কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের পুরো সময়ে দেশে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গোল উল্লাস , ফুটবল নিয়ে তর্ক-বিতর্কের জেরে সংঘর্ষ, পতাকা টানাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে কিংবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, খেলা দেখার সময় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশজুড়ে ১৩ জন মারা গেছেন। মৃতদের বেশির ভাগই কিশোর ও তরুণ।
এদিকে ফুটবল নিয়ে তর্ক-বিতর্কের জেরে বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে এ পর্যন্ত আহত হয়েছেন অন্তত ২৯ জন। হতাহতদের সবাই বিশ্ব ফুটবলের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থক।

বিশ্বকাপকে ঘিরে ৩ জেলায় খুন হয়েছেন ৩ জন। খেলার উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। সমর্থন করা দলের পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ও ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছেন ৭ জন। সর্বশেষ গোল উদযাপন করতে যেয়ে মারা গেছেন ১ জন। এ ছাড়া ৫ জেলার সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ২৯ জন।
এ ছাড়া খেলাকে কেন্দ্র করে লালমনিরহাট, ভোলাসহ ছয়টি জেলায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও মারামারি হয়েছে।
৩ জেলায় ৩ খুন
বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে তর্কবিতর্কের জেরে ঢাকার সাভারে এবং হবিগঞ্জের বাহুবলে দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ব্রাজিল বনাম ক্রোয়েশিয়ার মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের পর। সাভরের নিহত ঐ তরুণের নাম হাসান মিয়া (২৬)। ঐ ম্যাচের রাতেই বাহুবলে ছেলের ঝড়গার জেরে শহীদ মিয়া নামের এক ব্যাক্তি খুন হয়েছেন। গত ৬ ডিসেম্বর ভোলায় সংঘর্ষে মো. হৃদয় (২০) নামের এক তরুণ নিহত হন।

পতাকা টাঙাতে গিয়ে মৃত্যু ৭ জনের মৃত্যু
প্রতি বিশ্বকাপের মত এবারও প্রিয় দলের পতাকা টাঙাতে গিয়ে দেশের ৭ জেলায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন মারা গেছেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আর একজনের মৃত্যু হয়েছে ছাদ থেকে পড়ে। মারা যাওয়া ৭ ব্যক্তি কুষ্টিয়ার কুমারখালী, নওগাঁর ধামইরহাট, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, টাঙ্গাইলের সখীপুর, খাগড়াছড়ি সদর, কক্সবাজার সদর, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার।
খেলার উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে মৃত্যু
সংঘর্ষ, দুর্ঘটনার বাইরেও খেলার উত্তেজনা, উচ্ছ্বাসে অসুস্থ হয়ে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফরিদপুর ও নেত্রকোনা জেলার এই দুই ব্যক্তি আর্জেন্টিনার সমর্থক ছিলেন।

গোল উৎসব করতে গিয়ে সমর্থকের মৃত্যু
সর্বশেষ ফাইনালের দিন আর্জেন্টিনার গোলে উল্লাস করতে গিয়ে যশোরের ঝিকরগাছায় নিমার্ণাধীন সেতুর রডে বিদ্ধ হয়ে রাকিব হোসেন (২৫) নামে এক সমর্থকের মৃত্যু হয়।
৫ জেলার সংঘর্ষে আহত ২৯
বিশ্বকাপের উত্তাপ চায়ের দোকানের তর্ক আর সামাজিক মাধ্যমের খুনসুটি পেরিয়ে সরাসরি সংঘাতও সৃষ্টি করেছে। ঢাকার সাভারে এবং গোপালগঞ্জ সদরে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকেরা সংঘর্ষে জড়ান। এতে সাভারে ২ জন এবং গোপলগঞ্জে ৬ জন আহত হয়। লালমনিরহাট সদরে আর্জেন্টিনার পতাকা চুরি হওয়ার ঘটনায় ব্রাজিল সমর্থকদের সঙ্গে দলটির সমর্থকদের বাগ্বিতণ্ডার পর সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ১১ জন আহত হন। ভোলা সদরে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের দুপক্ষের মধ্যে যে সংঘর্ষে ৮ জন আহত হয়। সর্বশেষ মারামারির ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীর রাজপাড়া থানায়। এ সময় দুজনকে পিটিয়ে আহত করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা কারণে মানুষের মধ্যে ধৈর্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা কমে যাওয়ায় এখন খেলার সমর্থনের মতো তুচ্ছ বিষয়ে মানুষ মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র, সমাজ এবং পারিবারিক পর্যায় থেকে নাগরিকদের জন্য বিশেষ করে তরুণদের জন্য বিনোদনের বিকল্প উৎস তৈরি করতে না পারায় তাঁরা এখন খেলা দেখাসংক্রান্ত বিষয়েই বুঁদ হয়ে থাকেন। এসব কারণেই বাগ্বিতণ্ডা থেকে মারামারি, এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে।’
সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নেহাল করিম বলেছেন, ‘আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা না থাকায় যে যেমন অন্যায়ই করুক না কেন, পার পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে সৃজনশীল কাজ, গঠনমূলক কাজ বা উৎপাদনমুখী কাজ করার বিষয়গুলো সেভাবে নেই। অফুরন্ত সময় হাতে থাকে বলেই মানুষ এ ধরনের কাজ করে।’ এই উন্মাদনা থেকে দূরে রাখতে তরুণদের উৎপাদনমুখী কাজে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
একুশে সংবাদ/এসএপি