সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

স্মৃতিসুধায় অনন্য রাসেল

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০১:৩৬ পিএম, ১৫ অক্টোবর, ২০২২

আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে  জন্মিলো এক শিশু ঘর আলো করে স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি দেখা দিলো তার ভালে। তখন হেমন্তকাল। সময়টা ১৮ অক্টোবর ১৯৬৪। নবান্নের নতুন ফসলের উৎসবে আগমন নতুন অতিথির। এ যেন বাঙ্গালীর আনন্দ, বাংলার আনন্দ। চারদিকে চলছে উল্লাস আর হৈ চৈ। বঙ্গবন্ধুর নীড়ে অতিথি এলো। আনন্দে মাতোয়ারা পরিবার, খাবে মিষ্টি, পায়েস আর দৈ।

 

ধানমন্ডির সেই  ঐতিহাসিক ও ভয়ানক ৩২ নম্বর রোডের বাসায় জননেত্রী শেখ হাসিনার রুমেই রাত দেড়টার সময় জন্ম হয় শেখ রাসেলের। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আদরের কনিষ্ঠতম সন্তানের আগমনে পুড়ো বাড়ি জুড়ে বয়ে যায় আনন্দের জোয়ার।  কিছুক্ষণ পরে ভাইকে নিজের ওড়না দিয়ে জড়িয়ে নেয় জননেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অত্যন্ত প্রিয় ভক্ত ছিলেন নোবেল বিজয়ী দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল। বাট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে এই শিশুর নামকরণ করা হয় শেখ রাসেল।

 

এই শেখ রাসেল ছিলো বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে আদরের কনিষ্ঠতম সন্তান। ধীরে ধীরে রাসেল বড় হতে শুরু করে। রাসেলের জন্মের পর পরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নানা কারণে জেলবাস করতে হতো। তাই এই ছোট্ট শিশুটি বাবার কাছাকাছি থাকার সময়টা খুব কমই পেয়েছে। এই আদুরে রাসেলের সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী ছিলো তার হাসুপা, মানে আজকের জননেত্রী শেখ হাসিনা। সারাদিনের বেশিরভাগ সময়েই রাসেল হাসু আপার সাথে থাকতো।

 

"আদর ভরা বুবু তুমি, যেওনা আমায় ছেড়ে অনেক অনেক ভালোবাসি, বলছি বারে বারে। রাসেলের কাছে হাসু আপা এতোটায় প্রিয় ছিলো যে সবসময় হাসু আপার চুলের বেণী ধরে টানতে পছন্দ করত। সত্যিকার অর্থে রাসেলের সবকিছুই একটু ব্যতিক্রম ছিলো। আর থাকবে নাই বা কেন? সে যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীর অতি আদরের কনিষ্ঠ পুত্র।

 

একবার হয়েছে কী? টমি নামে এক পোষা কুকুরকে রাসেল খুব ভালোবাসতো। সে ছিলো তার খেলার সাথী। একদিন খেলতে খেলতে টমি ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে আর তাতে রাসেল ভয় পেয়ে যায়। তখন সে তার বোন শেখ রেহেনাকে এসে বলে টমি তাকে বকা দিয়েছে। ভাইয়ের কথা শুনে সবাই হাসতে থাকে আর তাকে কোলে তুলে নেয়।

 

বাবা তুমি আমায় ছেড়ে,  
যাচ্ছ কেন চলে, 
কখন ফিরবে কথা দাও,
আমায় যাও বলে।

 

বাবাকে কাছে পাওয়ার সুযোগ তেমন ছিলোনা রাসেলের। তবে যখন কাছে পেতো বায়নার শেষ থাকতো না। আধো আধো বোলে কত কথায় না জমা থাকতো তার অন্তরে। খেলার ফাঁকে ফাঁকে  বাবাকে এক নজর হলেও দেখবে সে। ছোট বেলা থেকেই ফুটবল খেলতে পছন্দ করত সে। রাসেলের বয়স যখন ৭ ঠিক তখনি শেখ হাসিনার ঘরে জন্ম নিলো জয়। জয়কে পেয়ে তো রাসেল মহা খুশি। সে এক নতুন সঙ্গী পেল। ঠিক সেই সময়ে যুদ্ধ শুরু হয়।

 

     চারদিকে আতঙ্ক , থমথমে ভাব 
     রাসেল ভাবলো হচ্ছেটা  কী ?
      কেন আনন্দের এতো অভাব!        

 

দিনরাত প্রচন্ড  গোলাগুলির আওয়াজ। এই আওয়াজে শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের ঘুম ভেঙ্গে যেত। শিশু জয় বারবার কেঁপে কেঁপে উঠতো। আর এইসব ব্যাপারে রাসেল খুব সচেতন ছিলো। যখন সাইরেন বাজতো তখনসে তুলা নিয়ে জয়ের কানে গুঁজে দিতো। বুদ্ধিতে রাসেল ছিলো বরাবরই পাকা। 



    সারাদিন ছুটাছুটি, 
   মাছ ধরার কত কীর্তি
   পড়া নিয়েই ছিলো তার 
       দারুন আপত্তি।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি  স্কুলে যখন তাকে  ভর্তি করানো হলো তখন স্কুলে যাওয়া নিয়ে তার ছিলো যত আপত্তি।  মাঝে মাঝে স্কুলে যেতে চাইতো না। তাই তাকে পড়াতে এক ভদ্র মহিলাকে নিযুক্ত করা হয়।

 

রাসেল তার কাছেই পড়া শিখতো। এই ছোট্ট রাসেলের কী মহানুভবতা? ওই শিক্ষিকার সকল সুবিধা–অসুবিধার কথা সে খেয়াল রাখতো।

 

রাসেলের আচরণ ছিলো নেতৃত্ব সুলভ। ঢাকায় তার তেমন খেলার সাথী ছিলোনা। তবে টুঙ্গীপাড়ায় যখন বেড়াতে যেত সেখানে তার খেলার সাথীর অভাব হতোনা। সবাইকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারতো সে। খেলার সাথীদের এক জায়গায় জড় করে তাদের জন্য খেলনার বন্দুক বানাতো আর সেই বন্দুক হাতেই তাদের প্যারেড করাতো। আসলে রাসেলের পরিবেশটাই ছিলো এমন।

 

রাসেলের খুদে বাহিনীর জামা কাপড় ঢাকা থেকেই কিনে দিতে হতো। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করতো বড় হলে সে কী হবে? সে বলতো অফিসার হবে। বঙ্গবন্ধু যেসব পোষাক পছন্দ করতেন রাসেলেরও তেমন পোষাক পছন্দ। বিভিন্ন সময়ে বাবার সাথে প্রোগ্রামে গেলে রাসেলকে একটা প্রিন্স সুট বানিয়ে দিতো যাতে বাবার সাথে রাসেলকে সুন্দর মানায়।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপান বাংলাদেশকে নানা ভাবে সাহায্য করে। যুদ্ধ শেষে জাপান যখন বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে আমন্ত্রন জানায় তখন সেই সফরে রাসেল ও তার বোন রেহেনা জাপানে যায়। সেই সফরে রাসেলের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয় এবং রাসেল খুব খুশি মনে তা গ্রহণ করতো।

 

একবার বড় এক দুর্ঘটনায় রাসেলের পায়ে আঘাত পায়। অনেকদিন  পর্যন্ত পায়ের যন্ত্রনা পেতে হয়েছিলো তাকে। সেদিন রাসেলের বোন হাসুপা ছিলো জার্মানিতে। ইস সেদিন যদি রাসেল হাসুপার সাথে জার্মানিতে যেত।

 

সময়টা ১৯৭৫, আগস্টের কিছুদিন আগে। হাসুপা তার স্বামীর কাছে জার্মানি চলে যাবেন। সাথে বোন রেহেনা ও যাবে।  হাসুপা শেখ রাসেলকেও নিজের সঙ্গে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস রাসেলের শরীরের অবস্থা তেমন ভালো ছিলোনা বলে তার আর যাওয়া হয়নি। আর এটাই হয়তো বা রাসেলের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

 

সেই ১৫ আগস্টের দিনে  বঙ্গবন্ধুর অতি আদরের এই রাসেল সহ পুরো পরিবার  নিহত হলো ওই অত্যাচারী ঘাতকদের হাতে।

 

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

একুশে সংবাদ/এসএপি
 

সাহিত্য বিভাগের আরো খবর