ট্রান্স নারীদের জন্য নিজেদের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এখনো এই সমাজে এক অসম লড়াই। সমাজের চোখে তারা এখনো ‘পুরুষ থেকে নারী’, যা অনেকের কাছে ‘অস্বাভাবিক’ মনে হয়। এই সমাজের প্রতিটি ধাপে তাদের মোকাবিলা করতে হয় অবজ্ঞা, অপমান ও বৈষম্যের। এমনই এক সংগ্রামী ট্রান্স নারীর নাম রামিসা—যিনি রমজান আলী নাম নিয়ে জন্মালেও এখন নিজেকে পরিচয় দেন একজন পূর্ণ নারীরূপে।
৫ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ রামিসা ছোটবেলা থেকেই নিজেকে অন্যরকম অনুভব করতেন। মেয়েদের পোশাক, আচরণ,সাজসজ্জা—সবকিছুই যেন তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করত। বোনের জন্য আনা নতুন জামা লুকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কল্পনা করতেন এক নারীর রূপে।

তবে তার এই পরিচয়ের পথটা ছিল কাঁটায় ভরা। পরিবারে মা ছাড়া কেউ তাকে মেনে নেননি। বাবাও একসময় সংসার ছেড়ে চলে যান—শুধু এই ভয়েই যে সমাজ তাকে “হিজড়ার বাবা” বলে চিনবে। বাকি ভাইবোনরাও ধীরে ধীরে তাকে দূরে সরিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত কেবল মায়ের সাথেই থেকে বড় হন রামিসা।
তবে সমাজ তাকে যতই “হিজড়া” বলে আখ্যায়িত করুক, রামিসার দাবি স্পষ্ট: “আমি হিজড়া নই, আমি একজন ট্রান্স নারী। এই পরিচয়েই আমি বাঁচতে চাই।”
আজ ২২ বছর বয়সী রামিসা শুধু নামেই নয়, কর্মেও প্রতিষ্ঠিত। অভিনয়, নাচ, কণ্ঠসংগীত—সব কিছুতেই তার সাবলীল বিচরণ। বিশেষ করে নজরুল সংগীতে পারদর্শী এই তরুণী পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার গানের কণ্ঠ ছুঁয়ে গেছে বহু মানুষের মন।
রামিসার ইচ্ছা, শিক্ষা জীবন শেষ করার পর তিনি তার অফিসিয়াল নাম—রমজান আলী—পরিবর্তন করে ‘রামিসা’ করে নিবেন। কারণ তার ভাষায়, “আমি যেভাবে নিজেকে দেখি, সেভাবেই সমাজ আমাকে চিনুক।”
রামিসার গল্প কেবল একজন ট্রান্স নারীর আত্মপ্রকাশের নয়, বরং সমাজের বিরুদ্ধে এক সাহসী লড়াইয়ের দলিল। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, পরিচয়ের লড়াই যত কঠিনই হোক না কেন, নিজের স্বরূপে বাঁচার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই।
অন্যদিকে, ট্রান্স পুরুষদের নারীত্ব থেকে পুরুষত্বে রূপান্তর সামাজিকভাবে আরও বেশি অদৃশ্য বা উপেক্ষিত। সংসার সমাজ ও পরিবার তাদের জন্য নরকের মত হয়ে ওঠে। এদের কাউকে পছন্দ থাকলেও জীবন কাটে বিষন্নতা আর একাকিত্বে
এদিকে জাতীয় পরিচয়পত্রে লিঙ্গ পরিবর্তনের আইনি সুযোগ থাকলেও বাস্তবে সেটা করতে গিয়ে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়।লিঙ্গ পরিচয়ের বৈচিত্র্য স্বীকৃতি পেলেও, নারী ট্রান্স ও পুরুষ ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের জীবনে বৈষম্য, অবহেলা ও অনিশ্চয়তা এখনও প্রতিদিনের বাস্তবতা।
তবে,বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রান্সজেন্ডার নারী ও পুরুষদের চ্যালেঞ্জগুলো আলাদা হলেও তাদের মুখ্য সমস্যাগুলো ঘিরে আছে পরিচয় সংকট, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাব, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যসেবা।
শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য; ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে হয়রানির শিকার হন, ফলে অনেকেই শিক্ষা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। চাকরির ক্ষেত্রে তারা প্রায়শই বঞ্চনার শিকার হন—কারণ নিয়োগদাতারা ট্রান্স পরিচয়কে গ্রহণ করতে চান না।
বিশেষত পুরুষ ট্রান্স ব্যক্তিরা অনেক সময় ‘নারী শরীরে পুরুষ’ হিসেবে দেখায়, যা নিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে।
স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক চাপ; হরমোন থেরাপি বা জেন্ডার রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি করতে গিয়ে ট্রান্স ব্যক্তিদের সঠিক ও সম্মানজনক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া কঠিন। চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা কম থাকায় অনেকেই হয়রানির শিকার হন।এছাড়া, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, পরিচয় নিয়ে লজ্জা ও চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আইনি সুরক্ষা ও সহানুভূতির অভাব; ট্রান্স নারীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হলেও প্রচলিত নারী সুরক্ষা আইন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। আবার ট্রান্স পুরুষদের ক্ষেত্রে লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে পুলিশের সহযোগিতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
আশার আলো; বিভিন্ন এনজিও ও ট্রান্স অধিকারকর্মীরা এখন এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ, কাউন্সেলিং এবং সচেতনতা তৈরি করছে। কিছু ট্রান্স ব্যক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসছেন এবং সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছেন।
সারসংক্ষেপ: ট্রান্স নারী থেকে পুরুষ হওয়া শুধুমাত্র শারীরিক পরিবর্তনের বিষয় নয়—এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি মানসিক, সামাজিক ও আইনগত লড়াই।
যেখানে শারীরিক পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মেডিক্যাল সিস্টেম ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকে, সেখানে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাব তাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
নারী ও পুরুষ ট্রান্সজেন্ডারদের জীবনমান উন্নয়নে শুধু আইনি স্বীকৃতি নয়, প্রয়োজন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে বাস্তব সমতা।
একুশে সংবাদ/এ.জে