কাঁঠালের গন্ধে ভরে আছে ভালুকা, কিন্তু কৃষকের চোখে ভেসে ওঠে পচে যাওয়া স্বপ্নের ছবি।ময়মনসিংহের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত ভালুকা উপজেলা, একদিকে শিল্পাঞ্চলের দখলে, অন্যদিকে লালমাটির উঁচু-নিচু পাহাড়ি বনভূমির বুকজুড়ে বিস্তৃত ফলের রাজ্য। এই জনপদ আজও কাঁঠালসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফলের জন্য খ্যাত। এবার কাঁঠালের বাম্পার ফলনে কৃষকদের চোখে ছিল উজ্জ্বল স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নের সেই ফলন যেন ধরা দেয়নি বাস্তবতায়—কারণ একটাই : সংরক্ষণের কোনো হিমাগার নেই।
উৎপাদন আছে, বাজার আছে, ক্রেতাও আছে—নেই কেবল একটি হিমাগার
চলতি বছর ভালুকা উপজেলার প্রায় ৩৮৫ হেক্টর জমিতে কাঁঠালের আবাদ হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, মোট উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪৩,১০০ মেট্রিক টন। উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই প্রাকৃতিক উপায়ে গড়ে উঠেছে কাঁঠালের চাষ।
বাম্পার ফলনের এই মৌসুমে চাষিদের মুখে আশার আলো থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তারা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। কারণ, এত বিপুল উৎপাদন সত্ত্বেও এই অঞ্চলে একটি হিমাগার বা সংরক্ষণাগারও নেই। ফল পেকে গেলে দ্রুত বিক্রির চাপ তৈরি হয়, অন্যথায় তা পচে যায়।
এই আশঙ্কায় চাষিরা বাধ্য হচ্ছেন বাজারে হড়বড়িয়ে বিক্রি করতে—যার ফলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে গিয়ে কমে যাচ্ছে দাম। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তারা পাচ্ছেন না ন্যায্য মূল্য।
উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নুসরাত জামান বলেন,
‘কাঁঠাল চাষে অনেক আগে থেকেই ভালুকা বিখ্যাত। এ বছর ভালুকাতে প্রায় ৩৮৫ হেক্টর জমিতে কাঁঠালের আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৪৩ হাজার ১০০ মেট্রিক টন। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে।’
হাটবাজারে কাঁঠালের স্তুপ, মোড়ে মোড়ে বিক্রেতা—ভরা মৌসুমেও কৃষক হতাশ
ভালুকার কাঁঠালের মৌসুম এখন যেন এক উৎসবের রূপ নিয়েছে। সিডস্টোর বাজার, ভালুকা বাসস্ট্যান্ড, ভরাডোবা বাসস্ট্যান্ড, মল্লিকবাড়ী বাজার, বিরুনিয়া বাজার, কাচিনা বাজার, বাটাজোড় বাজার, শান্তিগঞ্জ বাজার, মাস্টারবাড়ী বাসস্ট্যান্ড, আঙ্গারগাড়া বাজার ও পোনাশাইল বাজারসহ ভালুকা উপজেলার প্রতিটি বাজারে বাতাস ভারি হয়ে আছে পাকা কাঁঠালের ম-ম গন্ধে।
ভোর হতে না হতেই ভালুকার গ্রামীণ পথঘাটে শুরু হয় এক স্বতঃস্ফূর্ত মানবপ্রবাহ। কেউ কাঁধে ঝুলিয়ে, কেউ ঠেলাগাড়িতে সাজিয়ে, কেউবা মাথায় করে বা রিকশার পেছনে বেঁধে বাজারে আনছেন মৌসুমের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল—কাঁঠাল। অনেকেই বসছেন বাজারের টিনের ছাউনির নিচে, কেউ কেউ আবার বসে পড়ছেন রোদে ঝলসানো রাস্তার মোড়ে, অস্থায়ী চটের ছাউনির নিচে।’
শুধু সাপ্তাহিক হাট নয়, জাতীয় ফল কাঁঠালকে ঘিরে ভালুকায় প্রতিদিনই গড়ে উঠছে একেকটি অঘোষিত হাট। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বাজারের গলিঘুঁজির ভেতর পর্যন্ত—যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই কাঁঠালের পসরা। কারও কাছে এটি মৌসুমি আয়, আবার কারও কাছে এটি সারা বছরের সংসার চালানোর ভরসা।
এই দুই-তিন মাসের কাঁঠালের ভরা মৌসুমে কেবল চাষিরাই নন, আয় বাড়ে পরিবহনকর্মী, হোটেল-শ্রমিক, মুটে-মজুর—সব শ্রেণির মানুষেরই। ভালুকার প্রতিটি বাজার যেন পরিণত হয়েছে এক সরাসরি অর্থনীতির উৎসবমুখর কেন্দ্রে।
সরেজমিন পর্যবেক্ষণ : সুঘ্রাণে ভরা বাজার, আর্থিক ক্ষতির শঙ্কাও তীব্র
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়—উপজেলার প্রতিটি বাজারের শেডঘর, আঙিনা ও রাস্তার পাশে ঠাসা কাঁঠালের স্তূপ। বাটাজোর বাজারে শেডঘর থেকে উঠোন পর্যন্ত কাঁঠালেই কাঁঠাল—মৌসুম যেন চোখে আঙুল দিয়ে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি।
পাইকাররা একদিকে কাঁঠাল বাছাই করছেন, অন্যদিকে চাষিরা দাম নিয়ে দরকষাকষিতে ব্যস্ত। কেউ হাসছেন, কেউ মুখ গোমড়া করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। তবে সবচেয়ে কষ্টকর চিত্র—অনেক কাঁঠাল পেকে গাছেই ঝরে পড়ছে, নষ্ট হচ্ছে বিক্রির অপেক্ষায়।
সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায়, কাঁঠালগুলো দিনের আলো ফুরোনোর আগেই হয় বিক্রি হবে, নইলে পচে যাবে—এমন এক দমবন্ধ বাস্তবতায় দিন পার করছেন ভালুকার শত শত চাষি।
সবমিলিয়ে—ভালুকার এই কাঁঠাল-উৎসব যেন অর্থনীতির ঘ্রাণ মাখা এক দীর্ঘশ্বাস, যা অবহেলার ছুরিতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন।
চাহিদা দেশজুড়ে, তবু দাম নেই; কারণ—সংরক্ষণের অব্যবস্থা
নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও ঢাকার কাঁঠালের পাইকার এনামুল হক ও তারা মিয়া বলেন, ‘ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভালুকার কাঁঠালের বেশ চাহিদা। তিনি বলেন, ‘গাড়ি ভাড়াসহ ১ লাখ টাকার কাঁঠাল কিনলে বেচা হবে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা।’
সিডস্টোর বাজারের আড়তদার মেহিদী মৃধা বলেন, ‘আমি প্রায় ১০ বছর ধরে কাঁঠাল বেচাকেনা করছি। কাঁঠালের সাইজ বুঝে দাম। ছোটটা ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত আর বড়টা ৩০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আমাদের এলাকার কাঁঠালের চাহিদা দেশের অন্য অঞ্চলে রয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর কাঁঠাল উৎপাদন ভালো দামও কম। যদি কাঁঠাল সংক্ষরণের জন্য হিমাগার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে চাষিরা লাভবান হতেন।’ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা আসেন এই হাটে। এ ছাড়াও নোয়াখালী, সিলেট, রাজশাহী, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গাড়ির মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
‘চোখের সামনে কাঁঠাল পঁচে যায়’, বলছেন চাষিরা—‘হিমাগার থাকলে এত ক্ষতি হতো না’
হবিরবাড়ী ইউনিয়নের কাঁঠাল চাষিরা বলেন, ‘প্রায় প্রতিবছর কাঁঠালের ফলন ভালো হয়। সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার কাঁঠাল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। উপযুক্ত দাম থেকে বঞ্চিত হন। এলাকায় সরকারি উদ্যোগে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে।’
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন, ‘হবিরবাড়ি ইউনিয়নের ব্লক আমি দেখাশোনা করি। এলাকাতে কাঁঠাল সবচেয়ে বেশি হয়। বর্তমান বাজারে কাঁঠালের দাম একটু কম।’
কাঁঠাল শুধু খাওয়ার ফল নয়—এটি হতে পারে রপ্তানিযোগ্য পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল
বর্তমানে বিশ্ববাজারে কাঁঠালের চিপস, প্যাকেটজাত কাঁঠাল, কাঁঠালের বীজ দিয়ে নুডলস ও মাংসবিকল্প হিসেবে এর চাহিদা বেড়েছে বহুগুণে। অথচ বাংলাদেশ, বিশেষ করে ভালুকা এখনও মৌসুমি ফলের মৌসুমি ব্যবস্থাপনার বাইরে আসতে পারেনি।
ভালুকার কাঁঠাল শুধু মৌসুমি ফল নয়, এটি হতে পারে একটি রপ্তানিযোগ্য সম্পদ। এখন প্রয়োজন দ্রুত হিমাগার স্থাপন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ উদ্যোগ—যাতে পঁচে যাওয়া ফল নয়, প্রসারিত হোক কৃষকের আশা।
একুশে সংবাদ/ম.প্র/এ.জে