সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর উপজেলার চামরদানী ইউনিয়নের গুরমার হাওর পাড়ে মুকসুদপুর নামে একটি গ্রাম ছিল। প্রায় ৫৫ বছর আগে গ্রামটি অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। এই গ্রামে হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে বসবাস করতো প্রায় শতাধিক পরিবার। সবার মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন ছিল দৃঢ় । শুষ্ক মৌসুমে হাওরে ফসল উৎপাদন এবং বর্ষা কালে হাওরে মাছ ধরতো গ্রামের সকল মানুষ। হেমন্তে ধান আর বর্ষায় মাছ শিকার করে, এভাবেই চলতো গ্রামবাসীর জীবন।
জানা যায়, বছরের পর বছর পাহাড়ি ঢলের সৃষ্ট হয়ে অকাল বন্যায় ফসল হারাতে শুরু হলো গ্রামবাসীর। সেই সাথে বন্যায় হাওরের টেউয়ের আঘাতে একসময় গ্রামটির বাড়ি ঘর ভেঙে বিলুপ্ত হয়ে যায় গ্রামের অস্তিত্ব। ফলে মুকসুদপুর গ্রামের বাসিন্দারা জীবিকার তাগিদে শূণ্যহাতে উপজেলার বংশীকুণ্ডা উত্তর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী অঞ্চল বাকাতলা গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেন। এক সময় স্বামী-সন্তানদের নিয়ে মুকসুদপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন (৭৫) বছর বয়সী বৃদ্ধা গীতা রাণী সরকার। গুরুমা হাওরে নিজের জমি কৃষি কাজের জন্য প্রতিবছরেই পরিবারের লোকজন নিয়ে জিরাতি হয়ে সেই মুকসুদপুরে আসেন তিনি।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে আমি স্বামী-সন্তানদের লইয়া মুকসুদপুর গ্রামে বসবাস করতাম। শুকনা মৌসুমে হাওরে বোরো ফসল ফলাইতাম, আর ভাইসা মাসে হাওরে মাছ ধইরা যে রোজগার হইতো তা দিয়া সংসারের খরচ চালাইতাম। ৭১ এর সংগ্রামের সময় আমরা গ্রাম ছেড়ে ভারতের পাহাড়ে চলে যাই। পরে ধীরে ধীরে গ্রামটি হাওরের টেউয়ের আঘাতে ভাইঙ্গা তছনছ হয়ে যায়। পরে গ্রামের লোকজন সবকিছু হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে সীমান্তবর্তী বাকাতলা নামক স্থানে গ্রাম হিসেবে বসতি স্থাপন করি। এর পর থেকে শুকনা মৌসুমে মুকসুদপুরে জিরাতি হইয়া আইসা বোরো ফসলের চাষাবাদ করি,ভাইসা হইলে ঘর সহ সকল জোগাল পাতি নিয়া পাহাড়ের কাছে বাঁকাতলা গ্রামে চলে যাই।
মুকসুদপুর জিরাত বাড়ির আরেক বাসিন্দা কৃষক শংকর সরকার (৫৫) বলেন, প্রতি বছর হাওরে জমিজমা চাষ করতে আসি। ছয়মাসের মতন নিজের জমি চাষাবাদ করতে হাওরে আইসা জিরাত করা লাগে। এই সময় আমরা সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার অভাবে নানান রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হই। পরিবারের ছোট শিশুরা বছরে ছয়মাস পড়ালেখা করতে স্কুলে যেতে পারে না। এখানে কোনো বিদ্যুৎ না থাকায় কুপি বাতি অথবা সোলার প্যানেল ব্যবহার করে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করি। আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো হাটবাজার না থাকায় সপ্তাহের প্রতি শনিবারে ২০ কিলোমিটার পথ দুরে পায়ে হেঁটে মধ্যনগর বাজার গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হয়।
প্রকৃত অর্থে জিরাতিদের কৃষকের মতো মনে হলেও,তাদের জীবনের গল্পটা একটু ব্যতিক্রম, একটু ভিন্ন ধরনের। উনিশ শতকের প্রথম দিকে জিরাতিরা হাওর অঞ্চলে পতিত জমি চাষাবাদের উপযোগী করে তোলার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তা নাহলে জিরাতিদের আগমণ ছাড়া হাওরাঞ্চলের একরের পর একর জমি অনাবাদি পড়ে থাকতো।
প্রতি বছর কার্তিকের শুরুতে উপজেলার চামরদানী ইউনিয়নের গুরমার হাওরে আগমণ ঘটে ঐ সকল জিরাতিদের। হাওরে বিস্তর চারণভূমির উচু স্থানে চোখে পড়বে তাদের অস্থায়ী গ্রাম ও ছোট ছোট কুঁড়েঘর। এসব ঘরেই বসবাস করেন জিরাতিরা, আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে আর কোনো বসতি ঘর বাড়ি নেই। গবাদি পশুর সঙ্গে গাদাগাদি করে একই সঙ্গে বসবাস করেন তারা। জমি তৈরি করা, চারা রোপণ করা, সেচ করা, পরিচর্যা থেকে শুরু করে ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই শেষে নতুন ধান সঙ্গে নিয়ে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বাড়ি ফেরেন এই জিরাতিরা।
বোরো মৌসুমে জিরাতিরা হাওরে ফসল ফলাতে এসে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হন তারা। এতে দেখা যায় অকাল বন্যায় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে ফসল ডুবে গেলে জিরাতিদের স্বপ্ন ভেঙ্গে হয়ে যায় তছনছ। মাথার উপরে ঋণের বুঝা নিয়েই বাড়ি ফিরেন তারা। ভালো ফলনের আশায় বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে সারা বছর পরিশ্রম করেন তারা।
যুগের পর যুগ শত দুঃখ কষ্টে এভাবেই চলছে জিরাতিদের জীবনযাপন। তাদের আদিপুরুষ থেকে বংশ প্রজন্মরা এভাবেই চালাচ্ছেন নিজেদের চাষবাস। কিন্তু এই সকল মানুষেরা নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এই জিরাতিরা। কিন্তু তাদের খবর নেয়না উচ্চ শিকড়ের কোন মানুষ। তারা হাওরে জিরাতকালে নাগরিক জীবনের সকল ধরনের সুযোগ সু্বিধা থেকে বঞ্চিত থাকে তারা। এবিষয়ে জিরাতকালে তাদের
সুপেয় পানীয় জল, স্যানিটেশন ল্যাট্রিন, শিশুদের পড়াশোনার জন্য কমিউনিটি স্কুল স্থাপনসহ সকল ধরনের নাগরিক জীবনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হলে, দেশের খাদ্য উৎপাদনে জন্য তারা আরো বেশি অবদান রাখতে পারবে।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :