সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস:

নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যয়ের প্রতি মালিকপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৫:২০ পিএম, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

আজ রবিবার ২৮ এপ্রিল আন্তর্জাতিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস ২০২৪। ২০০৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দিবসটি পালন করে আসছে।এ বছর ৮ম বারের মতো দিবসটি পালন করবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

 ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধস ও ব্যাপক প্রাণহানির পর বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকে। মূলত রানা প্লাজা ধসের বিষয়টি স্মরণে রেখে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার, আহত বা নিহত শ্রমিকদের পেশাগত ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৬ সাল থেকে দিবসটি পালন হয়ে আসছে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সব শেষ ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, দেশে মোট শ্রমশক্তি রয়েছে পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতে কাজ করে ৪০ লাখ শ্রমিক। এই পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, বিপুলসংখ্যক শ্রমিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে।

শ্রম আইন ২০০৬ এর ৫১ হতে ৯৯ ধারা সমূহে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। শ্রম আইনের উক্ত ধারা সমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কলকারখানা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, শ্রমিকদের যাতে স্বাস্থ্য হানি না ঘটে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ও যথাযথ তাপমাত্রা বজায় রাখা, প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য অন্তত ৯.৫ কিউবিক মিটার পরিমাণ জায়গার ব্যবস্থা করা, পান করার জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা, মহিলা এবং পুরুষ শ্রমিকদের জন্য পৃথকভাবে সৌচাগার ও প্রক্ষালণ কক্ষের ব্যবস্থা করা মালিকের দায়িত্ব। একই সাথে শ্রমিকের ক্ষতি হতে পারে এমন কোন ভারী জিনিস উত্তোলন, বহন অথবা নাড়াচাড়া করতে না দেয়ার ব্যাপারেও শ্রম আইনে উল্লেখ রয়েছে।

শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অগ্নি দুর্ঘটনার কারণে অথবা অন্য কোন জরুরি প্রয়োজনে বহির্গমনের জন্য প্রত্যেক তলার সাথে সংযোগ রক্ষাকারী অন্তত একটি বিকল্প সিঁড়িসহ বহির্গমনের উপায় এবং প্রত্যেক তলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা উচিৎ।

কাজ চলাকালীন প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে কোন কক্ষ হতে বহির্গমনের পথ তালাবদ্ধ বা আটকে রাখা যাবে না। কোন দরজা স্লাইডিং টাইপের না হলে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তা বাইরের দিকে খোলা যায়, অথবা যদি কোন দরজা দুটি কক্ষের মাঝখানে হয়, তাহলে তা ভবনের নিকটতম বহির্গমন পথের কাছাকাছি দিকে খোলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বহির্গমনের পথ বাধাগ্রস্ত কিংবা পথে কোন প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করা যাবে না।

প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে সাধারণ বহির্গমনের জন্য ব্যবহৃত পথ ব্যতীত অগ্নিকাণ্ডকালে বহির্গমনের জন্য ব্যবহার করা যাবে- এরূপ প্রত্যেক জানালা, দরজা বা অন্য কোন বহির্গমন পথ স্পষ্টভাবে লাল রং দ্বারা বাংলা অক্ষরে অথবা অন্য কোন সহজবোধ্য প্রকারে চিহ্নিত করতে হবে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে, এতে কর্মরত প্রত্যেক শ্রমিককে অগ্নিকাণ্ডের বা বিপদের সময় তৎসম্পর্কে হুঁশিয়ার করার জন্য, স্পষ্টভাবে শ্রবণযোগ্য হুঁশিয়ারী সংকেতের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কক্ষে কর্মরত শ্রমিকগণের অগ্নিকাণ্ডের সময় বিভিন্ন বহির্গমন পথে পৌঁছার সহায়ক একটি অবাধ পথের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পঞ্চাশ বা ততধিক শ্রমিক/কর্মচারী সম্বলিত কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার অগ্নিনির্বাপণ মহড়ার আয়োজন করতে হবে, এবং এই বিষয়ে মালিক কর্তৃক নির্ধারিত পন্থায় একটি রেকর্ড বুক সংরক্ষণ করতে হবে।

কোন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক যদি দেখতে পান যে, উহার কোন ভবন বা যন্ত্রপাতি বিপজ্জনক অবস্থায় আছে এবং তা যে কোন সময় কোন শ্রমিকের শারীরিক জখম প্রাপ্তির কারণ হতে পারে, সে ক্ষেত্রে তিনি অবিলম্বে লিখিতভাবে মালিককে অবহিত করবেন। মালিক অবহিত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে তৎসম্পর্কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে এবং উক্ত ভবন বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে কোন শ্রমিক যদি জখম প্রাপ্ত হন তাহলে মালিক, অনুরূপ জখম প্রাপ্ত শ্রমিককে দ্বাদশ অধ্যায়ের অধীন উক্তরূপ জখমের জন্য প্রদেয় ক্ষতিপূরণের দ্বিগুণ হারে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন।

কোন কর্মক্ষেত্র বিশেষ করে যন্ত্রপাতি বা কাজের ধরন ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে, নিয়োগ কর্তাকে সর্বপ্রথমে ঝুঁকি সমূহ দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে শ্রমিকদেরকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় সচেতনতার অভাবে কিংবা অনভ্যাসের কারণে শ্রমিকরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতে অনীহা প্রকাশ করে। তাই শ্রমিকদেরকে ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি ব্যবহারের গুরুত্ব অবহিত করণ পূর্বক নিয়মিত প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমন শ্রমিকদের নিয়মিত মেডিকেল চেকআপের মধ্যে রাখতে হবে। যদি কোন শ্রমিক পেশাগত রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক চিকিৎসার ব্যবস্থা করাতে হবে। এমন কি কোন প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কর্মরত নয় কিন্তু পূর্বে কাজ করার কারণেও যদি কোন শ্রমিক পেশাগত রোগে আক্রান্ত হন অথবা আক্রান্ত হয়েছে বলে মনে হয়, তাহলে শ্রম আইনের ধারা ৮২(২) মতে উক্ত শ্রমিকের চিকিৎসার দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তার। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কোন নতুন নিয়োগ দেয়ার আগে ঝুঁকি সম্পর্কে শ্রমিককে অবহিত করে নিয়োগ দান করা প্রত্যেক নিয়োগ কর্তার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শ্রম আইনের ১৫১ ধারা ও তফশীল ৫ অনুসারে কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত কারণে শ্রমিক মারা গেলে ২ লক্ষ টাকা এবং স্থায়ীভাবে সম্পূর্ণ কর্ম অক্ষম হলে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, আংশিক অক্ষম হলে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার আনুপাতিক হারে ক্ষতিপূরণ, অস্থায়ীভাবে কাজ করতে অক্ষম হলে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত শ্রমিক মজুরি পাবে। তবে প্রথম ২ মাস পূর্ণ মজুরি, পরবর্তী ২ মাস দুই তৃতীয়াংশ এবং পরবর্তী ৮ মাস অর্ধেক হারে মজুরি পাবে। আবার পেশাগত রোগে আক্রান্ত হলে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত অর্ধেক হারে মজুরি পাবে। কিন্তু শ্রম আইনে বর্ণিত ক্ষতিপূরণ সমূহ আন্তর্জাতিক মানের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই শ্রম আইনে বর্ণিত প্রদেয় ক্ষতিপূরণের পরিবর্তে  এর ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা উচিৎ বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে। এই ধরনের ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক প্রস্তাবিত  বাস্তবায়ন খুবই জরুরি বলে মনে করি।

জাতিসংঘ ২০১৬ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নির্ধারিত সময় সীমার এক তৃতীয়াংশ সময় অতিবাহিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্যের ৮ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে শোভন কাজ বাস্তবায়ন। শোভন কাজের অন্যতম শর্ত হচ্ছে কর্মক্ষত্রে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা

> নিয়োগ কর্তার লক্ষনীয় বিষয়:-

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা এবং নিরাপত্তা সুবিধা প্রতিটি শ্রমিকের বৈধ এবং আইনগত অধিকার। শ্রমিকদেরকের একটি নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর কর্ম পরিবেশ প্রদান করতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপদ পরিবেশের অনুশীলন উন্নত করতে হবে।  শ্রম আইন ২০০৬ এর অধীনে অন্তর্ভুক্ত পেশাগত স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো হলঃ পরিচ্ছনতা, বায়ু চলাচল এবং তাপমাত্রা ব্যবস্থা, কৃত্তিম আর্দ্রকরণ, জনবহুলতা, আলোর ব্যবস্থা, অগ্নি সংক্রান্ত ঘটনা, অতিরিক্ত ওজন, বিল্ডিং এবং যন্ত্রপাতির সুরক্ষা, যন্ত্রপাতিকে ঘেরাও করা, চলমান যন্ত্রপাতির উপর বা কাছাকাছি কাজ করা, বিস্ফোরক বা দাহ্য গ্যাস ও ধুলা, বিপজ্জনক ধোয়ার বিরুদ্ধে সতর্কতা, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা।(শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ৫১-৯৯, সংশোধিত ২০১৩)              

> পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার উদ্দেশ্য হলো-

ক) সকল পেশার কর্মীরা শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে কল্যাণ সাধন করে পদোন্নতি লাভ করবেন।

খ) কাজের পরিবেশের কারণে কর্মীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রতিরোধ করা।

গ) বিপজ্জনক কাজ বা ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে কর্মীদের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে। 

ঘ) কর্মীদের শারীরিক এবং মানসিক সামর্থ্য অনুসারে পেশাগত পরিবেশ তৈরি এবং ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন।

> কর্মীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা

স্বাস্থ্যই সকল স্যুখের মূল। একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকলে তারা মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারে না। ফলে কাজে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং কাজে অনুপস্থিতির হার বেড়ে যায়। ফলে কর্মী এবং মালিক উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং কর্মী, প্রশাসন এবং মালিকপক্ষের সকলকেই স্বাস্থ্য সচেতন থাকা একান্ত আবশ্যক।

> স্বাস্থ্যবিধি

স্বাস্থ্যবিধি হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞান যা আমাদেরকে অসুস্থ হওয়ার পূর্বে তার প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করে থাকে। একজন মানুষের শারীরিক, মানসিক, পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক অবস্থার পূর্ণাঙ্গ সুস্থ জীবনই হলো ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি যেমনভাবে আমাদের নিরাপদ রাষ্ট্রে তেমনভাবে অন্যদেরকেও অসুস্থ হওয়া থেকে নিরাপদ রাখে। 

> পেশাগত রোগসমূহ

কর্মস্থলের পরিবেশ এবং কাজের ধরনের কারণে কর্মরত অবস্থায় একজন কর্মী যে সকল রোগ বা ব্যধিতে আক্রান্ত হয় বা হতে পারে তাদেরকে পেশাগত রোগ বলা হয়। নিম্নে কতিপয় পেশাগত রোগের নাম উল্লেখ করা হলো-

১. চর্মরোগ ২. শ্বাসতন্ত্রের রোগসমূহ ৩. পেশী ও হাড়ের ব্যাধিসমূহ ৪. শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস  ৫. ক্যানসার ৬. সে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাসমূহ  ৭. সংক্রামক রোগসমূহ 

> পেশাগত রোগের কারণসমূহ

কর্মরত অবস্থায় একজন শ্রমিক বা কর্মচারি সাধারণত ৩টি কারণে অসুস্থতায় ভুগতে পারে-

১. কর্মস্থলের পরিবেশ সংক্রান্ত: বিশৃঙ্খলা, উচ্চ শব্দ, উচ্চ তাপমাত্রা, পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের অভাব, পর্যাপ্ত আলোর অভাব এবং ধূলাবালির কারণে একজন কর্মী নানারকম রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যেমন- দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, প্রবণশক্তি কমে যাওয়া, ফুসফুস সংক্রান্ত রোগ, যক্ষা, শ্বাসনালীর প্রদাহ ইত্যাদি।

২. কর্মীসংক্রান্ত: প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, নির্দেশিকা সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাব, বয়স ও দৈহিক সামর্থের অভাবেও নানা রকম অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।

৩. মানসিক অস্যুস্থতা: কর্মক্ষেত্রে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সহকর্মীদের আচার-আচরণ, বৈষম্য, চাকুরির অনিশ্চয়তা, অতিরিক্ত কাজের চাপ, দীর্ঘ কর্মঘন্টা, অকারণে হয়রানি, নির্যাতন ইত্যাদি একজন কর্মীর উপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে যা তার কর্মক্ষেত্রের উৎসাহ ও উদ্দীপনা কমিয়ে দেয় এবং কাজের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে ধীরে ধীরে একসময় সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।

>  স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শ্রম বিধিসমূহ

প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং কোনো নর্দমা, পয়ঃবর্জ্য বা অন্য কোনো জঞ্জাল হতে সৃষ্ট দুষিত বাষ্প হতে মুক্ত রাখতে হবে এবং বিশেষ করে-

(ক) প্রতিষ্ঠানের মেঝে, কর্মকক্ষ, সিঁড়ি, যাতায়াতের পথ হতে প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে ময়লা ও আবর্জনা ঢাকনা দেওয়া বাক্সে অপসারণ করতে হবে, যাতে উক্ত আবর্জনা দুর্গন্ধ বা জীবাণু বিস্তার করতে না পারে। ধাতব পদার্থ, উৎকট গন্ধময় আবর্জনা, রাসায়নিক আবর্জনা ও মেডিকেল আবর্জনা ভিন্ন ভিন্ন বক্সে প্রতিদিন নিয়মিত অপসারণ করতে হবে।

(খ) প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রের মেঝে সপ্তাহে অন্তত একদিন অবস্থাভেদে এবং কাজের প্রকৃতি ভেদে পানি দ্বারা ধুতে হবে এবং প্রয়োজনে ধোয়ার কাজে জীবানু নাশক ব্যবহার করতে হবে। অবস্থাভেদে জীবাণুনাশক ব্যবহার করে ভিজা কাপড় দ্বারা মেঝে ধুয়ে দিতে হবে।

(গ) যেক্ষেত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়ার কারণে কোনো মেঝে এমনভাবে ভিজে যায় যে, এর জন্য পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।

• উক্ত মেঝে অবশ্যই অভেদ্য পদার্থ দ্বারা নির্মিত হতে হবে। 

• উক্ত মেঝের নির্মাণকৌশল ঢালুবিশিষ্ট এবং উপযুক্ত নিষ্কাশন নালার মাধ্যমে কারখানার মূল নর্দমা ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে, যাতে নিষ্কাশিত পানি অথবা কোনো তরল পদার্থ মেঝেতে জমে থাকতে না পারে।

(ঘ) প্রতিষ্ঠানের সকল অভ্যন্তরীণ দেওয়াল, পার্টিশন, ছাদ, সিঁড়ি, যাতায়াতপথ-

• রং অথবা বার্নিশ করা থাকলে, প্রতি তিন বছরে অন্তত একবার 

• পুনরায় রং বা বার্নিশ করতে হবে। রং অথবা বার্নিশ করা এবং 

• বহির্ভাগ মসৃণ হলে, প্রতি চৌদ্দ মাসে অন্তত একবার পানি, ব্রাশ ও ডিটারজেন্ট দ্বারা ঘষে পরিষ্কার করতে হবে।

অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতি চৌদ্দ মাসে অন্তত একবার চুনকাম বা রং করতে হবে।

 (ঙ) উক্ত কার্যক্রমের যাবতীয় রেকর্ডসমূহ নির্ধারিত রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে।

> কর্মক্ষেত্রে বায়ু চলাচল ও তাপমাত্রা

প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মকক্ষে নির্মল বায়ু প্রবাহের জন্য পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা রাখতে হবে।

উক্তরূপ প্রত্যেক কক্ষে তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে এবং প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মকক্ষে নির্মল বায়ু প্রবাহের সুবিধার্থে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিপরীতমুখী জানালার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে শর্ত থাকে যে, যেখানে ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা রাখা সম্ভব নয় সেখানে নিষ্কাশন পাখা স্থাপন করা যাবে, যাতে সেখানে কর্মীগণ মোটামুটি আরামে কাজ করতে পারেন, যাতে কর্মীগণের স্বাস্থ্যহানি রোধ হয়। আরও শর্ত থাকে যে, কর্মক্ষেত্রে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলে বায়ুচলা চলের উক্ত ব্যবস্থার প্রয়োজন হবেনা। প্রত্যেক কর্মকক্ষে অন্তত একটি তাপ পরিমাপকযন্ত্র (থার্মোমিটার) সচল অবস্থায় রাখতে হবে এবং ইহা যথাযথ মান সম্পন্ন হতে হবে এবং কর্মকক্ষের দেয়ালের দৃশ্যমান স্থানে ইহা স্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনে কক্ষের দেওয়াল এবং ছাদ এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যাতে উক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি না পায় এবং যতদূর সম্ভব কম থাকে।

> কর্মীর সংখ্যা

• প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকক্ষে কর্মরত শ্রমিকগণের স্বাস্থ্যহানি হয় এই প্রকার অতিরিক্ত কর্মী এক সাথে করা যাবে না।

• প্রত্যেক কর্মকক্ষে কর্মরত প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য অন্তত ৯.৫ কিউবিক মিটার পরিমাণ জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে (কোনো ঘরের উচ্চতা মেঝে হতে ৪.২৫ মিটারের অধিক হলে এটি বিবেচনায় আনা হবেনা)। 

• যদি প্রধান পরিদর্শক লিখিত আদেশ দ্বারা কোনো মালিককে অনুরোধ করে তাহলে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কর্মকক্ষে সর্বোচ্চ কতজন লোক কাজ করতে পারবেন, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা একটি নোটিশ বোর্ডে দিতে হবে।

প্রধান পরিদর্শক লিখিত আদেশ দ্বারা কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকক্ষকে অনুমতি দিতে পারবেন, যদি তিনি এইমর্মে সন্তুষ্ট হন যে, তাতে কর্মরত শ্রমিকগণের স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে এই বিধান মানার প্রয়োজন নেই।

> আলোর ব্যবস্থা

• কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক অংশে, যেখানে শ্রমিকগণ কাজ করে বা যাতায়াত করেন, যথেষ্ট, স্বাভাবিক,

• কৃত্রিম বা উভয়বিধ আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।

• প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কর্মকক্ষ আলোকিত করার জন্য ব্যবহৃত সকল কাঁচের জানালা এবং ছাদে বসানো

• জানালা সমূহের উভয়পার্শ্ব পরিষ্কার রাখতে হবে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে- কোনো স্বচ্ছ পদার্থ বা বাতি হতে বিচ্ছুরিত বা প্রতিফলিত আলোকচ্ছটা অথবা

• কোনো শ্রমিকের চোখের উপর চাপ পড়তে পারে বা তার দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকতে পারে, এরূপ কোনো ছায়াসৃষ্টি, প্রতিরোধ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে।

> খাবার পানির ব্যবস্থা

• প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল শ্রমিকের পান করার জন্য কোনো সুবিধাজনক স্থানে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে সংরক্ষণ করতে হবে।

• প্রত্যেক পানি সরবরাহের স্থানকে বাংলায় ‍‍`পান করার পানি‍‍` কথাগুলি স্পষ্টভাবে লিখে চিহ্নিত করতে হবে।

• যেসমস্ত প্রতিষ্ঠানে সাধারণত দুইশত পঞ্চাশ জন বা ততোধিক শ্রমিক নিযুক্ত থাকেন, সে সকল প্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালে পান করার পানি ঠান্ডা করে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে।

• মাত্রাতিরিক্ত তাপ উদ্রেককারী যন্ত্রের সন্নিকটে কাজ করার কারণে শ্রমিকের শরীরে পানি শূন্যতার সৃষ্টি হলে, ঐ সকল শ্রমিকের জন্য ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপির ব্যবস্থা করতে হবে।

> শৌচাগার ও প্রক্ষালন কক্ষ

প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকগণ কাজের সময়ে যাহাতে সহজে ব্যবহার করতে পারেন এরূপ সুবিধাজনক স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বাস্থ্য সম্মত শৌচাগার ও প্রক্ষালন কক্ষের ব্যবস্থা থাকতে হবে। 

• উক্ত শৌচাগার ও প্রক্ষালন কক্ষ পুরুষ এবং মহিলা কর্মীগণের জন্য স্বতন্ত্রভাবে ব্যবস্থা করতে হবে।

শৌচাগার ও প্রক্ষালন কক্ষ পুরুষ এবং মহিলা কর্মীগণের জন্য স্বতন্ত্রভাবে ব্যবস্থা করতে হবে।

উক্ত শৌচাগার ও প্রক্ষালন কক্ষ কারখানা মালিকের নিজ খরচে জীবাণুনাশক ও পরিষ্কারক ব্যবহারের

মাধ্যমে সবসময় পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে হবে।

> আবর্জনা বক্স

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রতি ১০০ জন শ্রমিকের জন্য :

একটি করে পৃথক আবর্জনা ও পিকদানি বক্স রাখতে হবে;

পিকদানি বালুভর্তি থাকতে হবে এবং এর উপরে ব্লিচিং পাউডার থাকতে হবে;

আবর্জনা বক্স প্লাস্টিকের তৈরি ও ঢাকনাসহ থাকতে হবে, এতে প্রতিদিন জমাকৃত আবর্জনা অপসারণ করতে হবে এবং উভয়ক্ষেত্রে জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে;

উক্ত পিকদানি ও আবর্জনা বক্স কর্মকক্ষের দরজার সন্নিকটে স্থাপন করতে হবে এবং এটি এমনভাবে

স্থাপন করতে হবে যাতে দুর্গন্ধ না ছড়ায় ও ময়লা আবর্জনা চোখে না পড়ে;

কোনো ব্যক্তি কোনো প্রতিষ্ঠানে পিকদানি ও আবর্জনা বক্স ব্যতীত অন্য কোথাও থুথু বা আবর্জনা ফেলবেনা এবং এই বিধান সম্পর্কে নোটিস কারখানার ভিতরে উপযুক্ত স্থানে সহজে দৃষ্টিগোচর হয় এমনভাবে টাঙ্গিয়ে রাখতে হবে।

> পেশাগত নিরাপত্তা 

যে কোনো প্রকার প্রতিকুল অবস্থাকে প্রতিরোধের মাধ্যমে নিরাপদের সাথে কাজ করাকে অকুপেশনাল সেফটি বা পেশাগত নিরাপত্তা বলে।

পেশাগত নিরাপত্তা তিন প্রকার, যথা-

১. ব্যক্তিগত নিরাপত্তা

দুর্ঘটনার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য যে সকল সাবধানতা মেনে চলা হয়, তাই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা শিল্প-কারখানায় কর্মীগণ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করে থাকে।

২. যন্ত্রপাতি ও মেশিনের নিরাপত্তা

যন্ত্রপাতির কোনো প্রকার ক্ষতি সাধন না করে কার্য সম্পন্ন করার পর বন্ধ করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হয়। অতঃপর সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়, এই কর্মকুশলতাই যন্ত্রপাতি ও মেশিনের নিরাপত্তা বিধান করে থাকে।

৩.যন্ত্রপাতি ও মেশিনের নিরাপত্তা পদ্ধতি:

• সঠিক নিয়মে মেশিন চালু করা; কাজ শেষে মেশিন অবশ্যই বন্ধ করা;

• কাজের জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা;

• কোনো প্রকার গোলযোগ দেখা দিলে সাথে সাথে মেশিন বন্ধ করা এবং দ্রুত মেরামত করা;

• বৈদ্যুতিক সংযোগসমূহ মাঝে মাঝে পরীক্ষা করা ইত্যাদি।

৩. কারখানার নিরাপত্তা 

সকল প্রকার দুর্ঘটনার হাত হতে ওয়ার্কশপকে রক্ষা করাকে ওয়ার্কশপের নিরাপত্তা বলে। যেমন-

• প্রয়োজনীয় প্রোটেকটিভ ডিভাইস সমেত সকল বৈদ্যুতিক সংযোগ ইনস্যুলেটেড রাখা;

• দাহ্য পদার্থের পাশে ওয়েল্ডিং ও গ্রাইন্ডিং না করা;

• আগুন নিভানোর উপকরণ, পানি, বালু ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখা;

• দৈবক্রমে আগুন লাগলে দ্রুত ফায়ার স্টেশনে খবর দেওয়া; কারখানার অভ্যন্তর ও বাহির সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।

>  ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম

ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সমূহ (Personal Protective Equipment - PPE): কর্মস্থলে কার্যাবস্থায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি হতে কর্মীকে বাঁচানোর জন্য যে সমস্ত সাজ সরঞ্জাম ও পোষাক পরিচ্ছদ ব্যবহার করা হয়, সেগুলিকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম বা পিপিই বলা হয়। একজন ব্যক্তির কোন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গকে সম্ভাব্য ক্ষতি বা দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করা হবে তার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম (পিপিই) নিম্নলিখিত ভাবে ভাগ করা যায়-

১.জাইন 

অতিরিক্ত তাপমাত্রা, খারাপ আবহাওয়া, ছিটকে আসা কোনো রাসায়নিক পদাৰ্থ ৰা খাতৰ খণ্ড, ভয়ানক গতিতে ৰায়ু প্রবাহ, সুচালো কোনো বস্তু শরীরে ঢুকে পড়া এবং ধুলাবালি ইত্যাদি থেকে কারখানার কর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য অ্যাপ্রন ব্যবহার করা হয়। অ্যাপ্রন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে, যথা- বয়লার স্যুট, রাসায়নিক স্যুট, ডেন্ট, অ্যাগ্র পুরো শরীর ঢাকা স্যুট, জ্যাকেট ইত্যাদি। ওয়ার্কশপে কাজ করার সময় নিয়ম মেনে সঠিক অ্যাপ্রন পরিধান করলে ধূলা, বালি, বিভিন্ন প্রকার লুব্রিক্যান্ট, ধাতব চিপস, আগুনের স্ফুলিঙ্গ ও ভাগ হতে জামা কাপড় ও শরীর সুরক্ষা পায়।

২.হ্যান্ড গ্লাভস 

অধিক তাপমাত্রা, সুঁচালো কোনো বন্ধু ভারী কোনো বস্তু, বৈদ্যুতিক শক, রাসায়নিক পদার্থ, চর্ম ক্ষয়কারক ইত্যাদি থেকে হাতকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করা হয়।

৩.সুরক্ষা জুতা 

ওয়ার্কশপে বা কর্মস্থলে পিচ্ছিল মেঝে, ভিজা মেঝে, ধারালো বস্তু, পড়ে থাকা বস্তু, রাসায়নিক স্পেস এবং অন্যান্য তরল পদার্থ ইত্যাদি থেকে পাও পায়ের পাতাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সুরক্ষা জুতা, সুরক্ষা বুট, লেগিনস্ (মোটা কাপড়ের তৈরি পায়ের আচ্ছাদন), প্যাট (পাতলা আচ্ছাদন) ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। সেফটি স্যুজ বা নিরাপদ জুতা ওয়েঙ্কার/কর্মাকে ভারী ধাত্তৰ উত্তপ্ত গলিত ধাতু, ধাঁরানো পড়ন্ত বস্তুর আঘাত থেকে রক্ষা করে। এমনকি, বৈদ্যুতিক শক্‌ থেকেও ওয়েদার বা কর্মীকে রক্ষা করে।

৪.সেফটি মাস্ক 

ওয়ার্কশপে অনেক সময় ধোঁয়া, বিষাক্ত গ্যাস, দুর্গন্ত ইত্যাদির সৃষ্টি হলে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এমন অবস্থায় ওয়ার্কশপে কাজ করতে হলে শ্বাস প্রশ্বাসের নিরাপত্তার জন্য গ্যাস মাস্ক ব্যবহার করতে হয়। কখনো ৰাভাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে অক্সিজেন মাস্ক ও ব্যবহার করা হয়। রোগ জীবাণু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, হাসপাতালে চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীগণ তিন স্তর বিশিষ্ট কাপড়ের মাস্ক, সার্জিক্যাল মাস্ক ও এন-১৫ মাস্ক পরিধান করে থাকেন।

৫.ইয়ার প্লাগ বা কানের সুরক্ষা উপাদান

কর্মক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবল এর অধিক হলে শব্দ দূষণের ফলে কানের ক্ষতি হতে পারে। ওয়ার্কশপে যেকোনো ধরনের উচ্চ মাত্রার শব্দ প্রতিরোধের জন্য ইয়ার নাফ, ইয়ার ডিফেন্ডার, ইয়ার প্লাগ ব্যবহার করলে শ্রবণযন্ত্র তথা কানের সুরক্ষা হয়।

৬.সেফটি গগলস বা চোখের সুরক্ষা সরঞ্জাম 

ওয়ার্কশপে মেশিন চলাকালীন ছিটকে আসা রাসায়নিক পদার্থ বা ধাতব বস্তু, ধুলোবালি, ক্যাটালিস্ট পাউডার, গ্যাস, বাষ্প এবং রেডিয়েশন, ওয়েল্ডিং এর সময় নির্গত ক্ষতিকর আলোকরশ্মি ইত্যাদি চোখে সরাসরি প্রবেশ করলে চোখের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। তাই এসব ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চোখের জন্য পিপিই যেমন- নিরাপদ চশমা, পালস, ফেস শি (মুখের ঢাকনা), ওয়েন্ডিং হেলমেট ইত্যাদি পরিধান করে ওয়ার্কশপের কর্মীদের কাজ করতে হবে। ওয়ার্কশপে গ্রাইন্ডিং, ড্রিলিং, টার্নিং, বোরিং, ওয়েন্ডিং ইত্যাদি কাজ করার সময় সেফটি গগলস অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।

> প্রশিক্ষন:-

একজন নিয়োগকর্তা তার অধীনস্ত কর্মীদেরকে স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার উপর একটি বাস্তব এবং প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষন প্রদান করতে এবং কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য একটি সুরক্ষিত এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে  বাধ্য থাকে। একজন নিয়োগকর্তাকে কর্মক্ষেত্রে প্রশিক্ষন প্রদানের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শারীরিক আঘাত, বিষক্রিয়া বা গুরুত্বর রোগের ঝুঁকি আছে এই ধরণের বিপদজনক অপারেশনের

ক্ষেত্রে, এটি নিয়োগকর্তার দায়িত্বের অধীনে পরে যে সেই অপারেশনে নিযুক্ত শ্রমিকের পর্যায়ক্রমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করা এবং কাজের জন্য উপযুক্ত হিসেবে প্রমানিত না হলে তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। এই ধরণের অপারেশন এবং বিপজ্জনক মেশিনের কাজের সাথে নিযুক্ত কর্মীদেরকে অবশ্যই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষন প্রদান করতে হবে এবং তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।(শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ৪০(১খ),৭৮(ক৩),৭৯(গ), সংশোধিত ২০১৩)                                                                   

আর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের বিধান অনুযায়ী যেসব  কল-কারখানা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ৫০ বা তার অধিক শ্রমিক নিয়োজিত আছেন, তাদের সেফটি কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু আইনের এসব বিধান অধিকাংশ কল-কারখানাই মানছে না, যার কারণে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছে।

কারখানা নির্মাণের চেকলিস্ট থাকে। চেকলিস্ট অনুযায়ী কারখানায় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ক্ষেত্রে বেশকিছু কাজ ও নিয়ম মানার বিষয় থাকে। এক্ষেত্রে কারখানা শুরুর আগের কিছু বিষয় থাকে, কিছু বিষয় কারখানা চলমান বা চালু অবস্থায় করতে হয়। এটা কারখানার ধরন ও অবস্থার আলোকে হয়ে থাকে। যেমন কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য ট্রেড লাইসেন্স, কারখানা লে-আউট প্ল্যান, পরিবেশ ছাড়পত্র, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশের জন্য রাস্তা, প্রয়োজনীয় জেনারেটর, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শ্রমিকদের প্রবেশ ও বহির্গমনসহ মালিকদের ২০১৫ সালের শ্রম আইন ও বিধি বিধানসহ কতগুলো পূর্বশর্ত মানতে হয়। এসব ঠিকঠাক করে কারখানা প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই), ফায়ার সার্ভিস ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (বিডা) যথাযথ কর্তৃপক্ষের তদারকি ও কার্যকর পরিদর্শন হলে কারখানার টেকসই পরিবেশ রক্ষা ও অগ্নির ঘটনা ও বিস্ফোরণসহ নানা ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।

শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে পরিদর্শনের আলোকে অগ্নি ও অন্যান্য দুর্ঘটনা নিরোধের বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনা করতে হবে। নিতে হবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, যাতে কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হয়। এটি করা না গেলে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি নেতিবাচকই থেকে যাবে। পোশাক রফতানিসহ আমাদের চামড়া রফতানি, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, জুতা ও বাইসাইকেলসহ রফতানি পণ্যগুলো বিদেশে নির্বিঘ্নে রফতানিতে যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, তাতে সব কারখানা ও তার পরিবেশের প্রতিবন্ধকতা দূরকল্পে সরকারি নীতিসহায়তা ও তদারকি আরো জোরদার করা উচিত।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের সবার মনে রাখতে হবে – জীবনের জন্য কাজ, কাজের জন্য জীবন নয়।

নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যয়ের প্রতি মালিকপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যয় মূলত মূলধনী খরচ বা বিনিয়োগ। এটা কখনোই অতিরিক্ত খরচ বা অপচয় নয়। নিরাপদ কর্ম পরিবেশ শুধু শ্রমিকের জীবন বাঁচায় না উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়ায়। ফলে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য যে কোন ধরনের খরচ বা বিনিয়োগ, দীর্ঘমেয়াদে তা শিল্পেরই লাভ। আন্তর্জাতিক পেশাগত ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিবসে রাষ্ট্র ও মালিক পক্ষ এ বিষয়টি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে এমনটিই সবার প্রত্যাশা।

লেখক, কলাম লেখক ও গবেষক 

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি 

 


একুশে সংবাদ/এস কে  

মতামত বিভাগের আরো খবর