শাসক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে উন্নয়ন অঙ্গিকারের আরও একটি মেগাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন হলো। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈয়কতের গর্বিত মালিক বাংলাদেশ। ঢাকা থেকে পর্যটকেরা কক্সবাজার যেতে বাস ছাড়াও বিমানে যেতে হতো। তা ছিল ব্যয় বহুল। সেই ব্যয়বহুল যাত্রা এখন অতীত।
ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি রেলযাত্রায় ব্যয় কমার পাশাপাশি ট্রেনের সব রকমের সুবিধা থাকছে। বাংলার সরালো খাবার-দাবারের সঙ্গে পরিচিত হবেন বিদেশি পর্যটকেরা। ভাপা ইলিশের পাশাপাশি কাচ্চি বিরিয়ানির স্বাদ নেবার মতো সুযোগ থাকছে এই রেলপরিষেবায়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে স্বাধীনতার ৫২ বছরের মধ্যে স্মরণকালের উন্নয়ন হয়েছে ১৫ বছরে। দক্ষিণ এশিয়ায় অপ্রত্যাশিত উন্নয়নের জনক শেখ হাসিনা। যার স্লোগান ‘ক্ষমতা বলতে বুঝি মানুষের সেবা’। বটামলেস বাসকেট থেকে মহাকাশ জয়ের বাস্তবতাকে ছুঁয়ে নদীর তলদেশে সাবরেমিন ও টানেলই নয়, উন্মত্ত পদ্মায় নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করে যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন শেখ হাসিনা, তা ৭১’র মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
শেখ হাসিনা বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশের উন্নয়নে রীতিমত যুদ্ধ চালিয়েছেন। আজ বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়া নয়, বিশে^র রোল মডেল। অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ সেই স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
রোববার যখন বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় দফা অবরোধ কর্মসূচি চলছে, সেই সময় চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে শুরু হয়েছে পরীক্ষামূলক রেলযাত্রা। উন্নয়ন সড়কে আরও এক ধাপ এগিয়ে সারাদেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগে যুক্ত হলো কক্সবাজার। এদিন চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজারে শুরু হয়েছে প্রথম ট্রেনের যাত্রা। যদির পূর্বাঞ্চ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এটিকে ট্রায়াল রান বলছে না, তাদের ভাষায় এটি মূলত রেলপথের নির্মাণ কাজ পরিদর্শন এবং কোনো ত্রুটি রয়েছে কি-না তা যাচাই করতেই তাদের এই পর্যবেক্ষণ যাত্রা।
রোববার (৫ নভেম্বর) সকাল ৮টার দিকে আটটি বগি নিয়ে চট্টগ্রাম স্টেশন ছেড়ে যায় ট্রেনটি। এতে করে যাচ্ছেন পরিদর্শন অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এ যাত্রায় নির্মাণাধীন দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন ও বিভিন্ন স্টেশন পরিদর্শন করতে করতে তারা।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের ইন্সপেকশন টিম এ রেলপথ পরিদর্শন করবেন। রোববার সকাল ৮টার দিকে কক্সবাজারের পথে ট্রেনটি চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়। টিমটি এ রেলপথের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়াবে এবং ধীরে ধীরে কক্সবাজারের দিকে যাবে। একই সঙ্গে নবনির্মিত রেলপথের ব্রিজগুলোতেও দাঁড়াবে। মূলত উদ্বোধনের আগে খুঁটিনাটি সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করবেন বাংলাদেশ রেলওয়ের ইন্সপেকশন টিম। বিকেল নাগাদ এ টিম কক্সবাজার পৌঁছাবে। তিনি বলেন, দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের কর্মকর্তা থাকবে ৮ থেকে ১০ জন। আর বাকি সব বাংলাদেশ রেলওয়ের ইন্সপেকশন টিমের কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. মফিজুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে রোববার কোনো ট্রায়াল রান হচ্ছে না। গভার্মেন্ট ইন্সপেক্টর অব বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ রেলপথ ইন্সপেকশন করবে। এটা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটা বিভাগ। যেটা বাংলাদেশ রেলওয়ের বাইরে, কিন্তু রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গভার্মেন্ট ইন্সপেক্টর।
‘এটা ইঞ্জিনের ট্রায়াল বা গাড়ির ট্রায়াল না; এটা হলো রেল লাইন ঠিক আছে কি-না কিংবা রেল চলতে পারবে কি-না, সেটাই তারা যাচাই করবে। আর কত স্পিডে ট্রেন চলতে পারবে সেটাও পর্যবেক্ষণ করবে এ টিম। প্রধানমন্ত্রী যখন এ রেলপথ উদ্বোধন করবেন, তার আগে সামগ্রিক বিষয় জানান দেয়ার জন্য এটা করা হয়।’
প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এ রেলপথ। এ পথের ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে - ঢাকা থেকে নন এসি শোভন চেয়ার ৫১৫ টাকা, এসি সিট ৯৪৮ টাকা, এসি কেবিন ১ হাজার ৩৬৩ টাকা এবং এসি বার্থ ২ হাজার ৩৬ টাকা।
পৃথক দুই ভাগে কাজটি করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইনে এছি ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু ও কালভার্ট, বিভিন্ন শ্রেণির ৯৬টি লেভেল ক্রসিং। হাতি চলাচলের জন্য রয়েছে দুটি আন্ডারপাস। নির্মাণ করা হয়েছে ৯টি স্টেশন। স্টেশনগুলো হলো: দোহাজারি, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুতে ট্রেন ইঞ্জিনের ট্রায়াল রান সফলভাবে শেষ হয়েছে। শনিবার (৪ নভেম্বর) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিনটি রেল ইঞ্জিন চালিয়ে এটি যাচাই করা হয়।
শুরুতে সাড়ে ১০ টনের ২২০০ সিরিজের ইঞ্জিন, তারপর ১১.১৬ টনের ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিন এবং সবশেষ ১৫ টনের তিন হাজার সিরিজের ইঞ্জিন সেতুতে চলাচল করে। আর এ সিরিজের ইঞ্জিন দিয়েই কক্সবাজার রেলপথে ট্রেন চলবে।
ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের পথে যেতে হলে ট্রেনকে প্রায় শতবর্ষী এ সেতু পাড়ি দিতে হবে। এ সেতুর সংস্কার কাজের জন্য গত ১ অগাস্ট থেকে তিন মাসের জন্য সেতুটিতে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১১ নভেম্বর কক্সবাজারের পথে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করবেন বলে জানানো হয়েছে। এর আগে, আজ (রোববার) ৮টি বগি ও একটি ইঞ্জিন নিয়ে দোহাজারি-কক্সবাজার নবনির্মিত এ রেলপথ যাক্রা করে একটি ইন্সপেকশন টিম। তারা রেলপথ ও স্টেশনসহ সব বিষয় যাচাই করে দেখবে।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, ‘তিন রকমের ইঞ্জিন ট্রায়াল সফলভাবে শেষ হয়েছে। কালুরঘাট সেতু ট্রেন চলাচলের জন্য প্রস্তুত আছে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ পরামর্শক দল ও রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।’
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা বলেন, ‘শনিবার আমরা নতুন মডেলের ইঞ্জিন দিয়ে একাধিকবার ট্রায়াল রান করেছি। কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে এখন ট্রেন চলাচলে আর কোনো বাধা নেই। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে নতুন জেলা হিসেবে যুক্ত হবে কক্সবাজার।’
চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলার একাংশের যোগাযোগের মাধ্যম এ কালুরঘাট সেতু। সড়কপথে সব ধরনের যানবাহনের পাশাপাশি এ সেতু দিয়েও ট্রেন চলে। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হয় ৭০০ গজ দীর্ঘ রেল সেতুটি। ১৯৫৮ সালে সেতুটি সব ধরনের যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় পাকিস্তান সরকার। ২০১০ সালে তৃতীয় শাহ আমানত সেতু উদ্বোধনের আগ পর্যন্ত কালুরঘাট সেতু দিয়ে ভারী যান চলাচলের কারণে, সেটি নাজুক হয়ে পড়ে। ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর ২০০৪ ও ২০১২ সালে সেতুটি দুদফা সংস্কার করেছিল রেল কর্তৃপক্ষ।
একুশে সংবাদ/এএইচবি/এসআর
আপনার মতামত লিখুন :