মাওনা-কালিয়াকৈর সড়কটির দৈরত্ব ৩২ কিলোমিটার। স্বল্প দৈর্ঘ্যের এই সড়ক শ্রীপুরের শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত মাওনা চৌরাস্তা এবং কালিয়াকৈর যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ। শাল-গজারি বনের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সড়কটি প্রখর রৌদ্রে চালক ও যাত্রীদেরকে শীতল বাতাসে মুগ্ধ করে। কালিয়াকৈর বা মাওনা থেকে স্বল্প সময়ে আসা-যাওয়া করা যায়, বিধায় অনেক যাত্রী যানজটমুক্ত এই সড়ক ব্যবহার করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য অনেক পর্যটকও এই সড়ক ব্যবহার করেন।
সড়কটির বাঁকে বাঁকে ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। প্রতিটি বাঁক যেন এক একটি মৃত্যুফাঁদ। এই সড়কের ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক এতটাই বিপজ্জনক যে, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে সড়ক দুর্ঘটনার খবর আসে। সম্প্রতি দুর্ঘটনার কারণে সড়কটি হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক।
শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং মাওনা চৌরাস্তার প্রাইভেট হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভর্তি ও মৃত্যু বিবরণী অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে এসব বাঁকে অর্ধ শতাধিক দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক। আহতদের মধ্যে অনেকে পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অথচ এসব দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
চালক, যাত্রী ও এলাকাবাসী বলছেন, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাঁকে দুর্ঘটনা ঘটে। ৩২ কিলোমিটার সড়কের ২০টি ভয়ঙ্কর বাঁকে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। গত আট মাসে দুর্ঘটনায় ১১ জন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক। তবু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
শনিবার (২ আগস্ট) বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সড়কের কালিয়াকৈর উপজেলার চাপার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাড়ি মোড়ে ট্রাক, অটোরিকশা ও মাইক্রোবাসের ত্রিমুখী সংঘর্ষে অটোরিকশার তিন যাত্রী গুরুতর আহত হয়েছেন।
শুক্রবার (১৫ আগস্ট) ভোরে সড়কের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের ৯২ নামক স্থানে দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী গৌরাঙ্গ চন্দ্র মন্ডল (৪৮) নিহত হন। তিনি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার স্বল্প নন্দনপুন (বরুন্দী) গ্রামের তুষ্ট চরন মন্ডলের ছেলে।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) মাওনা-কালিয়াকৈর সড়কের পাইকপাড়া স্ট্যান্ড এলাকায় দ্রæত গতির ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে পড়লে চালক ও হেলপার গুরুতর আহত হন।
রবিবার (২৪ আগস্ট) ওই সড়কের চেয়ারম্যানবাড়ী মোড় এলাকায় মাছ বহনকারী পিকআপ সড়কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশের গাছে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে।
চলতি বছরের ১৪ জুন (সোমবার) বদনীভাঙ্গা (মনসুরাবাদ) এলাকায় চলন্ত গাড়ির ধাক্কায় সড়কে ছিটকে পড়েন শিমলাপাড়া গ্রামের আহাম্মদ আলীর ছেলে মুরগির ব্যবসায়ী মোটরসাইকেল চালক হারুনুর রশিদ (৩৫) এবং আরোহী জাকির হোসেন (৩৮) নিহত হন।
শুক্রবার (১৮ জুলাই) দুপুরে বড়চালা এলাকায় কাভার্ডভ্যান ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের তিনজনসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন বগুড়ার ধুনট উপজেলার ঈশ্বরঘাট গ্রামের জাহিদুল ইসলাম, তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার, ছেলে আবু হুরায়রা, যাত্রী শফিকুল ইসলাম ও অটোরিকশা চালক মেহেদী। জাহিদুল ইসলাম পরিবার নিয়ে শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পূর্বখণ্ড গ্রামে ভাড়া থেকে নোমানশিল্প গ্রুপের নোমান হোম টেক্সটাইল কারখানায় চাকরি করতেন।
শনিবার (১৯ জুলাই) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ওই সড়কের চাপার সেতুর দক্ষিণ পাশে সড়ক পার হওয়ার সময় সিমেন্ট মিক্সার গাড়ীর চাপায় উপজেলার শিমুলতলী গ্রামের রাদের ছেলে ঔষধ ব্যবসায়ী রোদ্র পাল (২৫) নিহত হন। শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সড়কের কাওরান বাজার এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় রাশেদ ও আবু বক্কর ছিদ্দিক নামে দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, মাওনা-কালিয়াকৈর সড়কে ২০টি ভয়ঙ্কর বাঁক রয়েছে। এসব বাঁকে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ বাঁকে কোনো কার্যকর সংকেত চিহ্ন নেই। যেটুকু সাংকেতিক চিহ্ন রয়েছে, তাও অস্পষ্ট এবং দূর থেকে দেখা যায় না।
সিএনজি চালক জব্বার মিয়া বলেন, সড়কে গাড়ি ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলে। ইচ্ছা করলেই হঠাৎ করে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বাঁকগুলো এত ভয়ঙ্কর যে এক পাশ থেকে অন্য পাশ দেখা যায় না। বাঁকগুলোতে যে নির্দেশক দেওয়া আছে, তা অস্পষ্ট এবং দূর থেকে দেখা যায় না। বিশেষ করে রাতের বেলায় সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
আরেক চালক কবির হোসেন বলেন, মূলত এ ধরনের বড় বাঁকে গ্লাসের (কনভেক্স মিরর) নির্দেশক স্থাপন করা উচিত, যাতে চালকরা দূর থেকে আসন্ন বাঁকের বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহন দেখতে পারেন এবং দুর্ঘটনা এড়াতে পারেন। সংকেত বাতি স্থাপন করা হলে সমস্যা হবে না।
সড়কটির মাওনা থেকে ফুলবাড়ীয়া পর্যন্ত ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে সওজের গাজীপুর কার্যালয়। কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহেল মিয়া বলেন, সড়কের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে সংকেত বাতি স্থাপন করতে না পারলেও ডানে মোড়, বামে মোড় লিখে সিগন্যাল দেওয়ার দ্রত ব্যবস্থা করব। সড়কে স্পীড ব্রেকার (গতি রোধক) দেওয়ার নিয়ম নেই আমাদের। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সড়কটির ১৩ কিলোমিটারের ওই অংশের বাঁকগুলোর ঝুঁকি বিবেচনায় দুর্ঘটনা রোধে র্যাম্বেল স্ট্রীপ (ঘন ছোট গতিরোধক) দেওয়া হবে, যাতে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, যেসব এলাকার সড়ক নির্দেশক মুছে গেছে, সেগুলো দ্রæত পুনর্নির্মাণ করা হবে।
একুশে সংবাদ/গা.প্র/এ.জে