সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

এবছর এত গরমের কারণ কী?

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৮:৪৯ পিএম, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

ঈদ-পরবর্তী জীবনে ফিরতে গিয়ে জনগণ যে কতটা হোঁচট খেয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দিনের গড় তাপমাত্রা দেশজুড়ে এখন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মের তীব্রতা নতুন কিছু নয়। তবে বৈশাখ শুরু হতে না হতেই গ্রীষ্মের এমন রূপ সত্যিই উদ্বেগজনক।

গরমের সঙ্গে জীবনকে মানিয়ে নেওয়া সমাজের এক শ্রেণির মানুষের জন্য হয়তো বিরক্তি থেকে অস্বস্তি উদ্রেকে গিয়ে থেমে যায়। তবে সাধারণ মানুষের জন্য, যাদের রিকশা চালাতে হয়, ভাঙতে হয় ইট কিংবা কাজ করতে হয় উন্মুক্ত ফসলের মাঠে, তাদের যে পালানোর উপায় নেই। এসব মানুষের জন্যই ভাবনা বেশি।

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০২১ সালে ‘ফিজিওলজি রিপোর্টস’ জার্নালে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা বলছে, ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করলে মানবদেহের বিপাক বা মেটাবলিজমের হার দ্রুততর হয়। দেহকে শীতল করার প্রয়াসেই এটি ঘটে থাকে। এ কারণে দেহের অন্য সাধারণ ক্রিয়াকর্ম ব্যাহত হতে শুরু করে। স্নায়বিক কেন্দ্র আর মস্তিষ্ক প্রথমে শ্লথ হয়। এর পর অন্যান্য অঙ্গে স্ফীতি দেখা দিতে পারে। ফলে দেহের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। শিশুদের স্নায়ুকেন্দ্র আংশিক গঠিত থাকে, আর ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের জন্য তা হতে থাকে ক্ষয়িষ্ণু। তাই শিশু ও প্রবীণদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তাপদাহের সময় সবচেয়ে বেশি।

প্রশ্ন হচ্ছে, এবারের অতি গরমের কারণ কী? গরম কি আরও বাড়তে পারে? গ্রীষ্মের রুষ্টতার অবসান হতে পারে কবে? পৃথিবী উত্তপ্ত হওয়ার সঙ্গে যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সম্পর্ক রয়েছে, সে বিষয়ে আমরা মোটামুটি অবগত। উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডের ফলাফল হিসেবে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে সঞ্চিত হওয়ার কারণে পৃথিবী থেকে নির্গমনমুখী বিকিরিত রশ্মি এসব গ্যাস দ্বারা শোষিত হয়। এ কারণে বায়ুমণ্ডল থেকে প্রত্যাবর্তিত বিকিরণ বা ‘ব্যাক রেডিয়েশন’ বেড়ে যায়। উত্তপ্ত হয় পৃথিবী। তবে উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব হিসেবে হালে সমুদ্রপৃষ্ঠের দুটি বিশেষ সংঘটনের পৌনঃপুনিকতা ও তীব্রতা বেড়েছে। এ সংঘটন দুটি হলো এল নিনো ও লা নিনা। পৃথিবীর আবহাওয়ার ওপর এল নিনোর প্রভাব লা নিনার চেয়ে বেশি গুরুত্ববহ। ভারত উপমহাদেশের এ বছরের গ্রীষ্মের পেছনের কারণ হিসেবে এল নিনোকেই দায়ী করা হচ্ছে।

প্রশান্ত মহাসাগর পৃথিবীপৃষ্ঠের সর্বাধিক অংশজুড়ে বিরাজ করে। এল নিনো-নিরপেক্ষ বছরে প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ স্রোত পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরে যায়। ফলে সমুদ্রের গভীর থেকে শীতল জল পৃষ্ঠদেশে উঠে আসে এবং পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঠান্ডা রাখে। তবে মহাসাগরীয় স্রোত যদি শ্লথ হয় তাহলে শীতল জল সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসতে পারে না। ফলে সমুদ্র উষ্ণ হতে শুরু করে। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের এই উষ্ণায়নের ফল এল নিনো, যার কারণে ভারত উপমহাদেশে বৃষ্টিপাত কমে যায় ও তাপমাত্রা বাড়ে। এল নিনোর এই সংঘটন প্রতি দুই থেকে সাত বছর অন্তর হলেও এর চরমাবস্থা সাধারণত ঘটে প্রতি দুই দশকে একবার। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগরীয় ও বায়ুমণ্ডলীয় প্রশাসন (এনওএএ) বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এখন থেকে প্রতি দশকে একবার চরম এল নিনোর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসকে গত ১৭৫ বছরের মধ্যে উষ্ণতম জানুয়ারি বলে উল্লেখ করেছে। যেহেতু ডিসেম্বর-জানুয়ারির দিকে প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্র স্রোতের তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে এল নিনোর প্রভাব চোখে পড়ে, সে কারণে এ বছরের এল নিনোও চরম বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, ২০২৪ সালে এল নিনো ইতিহাসের পাঁচটি চরম এল নিনোর একটি। আবহাওয়া অধিদপ্তর আরও বলেছে, এপ্রিল ও মে মাসের প্রায় পুরোটা জুড়ে এর প্রভাব অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ তাপদাহের এ অচলাবস্থা চলবে।

এল নিনোর তীব্রতা যখন কমে যেতে থাকে তখন দেখা দেয় সমুদ্র স্রোতের অন্য পিঠ, অর্থাৎ লা নিনা। ১৯৫০ সাল থেকেই তীব্র এল নিনোর বছরের পর লা নিনার সংঘটন পর্যবেক্ষিত হয়েছে। লা নিনার সময় পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর দ্রুত শীতল হয়। এর ফলে ভারত উপমহাদেশে বৃষ্টিপাত বাড়ে। অর্থাৎ এ বছরের মে মাসের শেষ থেকে বৃষ্টি শুরু হবে। বর্ষণ তীব্রতর হতে পারে; দীর্ঘ তাপদাহের পর দীর্ঘ বর্ষা। জুলাই-আগস্টের দিকে বন্যার আশঙ্কাও তাই বাড়ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাংলাদেশের অবদান সামান্য হলেও এর বিরূপ প্রভাবের শিকার দেশের তালিকায় আমরা ওপরের দিকে। একদিকে তাপদাহের দুঃসহ যাতনা, অন্যদিকে বন্যার জলে নিমজ্জন। এ পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার ছাড়া আমাদের উপায়ই বা কী?

বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে যদি অদৃষ্ট ধরি, তবে একে জয় করার মন্ত্র হয়তো একটিই– অন্যের হিতসাধন।

রুষ্ট প্রকৃতিকে অতিক্রমণের এই কঠিন যাত্রাপথে তাই অন্যের উপকারে ব্রতী হওয়া এবং উপকার গ্রহণের মন্ত্রণা থাকা জরুরি। পথে কাউকে পীড়িত বা ক্লান্ত দেখলে তার সাহায্যে আমাদেরই এগিয়ে যেতে হবে।


একুশে সংবাদ/স.ল.প্র/জাহা

 

মতামত বিভাগের আরো খবর