ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বর্ষপূর্তিতে তার কর্মকান্ড নিয়ে একটি মূল্যায়ন জরিপ করেছে শিক্ষার্থীরা। এতে উপাচার্যের প্রতি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চরম অনাস্থার বিষয়টি উঠে এসেছে।
ফলে উপাচার্যের কার্যক্রম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তীব্র সমালোচনা। তবে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক স্বল্পতা ও শ্রেণিকক্ষ সংকটই উপাচার্যের প্রতি অনাস্থার মূল কারণ বলে মনে করছেন জরিপ আয়োজক ও অনুষদীয় ডিনরা।
তারা বলছেন, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে শিক্ষক নিয়োগ ও শ্রেণিকক্ষ সংকটের বিকল্প নেই। চলমান এ সংকটে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে স্বাভাবিক শিক্ষাকার্যক্রম। এদিকে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নকে সাধুবাদ জানিয়ে আরও বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব কাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন উপাচার্য।
জানা যায়, গণঅভ্যূত্থানের পর ইবির ১৪ তম উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণ করলে ক্যাম্পাস সংস্কারে একাধিকবার বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি জানানো হয়। কিন্তু সংকট কাটাতে প্রশাসন দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে বলে দাবি শিক্ষার্থীদের। এতে ক্যাম্পাস সংস্কারে উপাচার্যের অবদানে হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
তাদের দাবি— উপাচার্য বারংবার বিভিন্ন আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়নে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এদিকে এই অনাস্থার পেছনে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক স্বল্পতা ও শ্রেণিকক্ষ সংকটকেই দায়ী করেছেন জরিপ আয়োজক ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৪ বিভাগের চলমান শিক্ষক সংকট এ অসন্তোষের মূল কারণ বলে দাবি তাদের। শিক্ষক স্বল্পতায় বিভাগগুলোর অধিকাংশই চরম সেশনজটে জর্জরিত। ধার করা শিক্ষক নিয়ে শ্রেণিকার্যক্রম চালানোয় মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
তীব্র শিক্ষক সংকটে থাকা বিভাগগুলো হলো— চারুকলা, সমাজকল্যাণ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ফোকলোর স্টাডিজ, ল’ অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মেসি, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম, মার্কেটিং এবং জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট।
এছাড়া শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে এসব বিভাগের সুষ্ঠু একাডেমিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষ দখল নিয়ে বিভিন্ন সময় পাল্টাপাল্টি অবস্থানেরও নজির রয়েছে। শ্রেণিকক্ষ বুঝে পেতে গতবছর চারুকলা, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ফোকলোর স্টাডিজ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা কয়েক দফায় মানবন্ধন করেন। পরবর্তীতে কয়েকটি বিভাগের শ্রেণিকক্ষ সংকট আংশিক মিটলেও অধিকাংশ বিভাগের সংকট এখনও কাটেনি। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক নিয়োগ ও শ্রেণিকক্ষের দাবিতে আন্দোলনও করেছেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন বিগত এক বছরের দায়িত্ব পালনকালে এসব বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেনি। এছাড়া শ্রেণিকক্ষ সংকটও সমূলে নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। এতে একাডেমিক ক্ষেত্রে এসব সংকটই উপাচার্যের প্রতি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এই অনাস্থা তৈরি করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষক সংকট নিরসনে ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, জীববিজ্ঞান, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, আইন ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ২১টি বিভাগে মোট ৫৯টি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে আবেদন করেন প্রার্থীরা। তবে এসব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইউজিসির অর্থছাড়ের পূর্বানুমতি না নেওয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে। পরে ইউজিসি শিক্ষক সংকট বিবেচনায় ছয়টি বিভাগে মাত্র ছয়টি পদে অর্থছাড় অনুমোদন দেয়।
প্রশাসনের দাবি— বিজ্ঞপ্তি দেওয়া পদগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারলে এ সংকট অনেকাংশেই কেটে যেত। কিন্তু ইউজিসি থেকে অর্থছাড়ের অনুমোদন না পাওয়ায় নিয়োগ আটকে আছে। শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইউজিসির সঙ্গে সমন্বয়ে চেষ্টা করছে।
ইবি সংস্কার আন্দোলনের সদস্য খন্দকার আবু সাঈম বলেন, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রমের একেবারে প্রাথমিক প্রয়োজনীয় বিষয় পর্যাপ্ত শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ নিশ্চিত করতে না পারায় শিক্ষার্থীদের আস্থা হারিয়েছেন উপাচার্য। তবে তিনি শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন পূরণে আরও বেশি মনোযোগী হলে তাদের আস্থা ফিরবে বলে আশা রাখি।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. রোকসানা মিলি বলেন, শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ সংকটে থাকা বিভাগগুলোর একাডেমিক কার্যক্রম চরমভাবে বাঁধাগ্রস্ত হওয়ায় উপাচার্যের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য শ্রেণিকক্ষ সংকট নিরসন করে অতিদ্রুত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিভাগগুলোকে সেশনজটমুক্ত করে সুষ্ঠু একাডেমিক কার্যক্রম নিশ্চিত করলে উপাচার্যের প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থা ফিরবে।
প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন এবং ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মনজুরুল হক বলেন, প্রতিটি অনুষদে শেসনজট নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষক স্বল্পতা ও শ্রেণিকক্ষ সংকট সহ যেসব সংকট একাডেমিক কার্যক্রম ব্যহত করছে সেগুলো সুরাহার চেষ্টা চলছে। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া হওয়ায় আরও কয়েকমাস পরে চলমান সকল কাজ সম্পন্ন হলে সেগুলো দৃশ্যমান হবে। এছাড়া চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের অসম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে ক্যাম্পাসের অনেক সংকটই কেটে যাবে এবং শিক্ষার্থীদের আস্থা ফিরবে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, চলমান একাডেমিক ভবনের কাজ শেষ হলে শ্রেণিকক্ষ সংকট কেটে যাবে। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগের জন্য আমরা ইউজিসির সঙ্গে আলোচনা করছি। আমরা অতিদ্রুত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিভাগগুলোকে সেশনজটমুক্ত করতে পারবো বলে আশা করছি।
একুশে সংবাদ/এ.জে