AB Bank
  • ঢাকা
  • সোমবার, ০৫ মে, ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

কর্ণফুলীতে বিচরণ করছে লাল কাঁকড়া



কর্ণফুলীতে বিচরণ করছে লাল কাঁকড়া

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে বেড়াতে এসে সৈকতে নামলেই পর্যটকদের চোখে পড়ত লাখ লাখ লাল কাঁকড়া। মনে হতো কক্সবাজারে বেড়াতে আসা অতিথিদের লাল গালিচা সংবর্ধনা দিচ্ছে কাঁকড়ার দল। লাল গালিচা খ্যাত ছোট বড় অনেক লাল কাঁকড়া দেখা মিলবে এখন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নতুন ব্রিজের নিচে মজ্জেরটেক এলাকায়। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া থাকলেও এর আগে কখনো লাল কাঁকড়া দেখা মেলেন। সম্ভবত, সমুদ্র থেকে আসা ফিশিং জাহাজ ও নৌকাতে জলের মধ্যে আটকে থাকা লাল কাঁকড়ার আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে এই এলাকায় বলেছেন স্থানীয়রা। 

প্রসঙ্গত, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় লাল কাঁকড়ার ভূমিকা অপরিসীম বলছেন প্রাণিবিদরা। কাঁকড়া আর্থ্রোপোডা পর্বের একটি ক্রাস্টাসিয় প্রাণী। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে কাঁকড়ার ৬,৭৯৩টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। পৃথিবীর সব মিঠা পানির নদী ও সাগরে (বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায়) কাঁকড়া পাওয়া যায়। কাঁকড়া বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের হতে পারে, যেমন পি কাঁকড়ার দৈর্ঘ্য কয়েক মি.মি, আবার জাপানি মাকড়সা কাঁকড়ার একটি পায়ের দৈর্ঘ্যই ৪ মিটার পর্যন্ত হয়। 

এদের মধ্যে লাল কাঁকড়া বা রেড ক্র্যাব যা হল প্রকৃতির একটি অপরূপ সৃষ্টি। বিশ্বজুড়ে "লাল কাকড়া" বলে যেসব কাকড়াকে বলা হয়, সেগুলোর আসলে নির্দিষ্ট একটাই প্রজাতি নয়, বিভিন্ন অঞ্চলে কাকড়া লালচে রঙের হওয়ায় "লাল কাকড়া" নামে ডাকা হয়। তবে, প্রকৃত লাল কাকড়া বলতে ক্রিসমাস ইসল্যাড রেড ক্র্যাব বা গেকারকোইডিয়া নাটালিসকে বোঝাই, মূলত সেটি হলো একটি নির্দিষ্ট প্রজাতি।

আরও কিছু পরিচিত লালচে কাকড়ার প্রজাতি যেটি উমাশঙ্কর মণ্ডল (ম্যানগ্রোভ ম্যান) কাঁকড়াটি সাধারণ ভাবে লাল কাঁকড়া নামে পরিচিত। সেটি ‘ওসিপোডিডি’ গোত্রের। বিজ্ঞানী মহলে ‘ওসিপোড ম্যাক্রোসেরা’ নামে পরিচিত। লাল কাঁকড়ার এই প্রজাতি বালুকাময় উপকূল, মোহনায় এবং ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে বসবাস করে। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন উপকূল ও সুন্দরবন অঞ্চলে লাল কাকড়া দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা উপকূল এবং মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও কাদামাটির এলাকায় প্রচুর পরিমাণে এজাতীয় কাঁকড়ার প্রধান আবাসস্থল। সুন্দরবন অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া যেত এই কাঁকড়া। সমুদ্রতটে গর্ত করে বাস করে এই কাঁকড়ারা। সৈকতের যত দূর পর্যন্ত জোয়ার-ভাটা খেলে ততটুকু বেলাভূমি বা কাদাচরে কাঁকড়ার বাসভূমি। গর্তে থাকার প্রধান কারণ বাইরের সামুদ্রিক জলজ এবং স্থলজ প্রাণীদের হামলার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা। 

লাল কাঁকড়া গর্ত খুঁড়ে আর তাতে উপকার হয় পরিবেশের। গর্ত খুঁড়ে এরা বিভিন্ন জৈব উপাদান চক্রাকারে আবর্তনে সাহায্য করে। বাস্তুতন্ত্রে এই অবদানের জন্য প্রাণিবিদরা লাল কাঁকড়াকে ‘উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের ইঞ্জিনিয়ার’ বলেছে। মূলত বনাঞ্চল, খাড়া ঢাল ও পাথুরে এলাকায় এদের আবাসস্থল। তবে প্রজননের সময় তারা সমুদ্রের দিকে চলে যায়। এরা সাধারণত গাছের পাতা, ফল, মৃত উদ্ভিদ, বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ক্ষুদ্র শৈবাল, শামুক জাতীয় কম্বোজ প্রাণী, ছত্রাক, কৃমি এদের প্রধান খাদ্য। এরা পরিবেশের পচনশীল বস্তু পরিষ্কারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাঁকড়াগুলো নিশাচর হলেও শীতের সময়ে দিনের বেলায় চরগুলিতে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। সাধারণ কাঁকড়ার আয়ু সাধারণত ১০-২০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারলেও তুলনামূলকভাবে লাল কাঁকড়ার আয়ু কম।

এ পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রায় ৫৫ প্রজাতির লাল কাঁকড়ার সন্ধান পেয়েছে প্রাণিবিদরা। তার মধ্যে ১৩ টি প্রজাতির লাল কাঁকড়া খাওয়ার উপযুক্ত হলেও বাকি গুলো খাওয়ার উপযুক্ত নয়। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ভাবে কাঁকড়া শিকারীরা কাঁকড়া ধরতে গিয়ে খাওয়ার অনুপযুক্ত কাঁকড়া গুলি মেরে ফেলছেন। এতে, বাস্তুতন্ত্রের প্রভূত ক্ষতি হয় এবং কাঁকড়া কারণে পাওয়া প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে বিঘ্নিত হচ্ছে।

এর আগেও বলেছিলাম ক্রিসমাস ইসল্যাড রেড ক্র্যাব বা গেকারকোইডিয়া নাটালিস লাল কাঁকড়া খাওয়ার উপযুক্ত নয় তবে ম্যানগ্রোভ এলাকার বা উপকূলীয় অঞ্চলে কাদা মাটিতে যে লাল কাঁকড়াগুলো পাওয়া যায় সেগুলো খাওয়ার উপযুক্ত। এই কাকড়া গুলোতে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন আছে, মানবদেহের পেশি গঠনে সহায়ক কাঁকড়ার মাংস চর্বিহীন উচ্চমানের প্রোটিন সরবরাহকারী খাবার। এছাড়াও এতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে যা মানবদেহের হার্ট ভালো রাখে এবং উচ্চ রক্ত প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এতে আরো আছে ভিটামিন B12, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, কপার ও আয়রনের মতো খনিজ যা ইমিউন সিস্টেম ও স্নায়ুতন্ত্রের জন্য খুবই উপকারী। সর্বোপরি যারা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চান তাদের জন্য খুবই উপকারী। সঠিকভাবে রান্না ও পরিমিত পরিমাণে খেলে কাঁকড়া পুষ্টিকর ও উপকারী। তবে অ্যালার্জি বা কোলেস্টেরল সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাওয়াই ভালো। 

বাংলাদেশের লাল কাকড়া সংরক্ষণ ও উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করে সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে বেকারত্ব দূর হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। কারণ বাংলাদেশের বাজারে উপকূলীয় অঞ্চলে মোটামুটি বড় আকারের লাল কাঁকড়ার মূল্য কেজি প্রতি প্রায় ৯৫০ টাকা হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে লাল কাঁকড়ার দাম অনেক বেশি। বৈশ্বিক পাইকারি বাজার গত ২০২৪ সালে ফ্রেশ কাঁকড়ার পাইকারি দাম প্রতি কেজি $6.05–$13.34 এর মধ্যে ছিল। তবে, রপ্তানি ও আমদানি মূল্য প্রতি কেজি $7–$40.22 পর্যন্ত উঠেছে, যা বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই কাকড়ার চাহিদা অনেক, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য দক্ষিণ কোরিয়ায় কেজি প্রতি ১,২০,০০০ ওন (প্রায় $52), ভিয়েতনামে ১.৯ মিলিয়ন ভিএনডি (প্রায় $80), এবং ইউরোপে প্রতি কেজি €155 (প্রায় $170) দামে বিক্রি হচ্ছে। আলাস্কান বা ক্যামচাটকা অঞ্চলের রেড কিং কাঁকড়া সাধারণত দামী। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে কাঁকড়ার সংখ্যা হ্রাস পাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। 

এদিকে, গবেষণায় উঠে এসেছে ২০১৬ এবং ’১৭ সালের শেষের দিক থেকেই লাল কাঁকড়া কমতে দেখা যায়। পর্যটক জেলা কক্সবাজারে এবং পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র উপকূলে লাল কাঁকড়ার সংখ্যা ক্রমশ কমছে বেশ ব্যাপক হারে। কয়েক বছর আগেও প্রচুর পরিমাণে দেখা যেত এদের। 

মূল প্রসঙ্গ, কর্ণফুলী নদীর শেষ প্রান্ত পারকির চর এলাকা হতে কালুরঘাট পর্যন্ত এই বিস্তৃতি এলাকাতে কিছু কিছু স্থানে অসংখ্য লাল কাঁকড়ার আবাসস্থল হয়েছে। উক্ত এলাকায় প্রশাসনিকভাবে লাল কাঁকড়াকে সংরক্ষণের লক্ষ্যে কাঁকড়া শিকারীদের বিধি নিষেধ করলে বিলুপ্ত প্রায় এ প্রাণীর প্রজনন বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট প্রাণীবিদ এবং স্থানীয়রা। এপ্রজাতির কাঁকড়া থেকে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাঁকড়ার চাষীদের উদ্বুদ্ধ করে লাল কাঁকড়া রক্ষার এবং আন্তর্জাতিকভাবে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

লাল কাঁকড়া দেখতে আসা উৎফুল্ল কর্ণফুলী উপজেলার স্থানীয় মোঃ আলম জানান, এই এলাকায় এর আগে লাল কাঁকড়া কখনো চোখে পড়েনি। পর্যটক জেলা কক্সবাজারে যেতাম মূলত সমুদ্রে গোসল করা, মুক্ত হাওয়া উপভোগ ও লাল কাঁকড়া দেখতে। আর যখন বাড়ির পাশে নদীর তীরে শৈশবের কৌতুহলী হয়ে দেখা লাল কাঁকড়া দেখতে পেলাম মনের ভিতর আনন্দে ভরে উঠলো। আমাদের দাবি এই লাল কাঁকড়া আবাসস্থল প্রশাসনিকভাবে সংরক্ষণ ও বিধি নিষেধের ব্যবস্থা করুক।

স্থানীয় জেলে আহমদ আলী লাল কাঁকড়া নিয়ে তার অনুভূতি জানান, মাস দুয়েকের জন্য যখন সমুদ্রের মাছ ধরতে যায় প্রতিদিন সমুদ্রে নামা ও বাড়ি ফেরার মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে অসংখ্য লাল কাঁকড়ার দেখা হয়। সমুদ্র থেকে ফিরে মাছ শিকার শেষে নদীর পাড়ে জাল পরিস্কার করি, সে সময় হয়তো কিছু লাল কাঁকড়া জালে আটকে থাকে, জীবিতগুলোকে পুনরায় নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। হয়তো এর থেকে আস্তে আস্তে বংশবিস্তার করে লাল কাঁকড়ার আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে।

একই এলাকার বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বললেন, এখন বর্ষাকাল, ঠান্ডা পরিবেশ বলে নদীর পাড়ে যখন–তখন লাল কাঁকড়ার দেখা মেলে। কিন্তু গরমকালে কাঁকড়ার দেখা মেলে সকাল ও বিকেলে। লাল কাঁকড়া মোটেও গরম সহ্য করতে পারে না, গরমের সময়টা সেগুলো গর্তের ভেতরে লুকিয়ে থাকে।গরমের চেয়ে লাল কাঁকড়ার বড় শত্রু মানুষ। এছাড়াও স্থানীয় কিছু শিশু গর্তের ভেতর থেকে কাঁকড়া ধরে রশি দিয়ে বেঁধে খেলা করে। নদীর পাড়ে কর্মরত বিভিন্ন পেশার মানুষের পায়ের তলায় পড়ে ভেঙে যায় লাল কাঁকড়ার আবাসস্থল। মারা যায় কাঁকড়ার অসংখ্য বাচ্চা। অনেকেই জানেনা লাল কাঁকড়া খাওয়ার উপযোগী যদি জানতো তাহলে এখানে একটা লাল কাঁকড়াও থাকত না। সব কাঁকড়া ধরে ধরে খেয়ে ফেলত মানুষ। তবে মানুষ না খেলেও লাল কাঁকড়া কুকুর বিড়ালের প্রিয় খাবার। এখানকার লাল কাঁকড়াগুলো নদীর ভাটার পর চিকচিক করা কাদামাটিতে নিজের তৈরি করা বাসা থেকে বেরিয়ে ছোটাছুটি এবং পা দিয়ে নানান আকৃতির আল্পনা তৈরি করে। 


একুশে সংবাদ/চ.প্র/এ.জে

Shwapno
Link copied!