পশুর চামড়া পাচারের আশঙ্কা
একুশে সংবাদ: গতবারের চেয়ে এবারে কোরবানির ঈদের পশুর চামড়া প্রতি বর্গফুটে ৫ থেকে ১০ টাকা কমে কেনার চিন্তা ভাবনা করছে চামড়া ব্যবসায়ীরা। গতবারের বিপুল পরিমান চামড়া মজুদ থাকা, দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা মন্দার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই দাম নির্ধারণের চিন্তা ভাবনা করছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরের লবণযুক্ত গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ১০ টাকা কমিয়ে যথাক্রমে ৪৫ থেকে ৫০ এবং ৪০ থেকে ৪৫ টাকা নির্ধারণের দাবি জানানো হয়েছে। একইভাবে মহিষের লবণযুক্ত চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, খাসি ২০ থেকে ২২ এবং বকরির ১৫ থেকে ১৭ টাকায় কেনার দাম নির্ধারণের কথা ভাবছে সংগঠনগুলো। গত কয়েকদিন চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে গত বছরের চেয়ে এ বছর কোরবানির চামড়ার দাম কম নির্ধারণ করা হলে তা পাচারের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম নিম্নমুখী হওয়ায় এবার কোরবানির চামড়ার দাম কম নির্ধারণ করা হবে। এছাড়া ফড়িয়া, মৌসুমী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যাতে বেশি টাকায় চামড়া কিনে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্যই আগেভাগে দাম নির্ধারণ ও ঘোষণার চেষ্টা করা হচ্ছে। অপরদিকে গত বছর ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ এখনও শোধ করতে না পারায় চামড়া ব্যবসায়ীরা এবার কম ঋণ পাবেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সক্রিয় পাচারচক্র: বরাবরে মতো ঈদকে সামনে রেখে এবারো রাজধানী, উত্তরাঞ্চলসহ সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় রয়েছে চামড়া পাচারকারী বেশ কয়েকটি চক্র। চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পাচারের জন্য বিনা সুদে কোটি কোটি টাকা লগ্নিও করছে ভারতীয় চামড়া সিন্ডিকেট। জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও সীমান্তবর্তী এলাকার অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী সরাসরি এ কারবারের সঙ্গে জড়িত। সীমান্তজুড়ে এসব এলাকা দিয়েই কোরবানির পর মাসব্যাপী চামড়া বাধাহীনভাবে ভারতে চলে যায়। এছাড়াও পঞ্চগড়, দিনাজপুর, যশোর, লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে চামড়া পাচারের জন্য প্রস্তুত রয়েছে শত শত দালাল সিন্ডিকেট। কয়েকজন গরু ব্যবসায়ী, দালাল, কসাই ও চামড়া ব্যবসায়ী জানান, ঠাকুরগাঁওসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৬০ ভাগ চামড়াই সীমান্ত দিয়ে চলে যাবে।
এদিকে যশোরের শার্শা উপজেলার শিকারপুর, কাশিপুর, বেনাপোলের পুটখালি, দৌলতপুর ও গোগা সীমান্তকে কোরবানির পশুর ‘চামড়া পাচারের রুট’ হিসেবে চিহ্নিত করে বাড়তি সতর্কতা নিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ব্যাপকহারে এবার চামড়া পাচার হতে পারে- ব্যবসায়ীদের এমন আশঙ্কার প্রেক্ষাপটে চিহ্নিত এলাকাগুলোতে সীমান্তরক্ষীদের পাশাপাশি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ ও র্যাব। ঢাকার পর দেশে পশুর চামড়ার সবচেয়ে বড় মোকাম যশোরের রাজারহাট। সেখানে দুই শতাধিক আড়তে ২১ জেলার ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ মোকামের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১০ হাজার মানুষ। বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল জানান, প্রতি কোরবানির ঈদে রাজারহাটে প্রায় ২০ কোটি টাকার চামড়া কেনাবেচা হয়। ঈদের পর সীমান্ত পথে চামড়া পাচার বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, সরকার চামড়া কেনার জন্য ট্যানারি মালিকদের ঋণ দিলেও সেই অর্থের পুরোটা তারা ব্যয় করেন না।
এছাড়া স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা ঋণ পান না। কোরবানির সময় তাদের হাতে টাকা থাকে না। ফলে ‘সিন্ডিকেট করে’ চামড়ার দাম কমিয়ে দেয়া হয়। তখন বেশি দামের আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বেছে নেন সীমান্তের চোরাইপথ। বাগআচড়ার চামড়া ব্যবসায়ী ইসলাম মিয়া বলেন, পেশাদার চামড়া ব্যবসায়ীদের পুঁজি সঙ্কটের সুযোগ নেয় চোরাকারবারিরা। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে তারা বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে চামড়া সংগ্রহ করে। পরে সুযোগ বুঝে পাচারকারীদের কাছে সেই চামড়া তুলে দেয়। এবার চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি দাম কম নির্ধারিণ করলে ভারতে চামড়া পাচার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা। বেনাপোলের দক্ষিণাংশের সীমান্তের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত খুলনা ২৩ বিজিবি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ব্যাটালিয়নের এক কর্মকর্তা দৌলতপুর, পুটখালি ও গোগা সীমান্তের ইছামতি নদী দিয়ে চামড়া পাচারের শঙ্কার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, চামড়া পাচার ঠেকাতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাড়তি সতর্কতা, বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানোসহ নদীতে টহলের ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা জানান, এবার ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া কিনবেন ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকায়। ঢাকার বাইরে এর দাম হবে ৪০ টাকা থেকে ৪৫ টাকা। এছাড়া প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত মহিষের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হবে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। সারাদেশে খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকায় সংগ্রহ করা হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ দাম নির্ধারণ করা হবে। তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কমার পাশাপাশি চীনে বাংলাদেশ থেকে চামড়া রফতানি কমে গেছে। তাই মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বেশি দামে চামড়া না কেনার আহ্বান জানান। ব্যাংক ঋণ ৭০০ কোটি টাকা: চলতি বছর সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক মিলে কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে ৭০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ অনুমোদন দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত বছর সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক মিলে কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে ৬৫০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ অনুমোদন দেয়। তার আগেরবার ৫৪০ কোটি টাকা ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ দেয়া হয়েছে। গেলবার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ১৯৫, জনতা ২৫০, অগ্রণী ১২০ ও রূপালী ব্যাংক ৮৪ কোটি টাকা ঋণ দেয়। এ চার ব্যাংকের বাইরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক এবং বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক এই খাতে শাখা পর্যায় থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, সারাদেশে কোরবানির ঈদে প্রায় ৭০ লাখ চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এসব চামড়া স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ থেকে ট্যানারি মালিক পর্যায়ে পৌঁছতে চার-পাঁচ হাতবদল হয়। এতে চামড়ার প্রকৃত দাম সাধারণ মানুষ পায় না।
একুশে সংবাদ ডটকম // এম // ১৯.০৮.১৬
Link copied!
আপনার মতামত লিখুন :