সড়কে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে লাখো কর্মঘণ্টা, বাড়ছে মানসিক চাপ ও পরিবেশদূষণ—সমাধান কি এখনো অধরা ?
ঢাকা শহরের যানজট এখন নিছক অসুবিধা নয়, এটি রীতিমতো একটি সামাজিক সংকট। প্রতিদিন অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থী, রোগী, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ যেভাবে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকেন, তা শুধু মানসিক চাপ ও বিরক্তির কারণ নয়—এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং সামগ্রিকভাবে জীবনের মানহানি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, যানজটে রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এছাড়া যানবাহনের ধীরগতির কারণে জ্বালানির অপচয়, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের মাত্রাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
যানজটের মূল কারণসমূহ
ঢাকার যানজটের পেছনে একাধিক কারণ কাজ করে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সড়ক অবকাঠামো নগরীর জনসংখ্যা ও যানবাহনের তুলনায় অনেকটাই অপর্যাপ্ত। অনেক এলাকায় রাস্তা সংকীর্ণ, যেখানে বড় বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, বাইক সব একসঙ্গে চলে। রাস্তার পাশে দোকান, পার্কিং, হকার ও অবৈধ দখল সড়ক সংকোচন করে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমন্বিত গণপরিবহনের অভাব। ঢাকা শহরে যাত্রী পরিবহনের জন্য সরকারি বা নির্ভরযোগ্য কোনো বাস সার্ভিস নেই বললেই চলে। ফলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। প্রতিটি পরিবার একাধিক গাড়ি ব্যবহার করছে, যা যানবাহনের ঘনত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি, গণপরিবহনের বিশৃঙ্খল ও অনিরাপদ পরিবেশও মানুষকে ব্যক্তিগত যান ব্যবহারে বাধ্য করছে।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও এই সমস্যার একটি বড় কারণ। ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আবার অদক্ষতা, দুর্নীতি ও নিয়ম ভাঙার সংস্কৃতিও রাস্তায় বিশৃঙ্খলা বাড়ায়।
সম্ভাব্য সমাধানসমূহ
১. সমন্বিত গণপরিবহন চালু করা:
ঢাকা শহরে সময়ানুগ, পরিচ্ছন্ন ও একীভূত গণপরিবহন চালু হলে ব্যক্তি গাড়ির উপর নির্ভরতা কমবে। এক টিকেটে বিভিন্ন রুটে যাতায়াতের সুবিধা থাকলে মানুষ বাস ব্যবহারে আগ্রহী হবে।
২. মেট্রোরেল ও বিআরটি প্রকল্প সম্প্রসারণ:
বর্তমানে মেট্রোরেল আংশিক চালু হয়েছে। এটিকে দ্রুত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিস্তৃত করতে হবে। একইভাবে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (BRT) প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে, যাতে দীর্ঘ রাস্তায় নির্ধারিত সময়ে গণপরিবহন চলাচল করতে পারে।
৩. অফিস ও স্কুলের সময় বিভাজন:
সকল অফিস সকাল ৯টা, সকল স্কুল সকাল ৮টায় শুরু হলে একসঙ্গে সড়কে ভিড় জমে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অফিস, ব্যাংক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময় বিভাজন করে ট্রাফিক চাপ ছড়িয়ে দিলে যানজট কমবে।
৪. স্কুলবাস ব্যবস্থার বাধ্যবাধকতা:
প্রতিটি শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াত করলে তা যানজটে ভয়াবহ চাপ তৈরি করে। প্রাইভেট ও সরকারি স্কুলগুলোতে স্কুলবাস বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে একই গাড়িতে অনেক শিশু যাতায়াত করবে, এবং রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমবে।
৫. ডিজিটাল ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ:
ট্রাফিক সিগন্যাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা, রাস্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা, লাইভ ট্রাফিক আপডেট অ্যাপ চালু করে যান চলাচল আরও নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব। ট্রাফিক পুলিশের কাজও প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে।
৬. রাস্তার পাশে অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও ফুটপাত মুক্ত রাখা:
অবৈধ দোকান, হকার, অবৈধ পার্কিং—সবই রাস্তার স্বাভাবিক গতিপথ আটকে দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে এসব উচ্ছেদ করে নিয়মিত তদারকি করতে হবে।
৭. সাইকেল ও বাইকের জন্য আলাদা লেন:
ছোট দূরত্বে যাতায়াতের জন্য বাইক বা সাইকেল উপযোগী। তবে তাদের জন্য আলাদা লেন না থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে এবং ট্রাফিকে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। বাইক/সাইকেল লেন নির্ধারণ করে ছোট যাত্রা সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব।
৮. জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি:
নাগরিকরা যদি আইন না মানে, তাহলে সরকার যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক না কেন, যানজট কমবে না। সিগন্যাল মানা, রাস্তায় নিয়ম মানা, ফুটপাত ব্যবহার, জেব্রাক্রসিং ব্যবহার—এগুলো ছোট ছোট কাজ, কিন্তু যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের যৌথ দায়িত্ব
যানজট কেবল অবকাঠামোগত নয়, এটি একটি প্রশাসনিক ও সামাজিক সমস্যা। যেমন, একজন নাগরিক অফিসে সময়মতো পৌঁছাতে পারছে না—তা তার কর্মদক্ষতাকে প্রভাবিত করছে। শিক্ষার্থী দেরিতে স্কুলে যাচ্ছে—তার শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। একজন রোগী অ্যাম্বুলেন্সে আটকা পড়ছে—তা জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। তাই যানজট এখন জাতীয় সমস্যা।
সরকার, সিটি কর্পোরেশন, বিআরটি, রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (BRTA), পুলিশ—সবার মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায় থেকেও সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
উপসংহার
ঢাকার যানজট আমাদের সময়, অর্থ ও জীবনের গুণগত মান কেড়ে নিচ্ছে। তবে এটি নিরসনের উপায় নেই—এ কথা সত্য নয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বাস্তবমুখী উদ্যোগ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জনসম্পৃক্ততা—এই চারটি স্তম্ভকে ঘিরেই সমাধানের পথ গড়া সম্ভব। সরকার ও নাগরিক, উভয়ের আন্তরিকতা থাকলে যানজটমুক্ত একটি কর্মক্ষম, বাসযোগ্য ঢাকা সম্ভব।
একুশে সংবাদ/এ.জে