দিন দিন নতুন করে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশেই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে চিকিৎসকরা।
যদিও গতকালের তুলনায় শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) ডেঙ্গুতে কারো প্রাণহানি হয়নি, আক্রান্ত হয়েছে ৩১০ জন। এরআগে বৃহস্পতিবার ডেঙ্গুতে ৮ জনের মৃত্যু হয়। আক্রান্ত হয় ৭৬৫ জন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আজ (১৪ অক্টোবর) পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩ হাজার ৫৯২ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ২০ হাজার ৭৯৪ জন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা নেয়া অন্নির মা পারভীনা খাতুন বলেন, ‘আমার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আজ তিন দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। এখন অনেকটা সুস্থ। ডাক্তার বলেছেন, এক দিন পরে বাসায় চলে যেতে পারব।’
আরো পড়ুন, হাসপাতালে ভর্তি ৩১০ ডেঙ্গু রোগী
রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় শতাধিক ডেঙ্গু রোগী। দেখা গেছে হাসপাতালের বেডে সিট না পেয়ে বারান্দায় চিকিৎসা অনেকেই। প্রায় সব হাসপাতালে এভাবেই চিকিৎসা নিচ্ছে ডেঙ্গু রোগী। কেউ চিকিৎসা নিচ্ছেন আবার কেউ ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ছেন। আসা-যাওয়ার মাঝেই রয়েছে ডেঙ্গু রোগী।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা নেয়া আতিকুর রহমান বলেন, ‘হঠাৎ সন্ধ্যার পরে শরীর গরম হতে দেখে একটি নাপা খেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম জ্বর আসলে সেরে যাবে। পরে মাঝ রাতে শরীর ব্যথা করে আর প্রচণ্ড জ্বর আসে। টেস্ট রিপোর্টে দেখা যায় ডেঙ্গু পজিটিভ। আজ দুই দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি।’
ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত কক্সবাজারে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আহমেদুল কবির।
তিনি জানান, হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৮ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া তিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে ১৮ জন, ছয় থেকে নয় দিনের মধ্যে ছয় জন এবং নয় থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যাই শুধু প্রকাশ করে। বাস্তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। যার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া যায় না।
আরো পড়ুন, ডেঙ্গুতে একদিনে সর্বোচ্চ ৮ মৃত্যু, হাসপাতালে ৭৬৫
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে জানতে চাইলে সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ছাড়াও খুলনা, বরিশাল কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলায় রোহিঙ্গা শিবিরে আমরা মশা জরিপ করেছি। মশা নিধন না করতে পারলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।’
জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে বা কমছে। এ থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী কার্যকর কোনো উদ্যোগ স্বাস্থ্য বিভাগের বা অন্য কোনো বিভাগের নেই। এ নিয়ে অতীতে দেশি–বিদেশি বিশেষজ্ঞরা যেসব সুপারিশ করেছেন বা পরামর্শ দিয়েছেন, তার কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করা হয়নি।’
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ উপেক্ষিত
২০১৭ সালে ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগতত্ত্ববিদ কে কৃষ্ণমূর্তিকে ঢাকায় পাঠিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেওয়ার জন্য। সরকারের কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে কে কৃষ্ণমূর্তি ‘মিড–টার্ম প্ল্যান ফর কন্ট্রোলিং অ্যান্ড প্রিভেন্টিং এডিস–বর্ন ডেঙ্গু অ্যান্ড চিকুনগুনিয়া ইন বাংলাদেশ’ নামের ২২ পৃষ্ঠার একটি পরিকল্পনা দলিল তৈরি করেন।
আরো পড়ুন, ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত কক্সবাজারে
ওই দলিলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মূল্যায়ন করার পশাপাশি রোগতত্ত্ববিদ, কীটতত্ত্ববিদ, অণুজীববিজ্ঞানী, তথ্য–শিক্ষা–যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে ‘র্যাপিড রেসপন্স টিম’ গঠন করতে বলা হয়েছিল। ১২টি মন্ত্রণালয়কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে বলা হয়। ওই পরিকল্পনার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৯ সালের মধ্যে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা ছিল।
ডেঙ্গু রোগী সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে নাগরিকদেরও দায় আছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘এখন আমরা মশা নিয়ে যে রেজাল্ট পাচ্ছি, তা এ মাসের শুরুর দিকের। হয়তো এখন একটু কমতে পারে, তবে ঘনত্ব প্রায় একই রকম থাকবে। রাজধানীর যে জায়গাগুলোতে এডিস মশার ঘনত্ব ২০-এর ওপরে সেই জায়গাগুলোতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।’
মশার ওষুধে কোনো ঘাটতি আছে কি না, জানতে চাইলে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘এখানে সমস্যা ওষুধের না। কীটনাশকের খুব একটা ভূমিকা নেই। এখানে মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বাড়িতে সবাই যদি সচেতন হয় তাহলে এডিশ মশা অনেক কমে যেত।’
তিনি বলেন, ‘এডিস বাসাবাড়ি বা নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নেয়। মেঝেতে জমে থাকা পানিতে এটি বেশি পাওয়া যায়। সিটি করপোরেশনের যেমন এডিস মশা দমনের দায় আছে, তেমনই বাসাবাড়িতে যেন মশা না হয়, সেটির দায় নাগরিকদের নিতে হবে।’
একুশে সংবাদ/এসএপি