"এক কলসি পানি এনে দেই, তারা আমাকে পাঁচ টাকা দেয়। আমখোলা থেকে গলাচিপা শহরের দোকানগুলোতে যাদের পানি লাগে, তাদের কাছে এক কলসি পানি পৌঁছে দিলে পাঁচ টাকা দেয়। এতে আমি প্রতিদিন প্রায় একশ থেকে দেড়শ টাকা রোজগার করি। এই টাকাতেই খাই। টাকা না পেলে খাওয়া হয় না। কোনো সন্তান নেই, পাঁচ বছর আগে স্ত্রীও চলে গেছে। এখন একলাই থাকি।" ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি রেখে কথাগুলো বলছিলেন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার আমখোলা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডে আশ্রিত বাসিন্দা জাফর (৫৬)।
জাফরের জীবনসংগ্রাম শুধুই কষ্ট আর অভাবের গল্প। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, দুর্বল শরীর নিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮–১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে গলাচিপা শহরে যান, দোকানে দোকানে কলসি পানি সরবরাহ করেন। বিনিময়ে পান মাত্র পাঁচ টাকা। এটাই তার জীবিকা।
আমখোলা ইউনিয়নের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান (পান্না) জানান, জাফর মূলত পটুয়াখালী সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ বাদুরা গ্রামের মুজু প্যাদার ছেলে। তবে তিনি গত ২৭ বছর ধরে আত্মীয় মজিবর মিয়ার বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে বসবাস করছেন।
তিনি বলেন,“মানুষ যেখানে হাজার টাকা রোজগারের জন্য নানা কৌশল নেয়, সেখানে জাফরের মত মানুষ শুধুমাত্র এক টুকরো রুটি আর কলার জন্য কাঁধে পানি টেনে গ্রাম থেকে শহর ছুটে চলে। তার কোনও ভবিষ্যৎ ভাবনা নেই—শুধু বেঁচে থাকার লড়াই।”
আশ্রয়দাতা মজিবর মিয়া জানান, এক সময় জাফর দিনমজুর হিসেবে কাজ করলেও এখন বয়স ও অসুস্থতার কারণে তা আর সম্ভব নয়। প্রতিদিন হেঁটে শহরে গিয়ে পানি সরবরাহ করে যা আয় হয়, তাই দিয়েই খাবার সংগ্রহ করে। যেদিন আয় হয় না, সেদিন না খেয়েই দিন কাটাতে হয়। তার কোনো সরকারি সহায়তা নেই, এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্রও নেই। প্রায় ত্রিশ বছর আগে বিবাহিত স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। জরাজীর্ণ ঘরে জাফরের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক ভাই বসবাস করেন, তাকেও দেখতে হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন,“জাফর খুব সহজ-সরল মানুষ। শারীরিকভাবে দুর্বল এবং কিছুটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীও। অসুস্থ হলে ওষুধ কেনার সামর্থ্য থাকে না। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা—সব ঋতুতেই কষ্ট করে বাঁচে। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় কোনো সহযোগিতাও পায় না।”
চা দোকানদার সিদ্দিক মিয়া বলেন,“জাফর কোনো ভারি কাজ করতে পারে না। তাই আশপাশের নলকূপ থেকে পানি এনে আমাদের দোকানে দিয়ে থাকে। প্রতি কলসের জন্য আমরা ৫ টাকা দেই।”
এ বিষয়ে আমখোলা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. শাহ আলম বলেন,“আমি ব্যক্তিগতভাবে জাফরকে চিনি। সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা পায় কি না, জানি না। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করবো।”
স্থানীয়দের দাবি, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যেন দ্রুত তার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরির ব্যবস্থা নেয় এবং ভাতাভুক্তি বা সহায়তা কর্মসূচিতে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে একটি অসহায় মানুষের জীবন কিছুটা হলেও মানবিক পরিবেশে কাটতে পারবে।
একুশে সংবাদ/প.প্র/এ.জে