের ভাগ্যে জুটেনি, তারা হয় কুকুর , শেয়াল শকুনের খাবার। কান্নাজড়িত কন্ঠে বিধবারা জানান, এক জীবনে মানুষের কত কষ্ট থাকে তার উদাহারণ আমরা। ভিক্ষা করে, রাস্তায মাটি কেটে, অন্যের
বাড়িতে কাজ করে খেয়ে না খেয়ে আমাদের সন্তানদের বড় করেছি। তারাও বড় হয়ে বিয়ে সাদি করে আলাদা হয়ে যায়। যখন আমাদের আর দেখার কেউ ছিল না, তখন আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ধীরে
ধীরে আমাদের পুনর্বাসন করে। আমাদের স্বীকৃতি দেয়। আমাদের বেঁচে থাকা ২৯ জন বিধবাদের সেমি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেয়। মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে দেয় জেলা প্রশাসন একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করে দিয়ে। সেনাবাহিনী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় করে দেয়, গণহত্যার কবর গুলো চিহ্নিত করে দেয়। জেলা
প্রশাসন সে কবর গুলো পাকা করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দেয়।
তারা বলেন, জীবন সায়াহ্নে এসে আমরা দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে আছি। এতেই আমরা খুশি। আমরা প্রাণ ভরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও এলাকার সংসদ সদস্য , সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া
চৌধূরীর জন্য দোয়া করি।
দিবসটি উপলক্ষে সোহাগপুর বিধবা পল্লি সৃতিসৌদে পুস্কস্তবক অর্পন, আলোচনাসভা বিধবাদের সংবর্ধনা ও উপহার সামগ্রী বিতরন করা হবে বলে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তা খৃস্টফার হিমেল রিছিল জানান।
একুশে সংবাদ/স ক