ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আপাতত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন নতুন পে-স্কেল (বেতন কাঠামো) দেওয়ার পরিকল্পনা নেই। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিছুটা স্বস্তি দিতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আজ বুধবার আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট চূড়ান্ত করতে গণভবনে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে আগামী অর্থবছরের জন্য আয় ও ব্যয়ের পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হবে।
সভায় সভাপত্বি করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে ফাতিমা ইয়াসমিন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান, পরিকল্পনা বিভাগের সচিবসত্যজিত কর্মকার , আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিমসহ বাজেটসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
বৈঠকে আগামী অর্থবছরের বাজেট চূড়ান্ত করার বৈঠকে এ বিষয়ে প্রস্তাব উঠছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পাঁচ বছর অন্তর একটি নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করার কথা থাকলেও ২০১৫ সালের জুলাই মাসে অষ্টম পে-স্কেল কার্যকর হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর জুলাইয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল বেতন কমিশনের। এ জন্য অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও করা হয়। কিন্তু ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশই রয়ে গেছে।
সর্বশেষ বেতন স্কেল দেওয়ার আট বছর হয়ে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে খাদ্যপণ্যসহ পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন নতুন পে স্কেলের দাবি তুলছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ উপাত্ত অনুযায়ী গেল এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। নতুন পে-স্কেলের প্রত্যাশায় থাকা সরকারি চাকরিজীবীরা পে-স্কেলের বদলে আগামী অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে বিবেচনায় নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বিশেষ এ ভাতার জন্য প্রস্তাব তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনের বছরের আগামী বাজেটটি বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ বাজেট। নতুন পে-স্কেল দেওয়া হবে না। নতুন বাজেটে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ কিংবা এমপিওভুক্তি করার জন্যও কোনো বরাদ্দ থাকবেনা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি চাকরিজীবী প্রায় ১৪ লাখ। তবে বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এ সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন খাতে ব্যয় সাশ্রয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত বাজেটে ৭৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে ৭৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের খসড়া প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ। মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে পরিমান আরো বাড়বে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। এটি চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি। তবে করদাতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত করা হতে পারে। বর্তমানে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা। এদিকে দুই বছর ধরে প্রতিবছরই করপোরেট কর কমানো হয়েছে। এবার এ কর কমানো না-ও হতে পারে।
রাজস্ব আদায়ের গতি ধরে রাখার পাশাপাশি বাড়তি কর আদায় মনোযোগী হতে আগামী অর্থবছরে করপোরেট কর না কমানোর চিন্তা চলছে। এ ছাড়াও চলতি অর্থবছরে সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ রয়েছে। আগামী ৩০ জুন এর মেয়াদ শেষ হবে।
এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এই মেয়াদ বাড়ানো না-ও হতে পারে। আর কালো টাকায় ফ্ল্যাট, বাড়ি, প্লট কেনার সুযোগটিও প্রত্যাহার করা হতে পারে। এ ছাড়া আগামী ৩০ জুন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অবকাশ সুবিধার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এই মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে বলে জানা গেছে।
এদিকে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। আর দেশের জিডিপির আকার ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা করা হচ্ছে। আর মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ থেকে ৬ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে অর্থমন্ত্রীর। আর বিনিয়োগ জিডিপির ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশের প্রাক্কলন করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র আরো জানায়, বাজেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে মহার্ঘ ভাতা খাতে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। বাজেট চূড়ান্তকরণ-সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আজকের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তপূরণের জন্য সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কয়েক দফা বাড়ানোর পরও চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব খাতে ভর্তুকি বাবদ বাড়তি বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকির দায় মেটাতে নতুন অর্থবছরের বরাদ্দের একটি অংশ ব্যয় হবে। তবে চলতি অর্থবছরের বকেয়া বাদ দিলে আগামী অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ কম হবে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব খাতে মোট বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে।
গত অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকিতে ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু সারের দাম বাড়ায় গত অর্থবছর ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। গত বছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ১৫ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। ফলে কৃষি ভর্তুকি পরিশোধে ঘাটতি থেকে যায়। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ১৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত ভর্তুকির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে এ খাতে রাখা হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা।
গত অর্থবছরের বাজেটে কৃষি ভর্তুকিতে ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু সারের দাম বাড়ায় গত অর্থবছর ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। গত বছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ১৫ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। ফলে কৃষি ভর্তুকি পরিশোধে ঘাটতি থেকে যায়। চলতি অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ১৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত ভর্তুকির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে এ খাতে রাখা হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। সরকার এরই মধ্যে সব ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়িয়েছে। এ জন্যও ভতুর্কির চাপ কিছুটা কমে আসবে। আগামী বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হতো ১৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৫ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত বাজেটে এ খাতে অতিরিক্ত ৮১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে খাদ্যে ভর্তুকিতে ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে।
একুশে সংবাদ/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :