হটাৎ রাজধানী থেকে চিনি উধাও। সয়াবিন, লবণ, ডিম ও পেঁয়াজের পর এবার চিনির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দফায় দফায় চিনির দাম বাড়ানোর পরে এবার বাজারে চিনির সংকট সৃষ্টি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর, নিউমার্কেট, মহাখালী, মালিবাগ ও সেগুনবাগিচাসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে বেশিরভাগ দোকানে চিনি নেই। যদি কোনো দোকানে চিনি পাওয়া যায়, সেখান থেকে দেওয়া হচ্ছে চিনির সঙ্গে অন্য পণ্য কেনার শর্ত। এ ছাড়া চিনির দাম রাখা হচ্ছে রেকর্ডসম।
তিন দফায় বেড়ে খুচরা বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা পর্যন্ত। যা গেল সপ্তাহেও বিক্রি হতো ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। এর আগে গত ৬ অক্টোবর কেজিপ্রতি ছয় টাকা বাড়িয়ে চিনির দাম ৯০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার।
নাম ও দোকানের নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারওয়ান বাজারের এক মুদি দোকানের বিক্রয়কর্মী বলেন, ‘মনে হয় কোম্পানিগুলো চিনির দাম বাড়াবে। তাই চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।’
সত্যতা যাচাইয়ে বেশিরভাগ দোকানে ঘুরলে একই চিত্র দেখা গেছে। কারওয়ান বাজারে বেশির ভাগ দোকানে প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যায়নি। তবে দু-একটি পাওয়া গেলেও তা সহজে বিক্রি করছেন না ব্যবসায়ীরা। একটি দোকানে এসে এক ক্রেতা প্যাকেটজাত কিছু চিনি দেখে কিনতে চান। কিন্তু দোকানি জানিয়ে দেন, বিক্রি করা হবে না। একান্তই কিনতে বলে চিনির সঙ্গে নিতে হবে অন্য পণ্য। এ ছাড়া তদের নিয়মিত ক্রেতাদের কাছে চিনি বিক্রি করা হবে বলেও জানান ওই দোকানি।
পরে ওই ক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা একের পর এক পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। তেলের পর এবার চিনির বাজারেও সিন্ডিকেট করা হয়েছে। সরকারের তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
রাজধানীর নিউমার্কেটের দোকানদার শাহিনুর রহমান বলেন, ‘বাজারে চিনির সরবরাহ কমেছে। কোম্পানিগুলো প্যাকেটজাত চিনি সরবরাহ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। চিনির বাজারেও কারসাজি করা হচ্ছে।’
খুচরা ও পাইকারি চিনি ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘মিল মালিকরা চিনি মজুত করায় সংকট সৃষ্টি হয়েছে।’
তবে মিল মালিকরা বলছেন, ‘গ্যাস সংকটের কারণে চিনি পরিশোধনকারী কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দৈনিক ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার বেশি মিল চালানো যায় না। এতে কারও কারও উৎপাদন কমেছে এক-পঞ্চমাংশে। এ ছাড়া তাদের পরিবহনগুলোও গ্যাসের সমস্যায় ভুগছে।’
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আগে মিলগুলোতে ২৪ ঘণ্টাই গ্যাস পাওয়া যেত। কিন্তু এখন ৬ ঘণ্টাও মিলছে না। তাই দৈনিক চিনি সরবরাহ ৩ হাজার টন থেকে কমে ৫০০ থেকে ৫৫০ টনে নেমে এসেছে। গ্যাসের সমস্যায় মাঝপথে উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় তেল ও চিনি নষ্ট হচ্ছে।’
আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীরা জানান, ‘এলসি খোলার জটিলতায় আমদানি কমেছে। ডলার সংকটে আমদানি খরচ বেড়েছে। গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমেছে। সব মিলিয়েই বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।’
গত ২২ সেপ্টেম্বর বেসরকারি পর্যায়ে খোলা চিনির দাম কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৮৪ টাকা এবং মোড়কজাত সর্বোচ্চ ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ট্যারিফ কমিশন। যদিও এ বর্ধিত দাম মেনে নিতে পারেননি বেসরকারি মিলমালিকরা। অক্টোবরের শুরুতে নতুন করে চিনির দাম বাড়াতে ফের প্রস্তাব দেয় বেসরকারি মিলমালিকদের সংগঠন। এরই মধ্যে বেসরকারি মিলের চিনির মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে দেশের পাইকারি বাজারগুলোয় মণপ্রতি দাম ৪-৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়।
বিএসএফআইসি ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল চিনির দাম কেজিপ্রতি ৭০ টাকা থেকে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ টাকা নির্ধারণ করেছিল। সবশেষ ১০ আগস্ট বেসরকারি মিলমালিকদের অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে চিনির দাম পুনর্নির্ধারণের আবেদন করে। আবেদনের পরও দাম বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। এরপর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ফের আবেদন করলে ২২ সেপ্টেম্বর নতুন দাম নির্ধারণ করে দেয় ট্যারিফ কমিশন। ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে বর্ধিত মূল্যের চিনি বাজারে পাওয়া যাবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।
চট্টগ্রাম কাস্টমস’র তথ্যমতে, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মাত্র ১৭ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ২১ লাখ টন। এক বছরের ব্যবধানে চার লাখ টন চিনি কম আমদানি হওয়ায় সরবরাহ সংকটে পড়েছে বলে দাবি করছে দেশের প্রধান বেসরকারি রিফাইনারি মিলগুলো। পাশাপাশি দামও বেড়েছে।
বাংলাদেশ চিনি ডিলার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে চিনি আমদানিতে শুল্ক অনেক বেশি। বেসরকারি পর্যায়ে চিনির দাম বাড়িয়ে দেয়ার কারণে পাইকারি বাজারগুলোয় দাম ফের বাড়তে শুরু করেছে। তবে সরকারি মিলের চিনির দাম বাড়ানো না হলেও সরবরাহ খুবই কম। সরকারিভাবে সরবরাহ বাড়ানো হলে বেসরকারি খাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হবে। এক্ষেত্রে সরকারি মিল চালুর পাশাপাশি সরকারি চিনি আমদানি করে ডিলারের মাধ্যমে দেশব্যাপী সরবরাহ করা হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।’
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অপরিশোধিত চিনির কেজিপ্রতি দাম ছিল ৫৮ সেন্ট। ২০২০ সালে দাম ছিল ৫৯ সেন্ট। কিন্তু ২০২১ সালে চিনির কেজিপ্রতি দাম বেড়ে ৭৪ সেন্টে উঠে যায়। সর্বশেষ চলতি বছরের মে মাসে কেজিপ্রতি চিনির দাম সর্বোচ্চ ৮০ সেন্ট উঠে গেলেও জুনে ১ সেন্ট কমে ৭৯ সেন্টে নেমে আসে। জুলাইয়ে কেজিপ্রতি চিনির গড় দাম ছিল ৭৭ সেন্ট।
বিশ্বের প্রধান চিনি উৎপাদক ও রফতানিকারক দেশ ব্রাজিল। সম্প্রতি দেশটির উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গিয়েছে। যার কারণে রফতানিতে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করেছে দেশটি। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের কারণে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি উৎপাদন প্রবণতায় পাম অয়েলের পাশাপাশি চিনির ওপরও প্রভাব পড়েছে। ব্রাজিল আখ থেকে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি ইথানল দিয়ে বায়োডিজেল উৎপাদন করায় বিশ্বব্যাপী চিনির দাম বাড়ছে।
একুশে সংবাদ/এসএপি