আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিবে—এ কথা আমাদের সবারই জানা। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ পাঠে অমনোযোগী হয়ে পড়ছে, যা দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি বড় সংকেত।
প্রথমত, শিখন ঘাটতি ও শ্রেণি অনুপযোগিতা অমনোযোগিতার একটি প্রধান কারণ। অনেক শিক্ষার্থী পূর্ব শ্রেণির মৌলিক পাঠ ঠিকভাবে আয়ত্ত না করেই পরবর্তী শ্রেণিতে উঠছে। ফলে নতুন পাঠ্যবস্তু তাদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেণিকক্ষ সংকট, অধিক শিক্ষার্থী, অপর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা এবং মানসম্মত শিক্ষা উপকরণের অভাব।
দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি আজ যেমন আশীর্বাদ, তেমনি নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে অভিশাপেও রূপ নিচ্ছে। মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তি, ভিডিও গেম, ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়া শিক্ষার্থীদের মনোযোগ হরণ করছে। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা ক্লাসেও ডিভাইস ব্যবহার করছে, যা একে একে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে।
তৃতীয়ত, শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রশাসনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা অমনোযোগিতাকে আরও ত্বরান্বিত করছে। অনেক শিক্ষক ক্লাসে যথাযথভাবে পাঠদান না করে গাইড বইয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। অভিভাবকেরা সন্তানদের তদারকিতে উদাসীন, বরং কোচিং বা প্রাইভেটেই আস্থা রাখছেন বেশি। শিক্ষা প্রশাসনও অনেক সময় নীতিগতভাবে শৈথিল্য প্রদর্শন করে, যা শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
চতুর্থত, নৈতিকতা ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকট আজকের শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রকট। লক্ষ্যহীনতা, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, বন্ধুদের নেতিবাচক প্রভাব, অপসংস্কৃতি ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব তাদের মূল্যবোধকে দুর্বল করে ফেলেছে। প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং ও মানসিক সহায়তার অভাব তাদের আরো বিপথগামী করছে।
এছাড়াও পাঠ্যবইয়ের গুণগত দুর্বলতা, ঘন ঘন শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, স্ট্যাডি গ্রুপের অভাব, অতিরিক্ত আদর কিংবা চাপ, খেলার মাঠ ও শারীরিক চর্চার অভাব, খাওয়া-ঘুমের অনিয়ম ইত্যাদিও শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
করণীয়
১. শিখন ঘাটতি পূরণের জন্য রেমেডিয়াল ক্লাস ও ধাপে ধাপে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করতে হবে।
২. শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়ন, ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
৩. শিক্ষকদের দায়িত্বশীলতা ও অভিভাবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. মৌলিক নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার চর্চা, স্টুডেন্ট কাউন্সেলিং এবং লক্ষ্যনির্ধারণমূলক গাইডেন্সের ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
৫. কোচিং নির্ভরতা কমিয়ে বিদ্যালয়ভিত্তিক পাঠদানকে কার্যকর ও আকর্ষণীয় করতে হবে।
৬. শিক্ষাক্রম পরিবর্তনকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ভিত্তিতে এবং শিক্ষার্থীবান্ধবভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত।
উপসংহার: শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি আমাদের সমাজ, পরিবার, শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় নীতির সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিফলন। এই সংকটের সমাধানে কেবল শিক্ষক নয়, অভিভাবক, প্রশাসন, সমাজ এবং রাষ্ট্র—সবারই দায়িত্বশীল ও সমন্বিত ভূমিকা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, আজকে যারা ক্লাসে মনোযোগী নয়, আগামীকাল তারা দেশের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত থাকবে না।
মোঃ এস্কেন্দার আলী
সহকারী শিক্ষক (আইসিটি)
সতীহাট কে. টি. উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, মান্দা, নওগাঁ।
একুশে সংবাদ/এ.জে



একুশে সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

