AB Bank
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

এক স্বপ্নবাজ শিক্ষক শাহ-আফতাব উদ্দীন আহমদ: যাঁকে আজীবন শ্রদ্ধা করা যায়


এক স্বপ্নবাজ শিক্ষক শাহ-আফতাব উদ্দীন আহমদ: যাঁকে আজীবন শ্রদ্ধা করা যায়

ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয় যারা এই পৃথিবীতে নিজ কর্মে গুণান্বিত হয়ে স্বরনীয় বরণীয় হয়ে থাকেন অন্যদের মাঝে। শারীরিক ভাবে চিরকাল ওরা পৃথিবীতে না থাকলেও তাদের বিশাল কর্মময় স্বৃতিগুলো রয়ে যায় আজীবন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে।খ্যাতিমানদের যুগে যুগে মানুষ স্বরণ করেন, রেখে যাওয়া কর্মগুলো থেকেই নব প্রজন্ম আগামীর চলার পথে সুন্দর জীবন গঠনের উৎসাহ খুঁজেন। 

 

তেমনি একজন কালজয়ী মহাপুরুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়া তথা সারা বাংলাদেশের খ্যাতিমান সৎ ও ত্যাগী শিক্ষক মরহুম শাহ আফতাব উদ্দীন আহমেদকে নিয়ে লিখেছেন তারই প্রাক্তন ছাত্র-

 

★এখন থেকে পাঁচশত বছর আগেও গুরুগৃহের প্রচলন ছিল। যাঁদের কাছে শিক্ষা গ্রহণের জন্য রাজা-বাদশাহ, জমিদার অথবা স্বচ্ছল পরিবারের তরুণদের পাঠানো হতো। শুধু সমরবিদ্যা নয়, সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার জন্য। শৃঙ্খলা, নীতি পরায়ণতা, ধর্ম, ইতিহাস, গণিত ইত্যাদি শেখানো হতো। মহাভারতে পড়েছি দ্রোনাচার্যের কথা। যাকে নিযোগ দেয়া হয়েছিল কৌরব এবং পাণ্ডবদের সমরবিদ্যা এবং শৃঙ্খলা শেখানোর জন্য। তিনি নিজেই একজন প্রতিষ্ঠান। মুসলিম সন্তানরাও সেভাবেই উস্তাদগণের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতো একইভাবে। প্রাচীন গ্রীসেও দর্শন শিক্ষার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দার্শনিকদের কাছে আসতেন। সেই শিক্ষকগণের আশ্রমেই পড়াশোনা করতেন।

 

 আমাদের উপমহাদেশে টোল এর প্রচলনও ছিল, যেখানে সকল শ্রেণির শিশু-কিশোররা পড়াশোনার সুযোগ পেত, তারপর মুসলিম সন্তানরা মক্তব-মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতো। সেই শিক্ষকগণ শুধু জ্ঞান দান করেই তৃপ্ত থাকতেন।তারা পড়াতেন নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করার জন্যে, একটা চিন্তাশীল সমাজ ব্যবস্থা গড়ার জন্য, কোন প্রকার জাগতিক প্রাপ্তির জন্য নয়।

 

শাহ আফতাব উদ্দীন স্যার ছিলেন, দুই প্রজন্মের শিক্ষক এবং একজন জীবন্ত পাঠাগার।আফ্রিকাতে একটা প্রবাদ আছে- একজন জ্ঞানী বা বয়োবৃদ্ধের মৃত্যু হলে বলা হতো একটা পাঠাগার পুড়ে গেছে।আজ আমরা প্রজন্ম তৈরির গুরু কমই দেখতে পাই।প্রজন্মের শিক্ষকদের একটাই প্রাপ্তি ছিল সেটা ছিল অফুরন্ত সম্মান।তাঁদের প্রতি সমাজের যে শ্রদ্ধা ছিল সেটা আজ বিরল। শ্রদ্ধা আর ভালবাসাই তাঁদের পরিতৃপ্ত রাখতো।তাঁদের আর্থিক প্রাপ্তি খুবই নগণ্য।তারা সব দুঃখ-দুর্দশা তুলে নিঃস্বার্থভাবে নতুন প্রজন্মকে সামগ্রীক শিক্ষা দিতেন যা তরুণ মনের দরজা খুলে দিতো।

 

আমরা ৭০ দশকের শেষার্ধে স্কুলে যাই এবং ৮০ এর দশকে স্কুলের পড়া শেষ করেছি।আমাদের শিক্ষকগণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।তখন আফতাব উদ্দীন স্যার ছিলেন আমাদের অনেক শিক্ষকেরও শিক্ষক।তিনি ছিলেন দুই প্রজন্মের শিক্ষাগুরু।তিনি ছিলেন আমার বাবা-চাচা এবং ফুপুগণেরও শিক্ষক। আমি ক্লাস সেভেন-এ বছরের মাঝামাঝিতে শাহবাজপুর স্কুলে ভর্তি হই যা আমার পূর্ব পুরুষগণের প্রতিষ্ঠা করা স্কুল।ভর্তি হওয়ার পর আমার বাবা আমাকে আফতাব উদ্দীন স্যারের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্যার এর পা ছুঁয়ে সালাম করে আমার বাবা বলেছিলেন, আমার ছেলেটাকে দেখবেন। আমিও স্যারকে সালাম করেছিলাম। আজ লিখতে গিয়ে মনে হয় বাবারা এভাবেই তাঁদের শিক্ষাগুরুর হাতে সন্তানদের সুশিক্ষার জন্য পরম নিশ্চিন্তে সঁপে দিতেন।

 

স্যার ওই দিন আমাকে বলেছিলেন, মিঞার নাতি তুমি, মিঞার নাম রাখবা।পরবর্তীতে তাঁর ছেলে শাহ মুহাম্মদ মুতাসিম বিল্লাহকে আমাদের ক্লাসে সেলাম। আমাদের স্কুলের একজন তুখোর এবং মেধাবী ছাত্র ছিল। বর্তমানে তিনি একজন স্বনামধণ্য সাংবাদিক এবং সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি। আফতাব উদ্দীন স্যারকে আমি ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত বাংলার শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। বাংলার পাশাপাশি তিনি ইতিহাসের বীরদের কথা জীবন্ত করে বলতেন। তাছাড়া শাহনামা, মহাভারত এবং রামায়ণের চরিত্রের কথা জীবন্ত করে তুলতে পারতেন। আমি মাঝারি মানের ছাত্র হলেও সৌভাগ্যক্রমে আমার পৌরাণিক গ্রন্থ পড়া ছিল।তাই স্যারের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম। 

 

স্যারের সুনজরে পড়েছিলাম। আমি ছিলাম স্যার এর সাধারণ জ্ঞানের সেশনের অন্যতম ছাত্র। স্যার একসময় স্কুলের লাইব্রেরি দেখাশোনা করতেন। লাইব্রেরি থেকে বঙ্কিম চন্দ্র, শরৎচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন বই নিয়ে দ্রুত পড়ে ফেলতাম। মাসুদ রানা ও দস্যু বনহুরের বই লাইব্রেরিতে না থাকলেও নিজে সংগ্রহ করে পড়েছি। ফলে মাসুদরানা, দস্যু বনহুর এর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিম চন্দ্র এবং শরৎচন্দ্রের চরিত্রের মহামিলন হতো। অবশ্য বই নির্বাচনে স্যার এর পরামর্শ মেনে নিতাম।

 

স্যার খুবই নীতিবান এবং ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। সেই সময় স্যার এর সহকর্মীদের অধিকাংশই তাঁর ছাত্র ছিলেন। এমনকি প্রধান শিক্ষকও তাঁর ছাত্র ছিলেন। স্যার কখনও তাঁদেরকে ছাত্র বলে বিবেচনা করতেন না। অথবা কোন সুবিধা আদায় করতেন না। তাঁদের উপযুক্ত মর্যাদা দিতেন। তিনি কখনও বিলম্বে ক্লাসে আসতেন না বা কখনও আমি স্কুলে অনুপস্থিত পাইনি। তাঁর সময় জ্ঞান ছিল অনেক প্রখর। তিনি ছোটখাটো গড়নের ছিলেন। এক হাতে লাঠি বা ছাতা হাতে নিয়ে দ্রুত হাঁটতেন এবং একই হাতে হাসিমুখে হাজার সালাম এবং আদাবের উত্তর দিতেন। হয়তবা অভ্যাসের কারণে হাত ব্যথা করতো না। স্যার ধর্ম পরায়ণ হলেও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শুধু তাই নয়, ক্লাসের মেধাবী অথবা দুর্বল ছাত্রটিও তাঁর কাছে সমান মর্যাদা পেতো। আমার চাচা-ফুপুগণ স্যারকে দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। তাঁরপর পা ছুঁয়ে সালাম করে তাকে আপ্যায়ন করতেন।

 

তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমার দাদা মেয়েদের শিক্ষা প্রচলন করার জন্য বাড়ি বাড়ি যেতেন স্যারদেরকে নিয়ে। পর্দার নামে নারীদের ঘরে আবদ্ধ রাখার প্রথা ভেসে মুসলমান মেয়েদের স্কুলে গিয়ে পড়ার প্রচলন করতে স্যার নিজের মেয়ে ও দাদা আমার ফুপুদের প্রথমে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তারপর অনেকেই তাদের কন্যা সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। তারাই ছিলেন আমাদের এলাকার নারী শিক্ষার প্রতীভূ।আমরা যখন নবম শ্রেণিতে পড়তাম তখন ভাদ্র মাসে প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। আমরা কিছু বন্ধুর সাথে পরামর্শ করে খুবই অপরিকল্পিতভাবে এক বন্ধুকে বললাম গরমে অজ্ঞান হওয়ার ভান করতে। সে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই স্যার এর ক্লাস চলাকালে অজ্ঞান হওয়ার ভান করে পড়ে যায়। আমরা তাকে ধরাধরি করে ক্লাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় স্যার এর মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তিনি ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছেন। মর্নিং স্কুলের জন্য হয়তো আমাদের দুষ্টুমিটা গ্রহণযোগ্য ছিল।পরবর্তীতে মর্নিং স্কুল চালু করা হলেও আমাদের অভিনয়টা ধরা পড়ে যায়। আমার চাচা ছিলেন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান। 

 

প্রধান শিক্ষক আবু হামেদ স্যারকে বলেছিলেন, আপনার বেড আমাদের চামড়া। কতবড় সাহস আফতাব উদ্দীন স্যারের ক্লাসে দুষ্টামি।ঘটনার পরদিন আফতাব উদ্দীন স্যারের ক্লাসের সময় প্রধান শিক্ষক আমাদের ক্লাস-এ জোড়া বেত নিয়ে সদলবলে ঢুকলেন। আগেই উল্লেখ করেছিলাম প্রধান শিক্ষকও স্যারের ছাত্র ছিলেন। ঘটনায় রেগে তিনি আমাদের বেত্রাঘাত করার সময় বলেছিলেন, আমার স্যার এর ক্লাসের সময় দুষ্টামি। সেদিন অসম্ভব মার খেয়েছিলাম। স্যার এর চোখ ছল ছল করছিল। আমাদের অপরাধের বিচার দরকার ছিল, তাই হয়তো স্যার বাধা দেননি।

 

স্যারকে নিয়ে লেখার সময় আমার মনে হলো আমাদের মুরুব্বীরা স্যারকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন এবং একজন প্রকৃত মানুষ গড়ার কারিগর মনে করতেন। তাই তাঁর কাছে পাঠাতেন। তার উপদেশ, শৃঙ্খলা, নীতিবাক্য, ধর্মোপদেশ, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা আমাদের কচি মনে আস্ত বাক্যের মতই গেঁথে গিয়েছিল। স্যার এর অনেক ছাত্র আমাদেরও শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের প্রতিও অসংখ্য শ্রদ্ধা জানাই। প্রধান শিক্ষক মরহুম শেখ আবু হামেদ, মরহুম আব্দুর রহিম,মজদু মিয়া, জয় নারায়ণ স্যার, প্রিয়ডোষ স্যার, প্রয়াত মাথন স্যার, সৈয়দ আজিজুর রহমান স্যার সবাই আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। তারা সবাই আফতাব উদ্দীন স্যারের সহকর্মী ছিলেন।

 

স্যারদের সময় খুবই হাতেগোনা ডিগ্রি পাস করা মানুষ ছিলেন। স্যার ইচ্ছা করলেই হয়তো কোন বড় সরকারি চাকুরে হতে পারতেন। কিন্তু একটা ভাল প্রজন্ম তৈরি করার তাগিদে, একটা প্রজন্মকে আলোকিত করার জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি একাধারে ব্যাকরণবিদ, সাহিত্যমনা, দার্শনিক, জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া, একজন পাঠাগার ও একজন মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন। আমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও উন্নয়নে তাঁর/তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।অনেক ইচ্ছা ছিল স্যারকে নিয়ে লিখবো, যাতে স্যার এবং মৃত্যুর পরও একটা লাইব্রেরি পুড়ে না যায়। আমাদের উচিত আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁদের কথা বলে যাওয়া, আর না হয় সমাজ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অনৈতিকতার দিকে ঠেলে দিবে। অনৈতিক অসাধু মানুষদের সমাজের নায়ক মেনে নিবে, তারাই হয়ে যাবে তরুণ মনের নায়ক-নায়িকা যাঁদের আচরণ থেকে শিক্ষা তরুণ-তরুণীদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিবে।

 

আফতাব উদ্দীন স্যারকে নিয়ে স্বপ্ন পরিসরে লিখা শেষ করা যাবে না। চার ঘণ্টা বিমান যাত্রার ফাঁকে মনে করলাম স্যারকে নিয়ে লিখি, আমার সময়টাও ভাল কাটবে। এখন কিছুটা পরিতৃপ্ত। প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে স্যারকে বিদায় সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য মূল উদ্যোক্তাগণের আমি ছিলাম অন্যতম। হয়তো আরও বড়ভাবে মূল্যায়ন করা উচিত, সেটার দায়িত্ব অন্যান্য প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ছেড়ে দিলাম। একজন নির্লোভ মানুষ গড়ার কারিগর এর প্রতি আবারও কৃতজ্ঞতা জানাই। একই সময়ে বলছি দার্শনিক, ব্যাকরণবিদ ও ইতিহাসবেত্তা আফতাব উদ্দীন স্যারের ছোঁয়ায় বহু কোমলমতি প্রাণ বিকশিত হয়েছিল। তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তারই মতো আরও প্রজন্ম শিক্ষকের আবির্ভাবের আশা নিয়ে এখনকার মত কলম বন্ধ করার আগে-সালাম হে আমাদের প্রজন্মের আলোকিত মানব, আপনিই গুরু, আপনিই গুরুগৃহ এবং আপনিই সেই গুরুগৃহের আচার্য্য। আমরা আপনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

 

লেখক- তারই প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষা উদ্যোক্তা ও প্রাবন্ধিক, মিয়ান্জ গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ মোত্তাকি। 

 

একুশে সংবাদ.কম/সম   

Link copied!