সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

১৫ই আগস্ট কালরাত্রির সেই দুঃসহ স্মৃতি : শেখ ফজলুল করিম সেলিম, এম.পি

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ১২:০১ এএম, ১৫ আগস্ট, ২০২১

১৫ ই আগস্ট।’ ৭৫-এর এ দিনটিতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ তার পরিবারের সদস্যদের। সেই কালরাত্রিতে আরও হত্যা করা হয়েছিলো বাংলার বাণীর প্রতিষ্ঠাতা অগ্রজ শেখ ফজলুল হক মণি ও আমার অন্তঃসত্ত্বা ভাবী শামসুন্নাহার আরজুমণিকে। মণি ভাই ও ভাবীকে যখন হত্যা করা হয় তখন আমিও তাদের পাশে ছিলাম। ঘাতকদের ব্রাশ ফায়ারে বুলেটবিদ্ধ মণি ভাই ও ভাবীর দেহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। আমি তাদের মাঝে লুটিয়ে পড়ি- দেহের জামা কাপড় রক্তে ভিজে যায়। স্বজন হারানোর সেই হৃদয় বিদারক মর্মান্তিক মুহূর্তের নৃশংস ঘটনার সময় আমি প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই দুঃসহ স্মৃতি এতবছর পরও চোখের মণিমোঠায় ভেসে ওঠে। ঐ কালো অধ্যায় আজ কালের চাকায় ৪৬ বছর পিছনে কিন্তু স্মৃতির মিনারে ইতিহাসের সেই করুণ অধ্যায়টি চাক্ষুস অবলোকন এখনও আবছা হয়ে যায়নি। বরং যতদিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে, আবার বছর ঘুরে ১৫ আগস্ট আসছে, ততই স্বজন হারানোর পাথরচাপা শোক শুধু অশ্রæতে নয়, স্মৃতির মিনারে অক্ষয় চিরঞ্জীব মহান মানুষগুলোর মৃত্যুর রক্তধারায় উষ্ণ ¯্রােতের স্পর্শের অনুভবের সেই শোক এখন শক্তির উৎস হয়ে উঠেছে। কিভাবে চোখের সামনে মণি ভাই ও ভাবিকে হত্যা করা হলো তার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে মনে পড়ছে নিজেরও বাঁচার কথা ছিল না। কিন্তু সব চেয়ে বড় সত্য, সকল নির্মাম ঘটনা ও কাল অধ্যায়ের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হয়তো ইতিহাসের প্রয়োজনেই অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। সৌভাগ্য বলুন বা দুর্ভাগ্য আল্লাহ তালারই ইচ্ছায় মণি ভাই ও ভাবির রক্তধারা গয়ে মেখে ঐ দিনের জন্য আমিও বেঁচে আছি।

দুঃখ জাগানিয়া আগস্টের সেই কালরাতে মণি ভাই ও ভাবিকে হত্যার একটি চাক্ষুস বিবরণ জাতির কাছে পেশ করার জন্য ঐতিহাসিক দায়েই আজ আমি কলম ধরেছি। এই বিবরণ চোখে যা দেখেছি, যা ঘটেছে, তাই লিপিবদ্ধ করলাম। এখানে তথ্যের কোন অপব্যাখ্যা নেই। থাকবেই-বা কেন, স্বজন হননের মর্মান্তিক দৃশের কোন ঘটনা যার উপর দিয়ে যায় তাতো আর ভুলবার কথা নয়। আমৃত্যু ঐ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি প্রতি মুহূর্তে নাড়া দেবেই। আমি এখানে ঘটনাটি শুধু বিবৃত করলাম, বিচারের দায় রইলো দেশবাসীর কাছে।

১৩ নম্বর সড়কস্থ ধানমন্ডির একটি বাড়ি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মণি ভাই এ বাড়িতে ছিলেন। দোতলা বাড়ির সামনে এক চিলতে উঠোন। ১৫ই আগস্টের আগের দিন ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা থেকেই বাড়ি লোকে লোকারণ্য। বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ জড়ো হয়েছেন মণি ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য। মণি ভাই তখন বাকশাল সেক্রেটারী। আমি এই দিন বিভিন্ন কাজকর্ম শেষ করে রাত এগারটার দিকে বাড়িতে ফিরি, তখন মণি ভাই ছিলেন না। তার জন্য অপেক্ষমান দূরদূরান্ত থেকে আগত নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের সাথে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। মণি ভাই তখন অফিসেও ছিলেন না। রাত সাড়ে এগারটায় মণি ভাইয়ের গাড়ি এল। কিন্তু তিনি এলেন না। ড্রাইভার রহমান বলল, মণি ভাই ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নেমে গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার মা, বঙ্গবন্ধুর বুজি, তাকে সকালেই বঙ্গবন্ধু বাড়িতে নিয়ে গেছেন নিজ গাড়ি পাঠিয়ে। তিনি তখনও ফিরেননি।
রাত সাড়ে বারটায় মাকে নিয়ে মণি ভাই এলেন। বঙ্গবন্ধু’র বাড়িতে তার বেড রুমে দু’জনে অনেকক্ষণ একসঙ্গে ছিলেন। তখন ওখানে অন্য কেউ ছিলেন না। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে বলে এবং মা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষ করে আছেন বলে মামি (বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী) বারবার তাড়া দিলেন বঙ্গবন্ধুকে- মণিকে ছেড়ে দাও; বুজি বসে আছেন। বঙ্গবন্ধু উঠে ডাইনিং রুমে গেলেন। বঙ্গবন্ধু মণি ভাইকে বললেন, মণি, বুজিকে নিয়ে আমার সঙ্গে চারটে খেয়ে যাও। বাড়ি ফিরতে দেরি হবে বলে মা ও মণি ভাই না খেয়েই চলে এলেন।

আজও ব্যথায় বুক মোচড় দেয়, মণি ভাইকে চারটে ভাত একসঙ্গে খেয়ে যাবার আমন্ত্রণই ছিলো দু’জনার মধ্যে শেষ কথা।

মণি ভাই মাকে সাথে নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরলেন তখন আমি লনে। গাড়ি থেকে নেমে মা দোতলায় গেলেন। মণি ভাই ড্রইং রুমে গেলেন। সেখানে তিনি অপেক্ষমান নেতৃবৃন্দের সাথে মিনিট দশেক কথা বললেন। মণি ভাই তখন সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত ও অবসণœ। কিন্তু চোখে আত্মপ্রত্যয়ের দৃষ্টি। সমবেত ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশ্যে বললেন, কাল কথা বলবো। বঙ্গবন্ধু আগামীকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয় যাবেন। ওখানে আমাকেও যেতে হবে। এরপরই সকলে চলে গেলেন। পৌনে একটার দিকে মণি ভাই খেতে বসলেন মা ও ভাবীকে নিয়ে। খাওয়া-দাওয়ার পর আত্মজ পরশ-তাপসের ঘুমন্ত চোখে তাকিয়ে বেড রুমে ঢুকলেন। আমি তখন পাশের বেড রুমে ঘুমাতে গেলাম। মণি ভাই মিনিট তিনেক বাদে বেড রুম থেকে বেরিয় লাইব্রেরি রুমে ঢুকে বইপত্র ঘাটলেন। ঘুমাতে যাবার আগে বইপড়া আর সকালে উঠে জাতীয় দৈনিকগুলো পাঠ করা মণি ভাইয়ের নিত্য দিনের রুটিন। লাইব্রেরি রুম থেকে একটি বই বেছে নিয়ে বেডরুমে এলেন। বইটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর লেখা একটি বিখ্যাত দলিল। নাম- লাস্ট ব্যাটাল। বুকের উপর বই মেলে ধরে শুয়ে শুয়ে তিনি এটা পড়ছিলেন। মণি ভাই একা জেগে যখন বিখ্যাত বইটি পড়ে যাচ্ছিলেন তখন বাড়ির সবাই ঘুমে নিমগ্ন, রাত্রির শেষ প্রহরে ঢাকা মহানগরীও যুমন্ত। ভোর ৫টা। ঘুম থেকে উঠে পড়লেন মণি ভাই। পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। নিচে নেমে এলেন দৈনিক কাগজগুলোর উপর চোখ বুলানোর জন্য। হঠাৎ চোখ পড়লো বাইরের গেট, ২০/২৫ গজ দূরে একটি আর্মির গাড়ি। কাকভোরের আলো-আঁধারিতে কালো ইউনিফর্ম পরা আর্মির ল্যান্সার ফোর্সের এই দলটিকে দেখা মাত্রই মণি ভাই আবার ত্বরিৎ গতিতে উপরে উঠে এলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় চিন্তিত তার মুখাবয়ব। কিন্তু একেবারেই বিচলিত হলেন না। ঐ সময় আমার স্ত্রী ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য ঘুম থেকে উঠেছে। মণি ভাইয়ের চিন্তিত অবয়ব দেখে ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, মণি ভাই কি হয়েছে? মণি ভাই কোন কথা বলেন না। তার চোয়াল শক্ত হলো। বেডরুমে ঢুকে ফোন করলেন। আকাক্সিক্ষত নম্বরে ডায়াল করে এনগেইজড টোন পেলেন। খুব সম্ভবত বঙ্গবন্ধুকেই ফোন করেছিলেন। এরপর ফের টেলিফোন রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। কিন্তু প্রত্যুত্তর নেই। এই সময় ফোন বেজে উঠল। মণি ভাই ধরলেন। অপর প্রান্ত ভেসে এলো সেরনিয়াবাত সাহেবের বাড়ি আক্রান্ত। ‘ফোন রাখো আমি দেখছি’। মণি ভাই ফোন ছেড়ে দিলেন। ঠিক এ সময়ে সেনাবাহিনীর ৬/৭ জন লোক ভারি বুটের শব্দে সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠতে উঠতে চিৎকার শুরু করলো; মণি সাহেব কোথায়, উনি আছেন? মণি ভাই দ্রæত বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে ছোট স্পেসের আগন্তÍকদের মুখোমুখি হয়ে বললেন, এই আমি, কি হয়েছে? তেজী ও ভারি কণ্ঠের আওয়াজে আগন্তÍকরা ইতস্তত। মণি ভাই আবার বললেন; কী হয়েছে বলুন। ওদের ভিতর থেকে একজন বললো, ইউ আর আন্ডার এ্যারেস্ট। তখন উদ্বেগ ক্ষোভে জ্বলে উঠলেন মণি ভাই। বললেন, হোয়াই, কি অন্যায় করেছি আমি? মণি ভাইয়ের এই ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ক্ষিপ্ত হয়ে একজন সঙ্গিন উচিয়ে মণি ভাইয়ের মাথায় আঘাত করলো, চুলের মুঠি ঝাপটে ধরলো। দৃশ্যটি দেখে আমার স্ত্রী আমাকে ডাকলো। বললো, কি সাহস, কারা যেন মণি ভাইকে মারছে। চুলের মুঠি ধরে টানছে। দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি বেরিয়ে মণি ভাইয়ের চুলের মুঠি চেপে ধরা হাতটা জাপটা দিয়ে ছাড়ালাম। ভাবিও তখন বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে মণি ভাইয়ের ডান পাশে দাঁড়ালো। আমি মণি ভাইয়ের বাম পাশে আর আমার পাশে আমার স্ত্রী। পরশ-তাপস দরজা সোজাসুজি বিছানায় ঘুমে শায়িত। অনুজ মারুফ তখন নীচে। ও গান পয়েন্টের মুখে। মণি ভাইয়ের চুল ছাড়িয়ে নেওয়ার পর ওদের একজন বললো, আমাদের সঙ্গে যেতে হবে, এ্যাগেইন রিপিট ইট, ইউ আর নাউ আন্ডার এ্যারেস্ট।

মণি ভাই বললেন, ঠিক আছে, আসছি। এ কথা বলে একটু ঘুরে ঠিক যে মুহূর্তে তিনি জামা-কাপড় পাল্টানোর জন্য তার রুমের দিকে যেতে উদ্যত হয়েছেন ঠিক সেই মুহূর্তেই ২/৩ গজ দূর থেকে শুরু হলো ব্রাশ ফায়ার, আমরা সবাই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ি। মণি ভাই ও ভাবির গয়ে বুলেট বিদ্ধ হয়। আমার গায়ে গুলি লাগেনি। রক্ত ধারায় মেঝে লাল হয়ে যায়। আমার স্ত্রীর গয়ে ও গুলি লাগেনি। মণি ভাই ও ভাবির রক্তে আমার জামা-কাপড় রঞ্জিত হলো; ওরা দ্রæত নিচে নামতে থাকে, আমার মা এ দৃশ্য দেখে চিৎকার করেন। তখন উপরে উঠে ওরা আবার আমাদের লক্ষ্য করে ফায়ার শুরু করলো। এবারও আমার গায়ে গুলি লাগলো না। আমার স্ত্রী দরজার আড়ালে ছিল। এরপর তাড়াহুড়ো করে আগন্তÍক খুনিরা নিচে নেমে যায়। গুলির শব্দে পরশ-তাপস চিৎকার করে ওঠে। আমার স্ত্রী দৌঁড়ে ওদের কাছে ছুটে যায়। ওদের জড়িয়ে ধরে বলে, বাবা চিৎকার করে না, ল²ীটি চিৎকার করে না। ওরাও তখন কিছু বুঝলো না। চাচির বুকের উপর পড়ে ডুকরে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়লো। একই সঙ্গে মাও চিৎকার করে তার রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর মা অজ্ঞান হয়ে ঐ রক্তের উপর লুটিয়ে পড়েন। ঘাতকা চলে যাবার সময় বাড়ির চারপাশে ঘিরে ফেলে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছিলো। আমরা তখন মৃত্যুর মুখোমুখি। ওদের গুলির ঝাঁকে সারা বাড়ি মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। খুনীরা আতঃপর চলে গেল। মা’র সাথে সাথে আমার বৃদ্ধ পিতা শেখ নুরুল হক ঘর থেকে বের হয়ে এসে এই করুণ অবস্থা দেখে তাঁর বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ তিনি নিথর নিস্তব্ধ হয়ে থাকেন। তারপর মাকে জিজ্ঞেস করেন মণিকে কারা মারলো? আমি বললাম আর্মি। একথা শুনে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কেন? আমি বললাম’ জানি না। তখন তিনি নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে একদৃষ্টিতে মণি ভাই’র লুটিয়ে পড়া দেহের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

রক্তাক্ত দেহ নিয়ে মেঝে থেকে উঠে মণি ভাইয়ের দিকে তাকালাম। মণি ভাই নিথর, নিস্পন্দ। ভাবীর দিকে চোখ ফেরালাম। তার ঠোঁট নড়ছে। যন্ত্রণার আর্তিতে বলে উঠলেন- আমার পেট ছিঁড়ে ফুঁড়ে গেছে। পেটি কোটের বাধন একটু হালকা করে দিন আমার স্ত্রী কোমরের বাঁধন আলগা করে দেয়। তিনি বললেন, সেলিম ভাই আমাকে বাঁচান আমার দু’টো বাচ্চা আছে। পরশ-তাপস তখন চাচির বুক থেকে নেমে মা-বাবার দেহের কাছে ছুটে যায়। ওরা মা-বাবার মুখের কাছে মুখ রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো; মা কথা বলো, বাবা কথা বলো। তখন ভাবী বলেন- সেলিম ভাই আমার পরশ-তাপসকে দেখেন। নিচ থেকে ছোট ভাই মারুফ উপরে উঠে এলো। তার চোখ পাথরের মত অনড়। আমি তাড়াতাড়ি ৩২ নম্বরে ফোন করলাম। কিন্তু লাইন পেলাম না। মারুফ চেষ্টা করে ফোনে শেখ জামালকে পেল। ওরা দু’জন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। মারুফ জামালকে জানালো, মণি ভাইকে মেরে ফেলেছে, ভাবি আহত। তখন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ ভেসে আসে- বঙ্গবন্ধু বলেন আমার মণিকে ও মেরে ফেলছে। জামালের উ™£ান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো; দোস্ত রাখ। আমাদের বাড়িতেও গুলি হচ্ছে। মারুফ ফোন রেখে দেয়। এখনও বুঝতে পারছি না কি ঘটছে? আমি মারুফ ও শাহাবুদ্দিন মণি ভাই ও ভবিকে নিয়ে পিজিতে ছুটলাম। আমার গাড়িতে ছিলেন ভাবি। মারুফের গাড়িতে মণি ভাই। পথে মোস্তফা মোহসীন মন্টুর দেখা পেয়ে মারুফ তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। পিজির সামনেই দেখলাম আর্মি পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে। বাংলাদেশ বেতারের সামনেও আর্মি। ওদিকে যাওয়া মুশকিল। গাড়ি ঘুরিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসার সাথে সাথে পেছনে হর্নের শব্দ শুনলাম। ঐ গাড়িতে ছিলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের সদস্যদের লাশ। ঐ গাড়িতেই ছিলেন রমনা থানার ওসি মিঃ আনোয়ার। তিনিও জানতেন না কি ঘটছে। মণি ভাইকে সাথে সাথে অক্সিজেন দেয়া হলো। ভাবিকে নিয়া যাওয়া হলো অন্য ওয়ার্ডে, ইমারজেন্সীর বারান্দায় সেরনিয়াবাত সাহেবের ১১ বছরের গুলিবিদ্ধ কন্যা বেবী একটু একটু করে নড়ছে। ডাক্তারকে বললাম, একটু দেখুন। কিছু সময় পর সে আর বাঁচেনি। এই কিশোরীটিও আমার চোখের সামনেই মৃত্যু হলো। আমি মণি ভাইয়ের কাছে ছুটে গেলাম ডাক্তার বললেন, উনি অপনার কে হন?-

-আমার ভাই।

-দুঃখিত। অনেক চেষ্টা করেছি। বাঁচাতে পারলাম না। মণি ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে মুহূর্ত পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। আবার ছুটে গেলাম ভাবীর কি অবস্থা দেখতে। ধারণা ছিল ভাবি হয়তো বেঁচে যাবেন। কিন্তু তিনিও এই সুন্দর পৃথীবিতে অসুন্দরের হাতে মৃত্যু বরন করে পরপারে চলে গেলেন। মণি ভাইয়ের বুকে, গলায় ও থুতনিতে তিনটি গুলির চিহ্ন ছিল। আর ভাবির পেট ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলো। তখনই বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে মেডিক্যাল কলেজে বুলেটবিদ্ধ কয়েকজন আহত লোক এলো। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসার কাজের লোক আলতাফ ছিলো। সে মারুফকে বললো- ভাই সাহেবকে, কামাল ভাইকে, সাবাইকে মেরে ফেলেছে। এ খবর মারুফ আমাকে বলার পর তখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারি। এর কিছুক্ষণ পরেই হাসপাতাল আর্মি ঘেরাও করলো। আমি বাসায় ফোন করে স্ত্রীকে বললাম তোমরা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ো। পাশের বাসায় চলে যাও। ফোন করেই আমি, মারুফ ও শাহাবুদ্দিন হাসপাতালের তিন তলায় চলে গেলাম। তখন বাইরে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কোন চেনা মুখ দেখা গেল না। কিছু সাধারন মানুষ চিৎকার করে বলছেন, লাশ দিন আমরা মিছিল করবো। পরে অবশ্য খুনীদের অস্ত্রের দাপটে মুহূর্তের মধ্যে এলাকাটি জনশূন্য হয়ে যায়। তখন হাসপাতালে থাকা আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়। আমাদের গায়ের জামাকাপড়ে মণি ভাই ও ভাবির দেহের রক্তের চিহ্ন। এভাবে বের হওয়া মুস্কিল বিধায় চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ এস এম মনিরুল হক, নিয়োরো সার্জন ডাঃ কনক ও আরো কয়েকজন ডাক্তার খুব সতর্কতার সাথে আমাদের বের করে দেন। রক্তাক্ত জামাকাপড়গুলো খুলে ফেলে তাদের জামাকাপড় পরেই বের হয়েছিলাম।

বাড়িতে ফিরে দেখি বাড়ির লোকজন কেউই সরে যায়নি। আমরা তখন আরো উদ্বিগ্ন। আমাদের দেখেই পরশ ও তাপস কান্নায় ভেঙে পড়লো। ওরা বললো, চাচা, আমাদের মা-বাবা কোথায়? মা-বাবার কাছে আমাদের নিয়ে যাও, মা-বাবাকে আমাদের কাছে এনে দাও। পরশের বয়স তখন পাঁচ। তাপসের বয়স সাড়ে তিন। এই অবোধ শিশু দু’টির কথার জবাব সেদিন দিতে পারিনি। বুক থেকে একটি ভারি বাতাস কণ্ঠঅবধি এসে আটকা পড়েছিলো।

আবার শুনলাম সেই একই চিৎকার, মণি সাহেব আছে? সামরিক উর্দিপরা জীপ গাড়িতে একদল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রুপ আমাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি জবাব দিলাম, তিনি হাসপাতালে। তাদের একজন বললো ছুটাছুটি করবেন না। আমরা দেখছি। তারা চলে গেল।

তখন আমারা পাশের একটি বাড়িতে চলে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম আরেকটি সামরিক গাড়ি। কিছু আর্মি আমাদের বাসায় ঢুকে সোনার গহনাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করতেও বাকি রাখলো না। সেই কালরাত্রির রক্তবন্যার নীরব সাক্ষী হয়ে আজকের স্মৃতি রোমন্থন বড়ই কষ্টকর। সেই ভয়াল নৃশংস মুহূর্তের বিবরণ দিতে গিয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণের বেদনা শুরু হয়।

তবুও লিখলাম ভাবি বংশধরদের জন্যে। ১৫ আগস্টের কাল রাতে হারিয়েছি অনেক আত্মার আত্মীয় ও রক্তের সম্পর্কে গড়া মানুষকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমার মামি বেগম মুজিব, ছোট মামা শেখ আবু নাসের, মামাতো ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ও কামাল-জামালের নবপরিণীতা বধূদ্বয় সুলতানা ও রোজী, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা এবং আমার ভাবী শামসুন্নাহার আরজু মণি, সেরনিয়াবাত সাহেবের ১১ বছরের কন্যা বেবী, ১০ বছরের পুত্র আরিফ, তার ভ্রাতৃষ্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত সাহেবের নাতনি বাবু ও আত্মীয় রেন্টু এবং আমার বড় ভাই শেখ ফজলুল হক মণিকে। আরো হারিয়েছি বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা প্রহরী কর্নেল জামিলকে। তিনি ৩২ নম্বর বাড়ি আক্রান্ত হবার খবর শুনে বাধা দিতে গিয়ে শহীদ হন। এতগুলো মৃত্যুর, এতগুলো স্বজন হননের রক্তোর বন্যায় আজ আপন সত্তা ও বিবেক ষৃণার অনলে জ্বলে ওঠে। অশ্রæ সে তো কবেই শুকিয়ে গিয়ে মরু হয়ে গেছে। তবুও প্রশ্ন থাকে। বিবেক ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল, মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল যে কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা সরকার কি করে এতা বড় একটা অন্যায় মেনে নিতে পারেন!

মণি ভাইয়ের সেই মৃত্যুকালীন জিজ্ঞাসা-‘কী অন্যায় করেছি আমি’ এখনো আমার কানে বাজে। কানে বাজে ভাবির সেই শেষ আর্তনাত- ‘আমাকে বাঁচান, আমার দু’টো বাচ্চা আছে’।

 

 

একুশে সংবাদ /এসএম

মতামত বিভাগের আরো খবর