সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

আইনগত সহায়তা করুণা নয়, অধিকার

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৯:০২ পিএম, ৪ মে, ২০২৪

প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়। ২৮ এপ্রিলকে দিবসের জন্য বেছে নেওয়ার কারণ হলো—‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ এ দিনে কার্যকর হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশে আইনগত সহায়তা দিবস উদ্যাপিত হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ‘Law Day’ ও ‘Legal Services Day’ দুটিই উদ্যাপিত হয়। জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস, ২০২৪-এর প্রতিপাদ্য হলো, ‘স্মার্ট লিগ্যাল এইড, স্মার্ট দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’।

বাংলাদেশের ‘আইনগত সহায়তা’র ধ্যানধারণা কাঠামোগতভাবে নতুন হলেও সাংবিধানিক আইনের ইতিহাসে এটি বেশ পুরোনো। রাষ্ট্র পরিচালনার অপরিহার্য মূলনীতি হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(১) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে।’ আবার নাগরিকদের রক্ষাকবচ হিসেবে খ্যাত ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ সাংবিধানিক তত্ত্ব অনুযায়ী ধনী-দরিদ্রকে এক কাতারে আনা হলেও বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। অর্থনীতি ও প্রাচুর্য মানুষকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে, যার একটি হলো ধনী এবং অন্যটি হলো দরিদ্র। ধনী ও সচ্ছল মানুষের পক্ষে আইনের আশ্রয় লাভ করা যতটুকু সহজ, দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষের পক্ষে ঠিক ততটুকুই কঠিন। সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, যারা আর্থিক অসামর্থ্যের কারণে কিংবা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে আইনের আশ্রয় লাভের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদেরকে ন্যায়বিচারে প্রবেশে সক্ষম করার জন্যই আইনগত সহায়তাব্যবস্থা। গরিব ও নিঃস্ব  মানুষ যাতে আর্থিক দৈন্যের কারণে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার থেকে কোনোভাবে বঞ্চিত না হয়, তার জন্য লিগ্যাল এইড ব্যবস্থার সৃষ্টি। শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে একমাত্র আইন-আদালতের মাধ্যমেই মানুষ তার নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু দারিদ্র্য বা অর্থের অভাবে কেউ যদি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের আশ্রয় লাভ করতে না পারে, তবে তার অন্য সব মৌলিক অধিকারও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

আর্থিক দৈন্য বা অসচ্ছলতা একজন মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনোভাবেই প্রতিবন্ধক হতে পারে না। ১৯৬৮ সনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিখ্যাত মামলায় (Jackson v. Bishop, Eight Circuit Court of Appeal, USA) বিচারক Harry Blackmun বলেন, ‘The concept of seeking justice cannot be equated with the value of dollars. Money plays no role in seeking justice.’ ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি P N Bhagwati-র মতে, ‘তিনটি জিনিসের অভাব দেখা দিলে গরিবরা তাদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এগুলো হলো :১. সচেতনতা, ২. অধিকার দাবি করা এবং ৩. সম্পদের অপ্রতুলতা।’

আইনগত সহায়তাকে এতদিন রাষ্ট্রের দান বা বদান্যতা মনে করা হলেও আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেছে। গরিব, অসহায় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আইনি সহায়তা দান করা এখন আর রাষ্ট্রের করুণা বা বদান্যতা নয়। বরং এটি নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের এক অপরিহার্য দায়িত্ব। বর্তমানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে আইনগত শিক্ষার প্রসার, আইনগত তথ্য সহজলভ্যকরণ, আইনগত ক্ষমতায়ন, ন্যায়বিচারে সহজ অভিগম্যতা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ইত্যাদিকে আইনগত সহায়তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম এগিয়েছে অনেকখানি কিন্তু এখনো যেতে হবে বহুদূর। বাংলাদেশে দরিদ্রবান্ধব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। হাতেগোনা যে দু-একটি প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে, তার মধ্যে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা অন্যতম। ইদানীংকালে সংস্থার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে ঘিরে দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের মাঝে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা যেন কোনোভাবেই ভেঙে না পড়ে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে কার্যকর ও মানসম্মত আইনি সেবা নিশ্চিত করা সংস্থার জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ-পদ্ধতিতে মামলা বা বিরোধের নিষ্পত্তিকেও সংস্থার কার্যপরিধির মধ্যে আনা হয়েছে। মামলাজট ও মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে। এ দুটি এখন দেশের বিচার বিভাগের প্রধান একটি সমস্যা। এমনকি দাদার আমলে দায়ের করা মামলা অনেক ক্ষেত্রে নাতির জীবদ্দশায়ও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এভাবে বিরোধভুক্ত পরিবারগুলো বংশানুক্রমে মামলা বা বিরোধ বহন করে চলেছে, যা সমাজের জন্য খুবই নেতিবাচক। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে সৃষ্ট সব বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কেবল আদালতের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কুফল আমরা এখন ভোগ করছি। ছোটখাটো ও আপসযোগ্য বিরোধসমূহ আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কিংবা মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধানের জন্য লিগ্যাল এইড অফিস একটি আদর্শ স্থান হতে পারে। লিগ্যাল এইড অফিস আদালতের ছায়া হিসেবে কাজ করতে পারে। আইন-আদালতের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে লিগ্যাল এইড অফিসের মধ্যস্থতায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধীয় পক্ষগণ নিজেরাই বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে পারেন। এতে পক্ষগণের অর্থ ও সময়—দুটিরই সাশ্রয় হয়। আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তিকৃত সমাধানে কোনো পক্ষই হারে না, বরং উভয় পক্ষই জেতে। এ কারণে কার্যকর বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির স্বার্থে লিগ্যাল এইড অফিসের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আইনগত সহায়তা প্রদান করা রাষ্ট্রের কোনো দান বা বদান্যতা নয়, বরং এটি অসচ্ছল ও দরিদ্র মানুষের অধিকার। রাষ্ট্র নাগরিকের এ অধিকার রক্ষা করতে সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও দেশের মানুষকে এ অধিকার ফিরে পেতে বহু বছর, যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের গৃহীত নানা মুখী উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। স্বল্পতম সময়ে সরকারি আইনি সহায়তা কর্মসূচির যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখা প্রয়োজন। এজন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, বিচারক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, পেশাজীবী সংগঠনসমূহকে নব উদ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি আইনি সেবার এ বার্তা অসহায়, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নিকট পৌঁছে দিতে হবে।

 

একুশে সংবাদ/ই.ফ.প্র/জাহা 
 

মতামত বিভাগের আরো খবর