AB Bank
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

থামছে না সোনা চোরাচালান


Ekushey Sangbad
হাসান কাজল
১০:৩৮ পিএম, ১৩ মে, ২০২৪
থামছে না সোনা চোরাচালান

  • দুই বিমানবন্দরে বড় সোনা চোরাচালান আসে
  • বাংলাদেশ ব্যাংক ও জুয়েলারি সমিতির তথ্যে অমিল
  • দেশে এক বছরে সোনার চাহিদা প্রায় ২০ থেকে ৩০ টন

১১মে ২০২৪ চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওয়াশরুমে ময়লা ফেলার ঝুড়ি থেকে সাতটি স্বর্ণের বার উদ্ধার করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। উড়োজাহাজের সিট-টয়লেট, বিমানবন্দরের ডাস্টবিন, গোডাউন, যাত্রীর পকেট-শরীর, জুতা,জামায়, সীমান্তের ধানক্ষেত, প্রাইভেট কারে, তরুণীর গোপন অঙ্গে, বাজারের ব্যাগে, মরা মানুষের শরীরে, মোটরসাইকেল, ইজি বাইক, এমন কোনো জায়গা নেই যেখান থেকে স্বর্ণের চোরাচালান আটক করে না বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রতিনিয়ত বিমানবন্দর বা সীমান্তে ধরা পড়ছে  সোনার চোরাচালান। দেশটা যখন একটা ভিন্নমাত্রার সোনার খনি।

এসব সোনাচোরাচালানে জড়িত থাকার বিস্তর প্রমাণ পাওয়া গেছে বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউ এস বাংলা এয়ারলাইনসের নামে। বড় সোনা চোরাচালান আসে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ও  হযরত শাহজালাল আন্তরর্জাতিক বিমান বন্দর হয়ে। দেশে বৈধভাবে ট্যাক্স দিয়ে আনা স্বর্ণের পরিমাণ খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, 

২০১৯-এর শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে সোনা আমদানি হয়েছে মাত্র ১৪৮ কেজির মতো। অথচ বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে এক বছরে সোনার চাহিদা প্রায় ২০ থেকে ৩০ টন। তাহলে বাকি সোনার চাহিদা কীভাবে মেটানো হয়?

১৫ মার্চ ২০২৪ চট্টগ্রামে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রফিকুল ইসলাম নামে এক যাত্রীর জুতা, ব্যাগ ও গায়ের পোশাক থেকে ১ কেজি ২২০ গ্রাম ওজনের ৩২টি সোনার চুড়ি উদ্ধার করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ২২ ক্যারেটের এসব স্বর্ণের ওজন ১ কেজি ২২০ গ্রাম। উদ্ধার করা স্বর্ণের বাজার মূল্য ১ কোটি ২২ লাখ টাকা। ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ প্রায় ৫ কোটি টাকার সোনার বারসহ সোনা চোরাচালান চক্রের এক সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ । ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৯ মার্চ ২০২৪ যশোরের শার্শার বেনাপোল পোর্ট থানার পুটখালী সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের সময় ৭০০ গ্রাম ওজনের সোনার বার উদ্ধার করা হয়। যার বাজার মূল্য আনুমানিক ৭০ লাখ টাকা।

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ যশোরে প্রাইভেটকারের বডি থেকে প্রায় নয় কেজি ওজনের ৬০টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। যশোরের ৪৯ বিজিবি ও খুলনার ২১ বিজিবি যৌথ অভিযান চালিয়ে প্রাইভেটকারসহ এই সোনা জব্দ করে। জব্দ করা সোনার মূল্য ৮ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ নিয়ে খুলনা সেক্টরের দুই ব্যাটালিয়ন এক বছরে ৪৫টি অভিযানে ১৬৩ কেজি সোনা জব্দ করে। এই সোনার বাজার মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ২৮ এপ্রিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এপিবিএনের অভিযানে এক কেজি সোনাসহ একজনকে আটক করা হয় । ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ উদ্ধার করা হয় ২৯ লাখ টাকার সোনা’।

বাংলদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েন বাংলাদেশি তরুণী নাজনীন নাহার। তার স্পর্শকাতর জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল সোনার বিস্কুট। আগেও সে ভারত থেকে চকলেট, বিস্কুটসহ নানা জিনিস পাচার করেছে বাংলাদেশে। তিনি বিবাহিত তরুণী। রাজধানী ঢাকায় ভুঁইয়াপাড়ার খিলগাঁওয়ে তার বাড়ি। বিএসএফের জেরায় সে জানায়, 

বাংলাদেশের বেনাপোল বাজারে আবিদুলের কাছ থেকে সে ওই সোনা নিয়ে ভারতের কলকাতায় নতুন বাজারে একজনের হাতে পাচার করার কথা ছিল। এই সোনা পাচার করতে পারলে ৬ হাজার টাকা কমিশন পেত সে।  ১৬ নভেম্বর ২০২৩ এ বিজিবি সূত্র জানায়, চৌগাছা সীমান্তে ১১ মাসে ৪৭ কেজি সোনা উদ্ধার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা। আটক ও উদ্ধারকৃত সোনার ওজন প্রায় ৪৭ কেজি  যার বাজার মূল্য প্রায় ৩৮ কোটি টাকা।

১৩ মার্চ২০২৪ বেনাপোল সীমান্তের ইছামতী নদীতে ৫ কেজি সোনাসহ এক পাচারকারীর মরদেহ উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ সদস্যরা। ১৮ মে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের কার্গো হোলে মেলে ২৫ কোটি টাকার স্বর্ণ।

এছাড়া সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি উড়োজাহাজ প্রতিষ্ঠান ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস লিমিটেড এর বিরুদ্ধে। সংস্থাটির উড়োজাহাজ থেকে দফায় দফায় চোরাচালানের সোনা উদ্ধার করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

চোরাচালানে জড়িত থাকার কথা আদালতে স্বীকার করেছেন এয়ারলাইনসটির কর্মীরা। কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, 

 

মাসকাট থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইট থেকে ৭ কেজি ২৯০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউস। এর বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। এর আগে ১১ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস থেকে ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ৩১ জুলাই একই বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার যাত্রী বহনকারী গাড়ির চালকের কাছ থেকে ৩ কেজি ৭১২ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে কাস্টমস, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা।

২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর ১৭ লাখ টাকা মূল্যের তিনটি সোনার বারসহ আটক হন ইউএস-বাংলার কর্মী। তার আগে ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রূ রোকেয়া শেখ মৌসুমী। একই বছরের ২০ এপ্রিল প্রায় ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৪ কেজি সোনা জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা ।

কাস্টমস সূত্র জানান, 

২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকার সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউসের প্রিভেনটিভ টিম। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নম্বর বিএস৩১৬-এর যাত্রী অবতরণের সিঁড়ির নিচে ৪০টি সোনার বার পাওয়া যায়। একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১০ কেজি সোনার বারসহ গ্রেফতার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু রোকেয়া শেখ মৌসুমী।

২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১৪ কেজি সোনা জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা।  ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম সমান সোনার বার উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টম হাউসের প্রিভেনটিভ টিম। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর শাহজালাল বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট থেকে ৪ কেজি ৬৬৫ গ্রাম সমান সোনার বার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা। এয়ারলাইনসের (ফ্লাইট নম্বর বিএস২০২) থেকে ওই সোনা উদ্ধার করা হয়। এর বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ০২ অক্টোবর ২০২০ , ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকার সোনা উদ্ধার’ চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা এক যাত্রীর কাছ থেকে ৮২টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়েছে। সাড়ে ৯ কেজি ওজনের এই সোনার দাম চলতি বাজার মূল্যে ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকায় হাতে-নাতে ধরা পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরা। সম্প্রতি 

চোরাচালানে ব্যবহার হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির দু’টি উড়োজাহাজ জব্দও করেছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। এরপরও কর্মীদের চোরাচালানে জড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কোন উদ্যোগ নেই  বিমানের।  

সংশ্রিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, বিভিন্ন সময়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কর্মীরা সোনাসহ আটক হয়েছেন। উড়োজাহাজের সিটের নিচে, টয়লেটে থেকে সোনা উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া, বিমানের নিয়ন্ত্রণাধীন হ্যাঙ্গার কমপ্রেক্স, আমদানি-রফতানি কার্গো ভিলেজ ও বিমানবন্দরে অবস্থিত বিমানের অফিস থেকেও একাধিকবার সোনা উদ্ধার করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর, ও বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ। ২৮ ডিসেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে ৬৪ কেজি সোনা উদ্ধার করেছে ঢাকা কাস্টমস হাউস।  ২৩ নভেম্বর ৭ কেজি ১৯০ গ্রাম সোনাসহ বিমানকর্মীকে আটক করে ঢাকা কাস্টমস হাউস।

১৩ নভেম্বর আবুধাবি থেকে আসা বিমানের একটি  উড়োজাহাজ থেকে ৮ কেজি ৮০০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। উড়োজাহাজটির সিটের নিচের পাইপের মধ্যে এসব সোনা লুকানো ছিল। এঘটনায়ও উড়োজাহাজটি জব্দ করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। ১৩ জুলাই শাহজালাল বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার গেটের কাছ থেকে বিমানের  ট্রাফিক হেল্পার এমদাদ হোসেন চৌধুরী ও তার সহযোগী আব্দুর রহিমকে ৪ কেজি সোনাসহ আটক করেন বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের সদস্যরা।  একটি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে সোনা চোরাচালানের দায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে ঢাকা কাস্টমস হাউস।

বিমানবন্দরে সোনা চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত  সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে।

২০১৩ সালের ২৪ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সোনা চোরাচালান আটক করা হয়। 

এদিন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজের কার্গো হোল্ড থেকে ১২৪ কেজি সোনা জব্দ করা হয়। উদ্ধারের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। তদন্ত শেষে ওই বছর বিমানের ১০ কর্মীসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত ১০ বছরেও এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি। আসামিরাও বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।

২০১৪ সালেও বিমানের এক ফ্লাইটের টয়লেটে লুকিয়ে রাখা ১০৬ কেজি সোনা জব্দ করা হয়। এটা ছিল জব্দ হওয়া দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনার চালান। এ ঘটনার ৩ বছর পর আদালতে চার্জশিট জমা দেয় ডিবি। তবে এখনও শাস্তি হয়নি কারও। শুধু এই দুটি নয়, নিম্ন আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় সোনা জব্দের ঘটনায় হওয়া ১৮৭টি মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

দেশে স্বর্ণ আসার প্রক্রিয়া জানতে বাংলাদেশ সহ কয়েকটি দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ী, ব্রোকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একাধিক বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অল্পকিছু সোনা বৈধভাবে আমদানি করে। বাকি সব সোনা আসে অবৈধ উপায়ে পাচার হয়ে। এই সোনা  ভাগ হয়ে অর্ধেক দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও বাকি অর্ধেক চলে যায় ভারতে।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সোনা চোরাচালানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে এ দেশের সোনার দামের তারতম্য রয়েছে। চোরাচালানের মাধ্যমে সোনা আনলে অনেক বেশি লাভ করা যায়। তাই দিন দিন চোরাচালান বাড়ছে। নীতিগত জায়গায় পরিবর্তন না আনলে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। গত ১২ জুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডাস্টবিন থেকে সাত কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। আটক করা হয় একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, 

দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো দুবাই ও সৌদি আরবের স্বর্ণের দোকানগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে। তারা স্বর্ণের বারগুলো বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য নিজেদের ব্রোকারকে দিয়ে বাহক খুজেঁ আনে। এসব বাহকদের বেশিরভাগ প্রবাসী শ্রমিক ও পেশাদার বহণকারী। তারা  প্রতিটা বার বহনকরে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে পায়।

দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশথেকে আসা সোনার বারগুলো প্রধানত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশে আসে। যেসব বাংলাদেশি স্বর্ণ বহন করে পাঠানোর জায়গা থেকেই থেকেই তাদের ও তাদের একজন স্বজনের ফোন নম্বর, পাসপোর্টের কপি, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, এনআইডির ফটোকপি রেখে দেয়। সোনার বাহক প্লেন থেকে নেমেই  যান কাস্টম কর্তৃপক্ষের কাউন্টারে। সেখানে গিয়ে বারের ট্যাক্স দিয়ে রসিদ গ্রহণ করে। বারগুলো বৈধ হয়ে গেলেই  বাংলাদেশি ডিলারের প্রতিনিধি বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকা থেকে রশিদসহ স্বর্ণ বুঝে নেন।

অবৈধভাবে কতটুকু সোনা দেশে আসে এ বিষয়ে কোনো হিসাব নেই বিমানবন্দরে কর্মরত কোনো সংস্থার কাছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছে, দেশে যারা বৈধভাবে কর দিয়ে সোনা আমদানি করে তারাই আবার লুকিয়ে অতিরিক্ত বার নিয়ে আসে। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে বা ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকলে তারা বিমানবন্দরে সোনা ফেলে রেখে চলে যায়। জানা গেছে,অধিকাংশ মামলায় চোরাচালানের মূলহোতাকে পাওয়া যায় না। বিমানবন্দর থেকে সোনাসহ গ্রেপ্তার হয় বাহক ।

সোনা চোরাচালানের সাথে নিয়মিতভাবে যারা জড়িত তারা স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায, ব্যবসায়ীরা সোনার বার আনার জন্য চুক্তি করার পর প্রতি ফ্লাইটে কমপক্ষে ১৫-২০ জন বাহককে  টার্গেট করে সোনার বার দেওয়া হয়। যে ফ্লাইটে ১৫ জনকে টার্গেট করা হয় সেখানে ১২ জনকে  বৈধ পরিমান বার এবং করের টাকা দেওয়া হয়। বাকিদের কাছে দেওয়া হয় সোনার বড় চালান। অবৈধ বহণকারীদের কাছে ১০ থেকে ১৫টি ও অভিজ্ঞদের বেলায় আরও বেশি করে বার দেওয়া হয়। এসব যাত্রীরা এয়ারপোর্ট নেমে আগে কাস্টম কাউন্টারে গিয়ে ট্যাক্স জমা দিয়ে বার বৈধ করে নেয়। অবৈধ বারগুলো শরীরে বা মালপত্রের সঙ্গে গোপন করে নিয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ট্যাক্স দেওয়ার পর তাদের আর তল্লাশি করা হয় না। ট্যাক্স দিয়ে তারা সাধারণ যাত্রীদের মতো গ্রিন চ্যানেল হয়ে বেরিয়ে যায় এবং এজেন্টের কাছে সোনা পৌঁছে দেয়।

বাংলাদেশ কাস্টম হাউসের ব্যাগেজ রুল (সংশোধিত ২০২৩-২৪) অনুযায়ী, 

একজন ব্যক্তি বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ ১১৭ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণের বার আনতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট বাহককে বিমানবন্দরে নামার আগে প্লেনে দেওয়া নির্দিষ্ট ফরমে স্বর্ণের বার থাকার ঘোষণা দিয়ে  বিমানবন্দরে নেমে  ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয়। প্রতি ১১ দশমিক ৬৭ গ্রাম বা এক ভরির জন্য ৪ হাজার করে প্রতিটি বারের জন্য ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স । দুটি বারের বেশি স্বর্ণ আনলে সেটি জব্দ করে বহনকারীকে আটক রসিদ দেয় কাস্টম কর্তৃপক্ষ। জব্দকৃত স্বর্ণের বার পরবর্তীতে আমদানি ও রপ্তানি তবে এ ক্ষেত্রে স্বর্ণের একটি বারের জন্য সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা করা যায়।

এভাবে বৈধভাবে ট্যাক্স দিয়ে আনা স্বর্ণের পরিমাণ খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-এর শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে সোনা আমদানি হয়েছে মাত্র ১৪৮ কেজির মতো। অথচ বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে এক বছরে সোনার চাহিদা প্রায় ২০ থেকে ৩০ টন। তাহলে বাকি সোনার চাহিদা কীভাবে মেটানো হয়? এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেন না স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। তারা নানা রকম গল্প বলেন। চোরাচালানের সোনা কাজে লাগানো হয় কি না, এ বিষয়েও কোনো মন্তব্য নেই তাদের।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মতে, বিদেশ থেকে স্বর্ণ দেশে আসার পর মূলত দুটি জায়গায় যায়। প্রথমত, বাংলাদেশের সোনা ব্যবসায়ীরা এটা কিনে নেন। দ্বিতীয়ত, ভারতে পাচার করা হয়। বিশ্বে স্বর্ণের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা দেশ ভারত। দেশটি প্রতি বছর বৈধ পথেই প্রায় ৭০০ টন সোনা আমদানি করে।

বাংলাদেশের সোনা ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতের সোনা আমদানির প্রধান উৎস দুবাই। কিন্তু দুবাই থেকে আনতে যে খরচ তার চেয়ে অনেক কমে বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ কিনতে পারে তারা। দুবাই থেকে ভারতে সোনা আমদানি করতে শুল্ক, ইনস্যুরেন্স, ভাড়া ও করসহ প্রতি ভরিতে খরচ হয় প্রায় ৭ হাজার টাকা। বাংলাদেশে ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনা আনলে ভরিপ্রতি কর মাত্র ৪ হাজার টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ ভরিতে সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। এ কারণে বাংলাদেশি যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করে স্বর্ণ কিনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ভারতীয়রা।

সোনা আমদানির অনুমতিপ্রাপ্ত একজন ব্যবসায়ীকে বৈধভাবে সোনা আনতে হলে প্রথমত এলসি খুলতে হয়। এরপর সোনার ক্রয়মূল্য, আমদানি শুল্ক, ইন্স্যুরেন্স ফি, ফ্রেইট চার্জ, এলসির কমিশনসহ সবমিলিয়ে প্রতি ভরিতে প্রায় সাড়ে চার থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। একটি বার (১০০ গ্রাম ওজন) আনলে ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। কিন্তু ব্যাগেজ রুলসের আওতায় প্রতি ভরি সোনা আনার খরচ ৪ হাজার টাকা। পাশাপাশি ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালংকার আনতে কোনো শুল্ক লাগে না। এ কারণে ব্যাগেজ রুলে স্বর্ণ আনতে আগ্রহী ব্যবসায়ীরা।

স্বর্ণ চোরাচালান একটা লাভজনক বিষয়। স্বর্ণ বৈধভাবে আনলে মোটা অঙ্কের ট্যাক্স লাগে। সেই ট্যাক্সটা ফাঁকি দেওয়ার জন্য নিয়মিত চোরাচালান হয়। খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশ সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার দেশে ব্যবহারের জন্যও আসে। সবমিলিয়ে এটা লাভজনক; তাই এত সোনা উদ্ধারের পরও চোরাচালান ঠেকানো যাচ্ছে না।

বিজিবির হিসাব অনুযায়ী, 

সীমান্তে গত চার বছরে প্রায় ৪০০ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সীমান্তে স্বর্ণ চোরাচালানসহ যেকোনো ধরনের অপরাধ মোকাবিলায় বিজিবির সক্ষমতা রয়েছে বলে জানান একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা । একটি আধুনিক বাহিনী হিসেবে বিজিবি হেলিকপ্টার, স্পিডবোট, টহলের জন্য অত্যাধুনিক বাহন, ডগ স্কোয়াড, সার্ভেইলেন্স সরঞ্জামসহ অন্যান্য অনেক অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও আধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিজিবি।


একুশে সংবাদ/হ.ক.প্র/জাহা

 

Link copied!