AB Bank
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

তিন বছরেও চালু হয়নি রংপুর চিনিক; হতাশ শ্রমিক ও আখচাষীরা


Ekushey Sangbad
জেলা প্রতিনিধি,রংপুর
০৩:১১ পিএম, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩
তিন বছরেও চালু হয়নি রংপুর চিনিক; হতাশ শ্রমিক ও আখচাষীরা

আধুনিকায়নের নামে মাড়াই বন্ধ হওয়ার তিন বছর পরেও চালু হয়নি গাইবান্ধার একমাত্র ভারী শিল্প কারখানা মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনির কল। লাগেনি আধুনিকায়নের কোন ছোঁয়া। উপরন্ত অবহেলা আর অযত্নে মরিচার আস্তরণ পড়ে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রাংশ। 

গাইবান্ধার একমাত্র কৃষিভিত্তিক ভারি শিল্প-কারখানা গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনিকল। লোকসান কমাতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার কথা বলে বিগত ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার নিয়ন্ত্রনাধীন ১৫টির মধ্যে যে ছয়টি চিনিকলে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্রায়াত্ব এ চিনিকলটি।

সে সময় ২০২০-২১ বার্ষিক আখ মাড়াই মৌসুম শুরুর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও সর্বোচ্চ মাড়াইক্ষমতা ও বিপুল পরিমাণ জমিতে দন্ডায়মান আখ জমিতে রেখে একেবারে শেষ মূহুর্তে এ সিদ্ধান্ত নেয়ায় বিক্ষুব্ধ আখচাষী ও শ্রমিক-কর্মচারীরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন বা চাষীদের করুণ আকুতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষীদের। 

তাঁরা বলেন, তখন আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষীদের উদ্দেশ্যে দেশের প্রায় সকল জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো  হয়েছিল, আধুনিকায়ণের মাধ্যমে খুব দ্রুতই আবার চালু করা হবে এই চিনিকলসহ সব ক’টি চিনিকল। কিন্তু প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং ৫০ হাজার চাষী ছাড়াও বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা অর্জনের মাধ্যম এই রংপুর চিনিকলটি চালু হয়নি তিন বছরেও। বরং এ চিনিকলের স্থায়ী চাকুরীজীবীদের একাংশ, গাড়ি, যন্ত্রাংশ ও নানা প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্য চিনিকলে। 

কাজ হারানো ‘কাজ নাই, মজুরী নাই’ (কানামনা) চুক্তিভিত্তিক অর্ধসহস্রাধিক শ্রমিকরা এখন পেটের দায়ে ভ্যান-রিক্সা চালনাসহ বিভিন্ন কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকই হতাশায় নানা রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন এই তিন বছরে। অন্যদিকে চালু রাখা পার্শ্ববর্তী চিনিকলের চাইতে অধিক মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন ও অধিক পরিমাণ আখ উৎপাদিত হলেও রহস্যজনক কারণে এ কলটি বন্ধ করায় বিক্ষুব্ধ এলাকার হাজার হাজার আখচাষীসহ সাধারণ মানুষ।  

গত তিন বছর বন্ধ থাকায় ৩৫ একর আয়তনের কারখানার চত্বর ভরে গেছে জঙ্গলে। এই দৃশ্য দেখলে মানুষের সরব উপস্থিতির অভাব নিশ্চিত হওয়া যায় খুব সহজে। খোলা আকাশের নীচে অযতœ-অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলোও ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যটাও একই রকম। কোটি কোটি টাকা মুল্যের যন্ত্রপাতিতে এখন মরিচার রাজত্ব। থমকে আছে জীবিকার চাকাগুলো। আখচাষী আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্যদিনের সমাবেশের চিরচেনা দৃশ্য আর নেই। হাজারো মানুষের একসময়ের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশপথ ও মিলে আখ সরবরাহের জন্য শত শত সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণটি এখন গো-চারণভূমি। 

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহুকুমার গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জে শুরু হয় রংপুর চিনিকলের নির্মাণ কাজ। ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছর পর শেষ হয় মিলটির নির্মাণ কাজ। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম থেকেই আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন শুরু হয় মিলটিতে। পশ্চিম জার্মানী‘র বাকাউ-উলফ নামের একটি কোম্পানী থেকে আনা মেশিনে ৩৫ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠে মিলের কারখানা ও কার্যালয়। ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রংপুর চিনিকলসহ সকল চিনিকলকে রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করেন।

এ চিনিকলের কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। পুকুরসহ রেলওয়ে সাইডিংয়ের জায়গা ৮ একর, সাড়ে ১৪ একর জায়গায় গড়ে ওঠে ৫০টি ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্র এবং ৮টি সাবজোন। এছাড়াও মিলের নিজস্ব খামারের জমির পরিমাণ ১ হাজার ৮৩২ একর। ১৯৫৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩ বছরে ২২ হাজার ৯৮৫ দিনের মধ্যে ৫ হাজার ৭৩৯ দিন ঘোরে মিলের চাকা। এ সময়কালে ৫৬ লক্ষ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে উৎপাদন করা হয় ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চিনি।

রংপুর চিনিকলের ছিল নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এখানকার পাওয়ার হাউজে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হতো। চিনিকলের আখ পরিবহনের জন্য ছিলো নিজস্ব রেলপথ। সেই রেলপথে নিজস্ব রেলের ইঞ্জিন ও মালবাহী বগি দিয়ে পরিবহণ করা হতো আখ, চিনি, চিটাগুড় ও জ¦ালানীসহ নানা দ্রব্য।

রংপুর চিনিকলকে ঘিরে জাঁকজমক ছিলো মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশন। বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে মহিমাগঞ্জ। শিক্ষার প্রসারেও অন্যতম ভূমিকা রাখে রংপুর চিনিকল উচ্চ বিদ্যালয়। সবকিছু মিলিয়ে চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষীসহ অসংখ্য মানুষের আয়-রোজগারের পথ সৃষ্টি করেছিল রংপুর চিনিকল। 

চিনিকল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে তৎকালীন এরশাদ সরকারের শাসনামলে আধুনিকায়ণের নামে কর্মকর্তাদের জন্য দামী গাড়ি-বাড়ি, এ্যাম্বুলেন্স ও কারখানার কিছু সংস্কারের জন্য বিশ^ ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়া হয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার আওতাধীন চিনিকলগুলোকে। এসব ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনিকলগুলোর। রংপুর চিনিকলের বর্তমানে  ৫ শ’ কোটি টাকা পুঞ্জিভূত লোকসানের  প্রধান কারণ বিশ^ ব্যাংকের এই ঋণ বলে অভিযোগ করেছেন তারা।

রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ইনচার্জ) মাসুমা আকতার জাহান জানান, চালু অবস্থায় এ চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য বেতনভাতা বাবদ মাসে প্রায় এক কোটি টাকা প্রয়োজন হতো। সরকারি সিদ্ধান্তে মাড়াই বন্ধ হওয়া এ চিনিকলের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষায় বর্তমানে ৭ জন স্থায়ী কর্মকর্তা ও ৭৫ জন অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীর বেতনভাতা ১৮ লাখ টাকা।

রংপুর চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ফারুক হোসেন ফটু জানান, দেশের কৃষক-শ্রমিকদের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে রাষ্ট্রায়াত্ব চিনিশিল্প বন্ধ করে দেয়ার গভীর চক্রান্ত চলছে। চিনিকলটি বন্ধ হয়ে থাকায় এই জনপদের সকল স্তরে অন্ধকার নেমে এসেছে। কৃষক ও শ্রমিকবান্ধব বর্তমান সরকার অসাধু সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের এই জাল ছিন্ন করে পূনরায় চিনিকলটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে চালু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমরা বিশ^াস করি।

মিলস গেট সাবজোনের আখচাষী ফেরদৌস আলম অভিযোগ করে বলেন, রংপুর চিনিকলের চাইতে অনেক কম মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন জয়পুরহাট চিনিকলের আখ জোন এলাকায় আখও উৎপাদন হয় কয়েক গুণ কম। তারপরও ওই মিলটি চালু রেখে ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের রংপুর চিনিকলের আখ এবং ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের শ্যামপুর চিনিকলের আখ জয়পুরহাটে পরিবহণ করতে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। জয়পুরহাট ও শ্যামপুরের মধ্যবর্তী স্থানের রংপুর চিনিকলটি চালু রাখলে সরকারকে এই অতিরিক্ত টাকা ব্যায় করতে হ’তোনা। 

স্থানীয় আখচাষীরা অভিযোগ করেন, চলতি মৌসুমেও বন্ধ হয়ে থাকা রংপুর চিনিকল এলাকায় ৫শ’ একর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। পক্ষান্তরে চালু জয়পুরহাট চিনিকল এলাকায় চাষ হয়েছে মাত্র দেড় হাজার একর। এই দুই হাজার একর জমির আখে মাড়াই মৌসুমের স্থায়ীত্ব হবে সবোচ্চ ২০ দিন। অথচ বন্ধ হওয়ার সময় রংপুর চিনিকল এলাকার সাড়ে পাঁচ হাজার জমিতে দন্ডায়মান আখ ছিল।  

অভিজ্ঞ মহলের দাবি- বেসরকারি চিনিকল মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করতেইদেশের বৃহৎ ছয়টি শ্রেণীর কল বন্ধ করেছে সরকার। খুচরা বাজারে চিনির মূল্য যগন প্রতি কেজি ৪৮ টাকা থেকে ৫২ টাকা ছিল। ঠিক সেই সময় আকষ্মিকভাবে সরকার ৬টি চিনিকলে মাড়াই বন্ধ ঘোষণা করেন। এরপরেই খুচরা বাজারে চিনির দাম প্রায় তিনগুণ বাড়ানো হয়।
 

চিনিশিল্প রক্ষার পাশাপাশি বন্যা-ভাঙ্গনসহ নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিপর্যস্ত অভাবী জনপদ গাইবান্ধার মানুষকে বাঁচাতে দ্রæত এই চিনিকলসহ বন্ধ সকল চিনিকল চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন এই এলাকার কৃষক ও শ্রমিক-কর্মচারীসহ সকল স্তরের মানুষ।

 

একুশে সংবাদ/বিএইচ 

Link copied!