নড়াইল শহরের চিত্রা নদীর পাড়ে শতাধিক বছরের পুরনো এক ঐতিহ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে জমিদারদের নির্মিত বাঁধাঘাট। জমিদার কালী শংকর রায়ের হাত ধরে নির্মিত এই বাঁধাঘাটটি আজও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘জলজ তাজমহল’ নামেও পরিচিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নাটোরের রাণী ভবানীর পতনের পর নড়াইল অঞ্চলে জমিদার কালী শংকর রায় হয়ে ওঠেন অন্যতম প্রভাবশালী জমিদার। খুলনা, যশোর ও নড়াইল জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল তাদের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত। যদিও জমিদার রূপরাম রায় প্রথম আলাদাতপুর তালুক ক্রয়ের মাধ্যমে জমিদারির গোড়াপত্তন করেন, মূল প্রসার ঘটে কালী শংকর রায়ের আমলেই।
ইংরেজদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর সময় তিনি নামে-বেনামে বিভিন্ন তালুক কিনে জমিদারি বিস্তৃত করেন। রূপপাত, তেলিহাটি, বিনোদপুর, তরফ কালিয়া ও তরফ দারিয়াপুরসহ অনেক তালুক তার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি নির্মাণ করেন বিশাল অট্টালিকা, নাট্যমঞ্চ, দীঘি, মন্দির, ফলের বাগানসহ এক রাজবাড়ি।
১৮৫৩ সালে নড়াইল শহরের কুড়িগ্রাম এলাকায় চিত্রা নদীর পাড়ে তৈরি হয় এই বাঁধাঘাট। জমিদার বাড়ির নারীদের স্নানের জন্য নির্মিত ঘাটটি ২১টি সিঁড়ি দিয়ে নদীর দিকে নেমে গেছে। চুন-সুরকি আর রেলের স্লিপার দিয়ে নির্মিত এই বাঁধাঘাট দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। বর্তমানে ১৫টি সিঁড়ি অক্ষত রয়েছে।
নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের পাশেই অবস্থিত এ বাঁধাঘাটে প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে বহু দর্শনার্থী আসেন। শহরে বিনোদনের অভাব থাকায় ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের সময় এটি হয়ে ওঠে আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু।
ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী শান্তা বিশ্বাস বলেন,"কলেজের ক্লাস না থাকলে বন্ধুরা মিলে এখানে আড্ডা দিতে আসি। নদীর পাড়ে মনোরম পরিবেশ সব সময়ই দারুণ লাগে।"
ছাত্র হিমেল কুণ্ড, দিগন্ত বিশ্বাস, জসিম ও তিতাস জানান,“প্রচণ্ড গরমেও এখানে ঠান্ডা হাওয়া থাকে। সময় কাটানোর জন্য এটি দারুণ জায়গা, প্রায়ই আসা হয় এখানে।”
নড়াইলের জেলা প্রশাসক আশফাকুল হক চৌধুরী বলেন,“নড়াইল জেলার গৌরব ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ। এর পাশাপাশি জমিদারদের রেখে যাওয়া স্থাপত্য আমাদের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বাঁধাঘাট এখন নড়াইলের একটি দর্শনীয় স্থান। জমিদারদের রেখে যাওয়া অবৈধভাবে দখল হওয়া জমিগুলো আমরা উদ্ধার করেছি এবং সেখানে ডিসি ইকোপার্ক নির্মাণ করেছি, যা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। বাঁধাঘাটটিরও বিভিন্ন সময়ে সংস্কার করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।”
দেশ বিভাগের পর জমিদাররা ভারতে চলে যান। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত কেউ কেউ ফিরে এলেও পরবর্তীতে আর কেউ আসেননি। ১৯৬৫ সালে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির মাধ্যমে এই ইতিহাসের একটি অধ্যায় শেষ হয়, কিন্তু চিত্রা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁধাঘাট আজও সেই ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষ্য বহন করছে।
একুশে সংবাদ//ন.প্র//এ.জে
আপনার মতামত লিখুন :