সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

দায়বোধের সাংবাদিকতা এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব জনমত

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০২:৪৬ পিএম, ২৬ মার্চ, ২০২৪

যুদ্ধ ও সহিংসতার সংবাদ সংগ্রহ এবং প্রেরণের কারণে প্রাণ দিয়েছেন এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। আবার অনেকেই প্রাণসংহারের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নিজেকে বাঁচিয়ে যুদ্ধের প্রকৃত তথ্য গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন সাহসের সঙ্গে। যেসব সাংবাদিক সত্য প্রকাশে অঙ্গীকারবদ্ধ, তারা প্রকৃত তথ্য প্রকাশ থেকে কখনো পিছপা হন না। এমনও দেখা গেছে, ‘এম্বেডেড সাংবাদিকতা’ বা ‘স্পন্সর সাংবাদিকতা’র বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে বিবেকের দায় থেকে তারা গণহত্যাসহ যুদ্ধের ঘটনা বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন। তাদের প্রচারিত সংবাদ বা প্রতিবেদন যুদ্ধে বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ও পরে বিদেশি গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো দুই ভাগে ভাগ করা হলে এক ভাগে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও ২৩ বছরের ধারাবাহিক সংগ্রাম এবং আরেক ভাগে একাত্তরে অবরুদ্ধ সময়ের প্রতিবেদন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই অনেক বিদেশি সাংবাদিক ঢাকায় এসেছিলেন। তাদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ২৫ মার্চে পাকিস্তানি সেনাদের ক্র্যাকডাউনের পর এসব সাংবাদিককে পূর্ব বাংলা থেকে বের করে দেওয়া হয়।

পূর্ব বাংলা থেকে প্রকাশিত অধিকাংশ সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে বিদেশি গণমাধ্যমই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক সংবাদ জানার মাধ্যম হয়ে ওঠে। অবরুদ্ধ অবস্থার ফাঁক গলিয়ে অনেক বিদেশি সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা ও গণহত্যার সংবাদ পরিবেশন করেছেন। গণহত্যার ওপর সংবাদ সংগ্রহ করেছেন সানডে টাইমসের অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, বিবিসির মার্কটালি, ডেইলি টেলিগ্রাফের সাইমন ড্রিং, টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিনিধি ড্যান কগিনসসহ আরও অনেকে। তাদের প্রতিবেদনগুলো ছিল পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি সহায়ক। তবে পৃষ্ঠপোষকতার বা স্পন্সর সাংবাদিকতা থেকে বেরিয়ে এসে যার প্রকাশিত প্রতিবেদনটি সে সময় বিশ্ব বিবেককে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল তিনি হলেন করাচি মর্নিং নিউজের সহকারী সম্পাদক ও যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ১৩ জুন, ১৯৭১ সানডে টাইমস পত্রিকায় ‘জেনাসাইড’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। বিবিসির মার্ক ডামেট লিখেছেন, এই প্রতিবেদন সারা বিশ্বকে পাকিস্তানের বিপক্ষে ক্ষুব্ধ আর ভারতকে শক্ত ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করেছিল। ভারতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমসের সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সকে বলেছিলেন, লেখাটি তাকে এত গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল যে এটি তাকে ইউরোপীয় রাজধানীগুলো এবং মস্কোয় ব্যক্তিগতভাবে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহ দেয়, যাতে ভারত এ ক্ষেত্রে সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করতে পারে।

কীভাবে অ্যান্থনি পাকিস্তান সরকারের আয়োজনে সাংবাদিক দলের সঙ্গে পূর্ব বাংলা সফরে অংশ নেন এবং তাদের ব্রিফ অনুসারে সংবাদ পরিবেশন না করে (স্পন্সর সাংবাদিকতাকে বর্জন করে) প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করেন, সে কাহিনিও বেশ চমকপ্রদ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এপ্রিলের প্রথমার্ধে সরকার আটজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে পূর্ব বাংলায় নিয়ে আসে। উদ্দেশ্য প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে এসেছে, তা তাদের দেখানো এবং সে আলোকে সংবাদ পরিবেশন করানো। কিন্তু সাতজন সরকারের উদ্দেশ্য পূরণে সংবাদ প্রকাশ করলেও অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তা করনেনি। বিবেকের দায়বোধ থেকে তিনি পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার যে দৃশ্য দেখেছেন তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। গোয়ানিজ খ্রিষ্টান অ্যান্থনি মর্নিং নিউজের চাকরি ছেড়ে দেন এবং পরিবারসহ পাকিস্তান ত্যাগ করে লন্ডনে চলে যান। কারণ পাকিস্তানের মাটিতে বসে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তার জীবন বিপন্নও হতে পারে- এমন আশঙ্কা থেকেই পাকিস্তান ত্যাগ করেন। সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর তার একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের প্রতিবেদন স্পন্সর সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য পূরণ করেনি। বরং প্রকৃত তথ্য ও সত্য তুলে ধরেছে। আসলে যে উদ্দেশ্যে এম্বেডেড সাংবাদিকতা বা স্পন্সর সাংবাদিকতায় সাংবাদিকদের যুক্ত করা হয়, তা সব সময় সফল হয় না। যারা সত্য প্রকাশে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং নির্ভীক, তারা হয়তো তথ্য সংগ্রহের কৌশল হিসেবে এ ধরনের সাংবাদিকতায় যুক্ত হন, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আয়োজকদের উদ্দেশ্য পূরণে শামিল না হয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সংবাদ পরিবেশন করেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের সময় এম্বেডেড সাংবাদিকতা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ৭৭৫ রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফারকে সংযুক্ত করা হয়। সাংবাদিকদের সঙ্গে চুক্তি করা হয় মার্কিন সেনাবাহিনী ব্রিফ অনুসারে যুদ্ধের সংবাদ পরিবেশনের জন্য। কিন্তু দেখা গেল ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরের সাংবাদিক ফিলিপ স্মাকার সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন ইউনিটের অবস্থান প্রকাশ করেন। এ জন্য ফিলিপকে বহিষ্কার করা হয়। এর চার দিন পর ফক্স নিউজের সাংবাদিক জেরাল্ডো রিভেরা ইরাক থেকে মার্কিন সেনাদের অবস্থান ও পরিকল্পনা বিশদভাবে তুলে ধরেন। এ জন্য তাকেও সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। এই দুজন সাংবাদিক মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি না করলেও তাদের সঙ্গী হয়েছিলেন।

ফিরে আসছি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে প্রতিবেদন প্রসঙ্গে। কেমন করে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ ও কৌশলী নেতৃত্বে একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সশস্ত্র যুদ্ধে পরিণত হয়, এমন সংবাদে ঠাসা ছিল বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো। একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোয় একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা লাভের আগেই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে কোর্ট, কাচারি, সরকারি অফিস পরিচালিত হওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করে বিদেশি সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশ করেন। বাঙালির এই অবিসংবাদিত নেতা সম্পর্কে কোনো কোনো গণমাধ্যম ‘বেঙ্গলস নিউ হিরো’, ‘হিরো অব ইস্ট পাকিস্তানিস’, ‘মুজিবুর: দ্য ভার্চুয়াল রুলার অব ইস্ট পাকিস্তান’, ‘আনডিসপুটেড লিডার অব বেঙ্গলিস’ শীর্ষক শিরোনাম দিয়ে বক্স আইটেম করে।

মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমে ছোট ছোট বাক্যে আকর্ষণীয় শিরোনামগুলো গভীর অর্থবোধক। এসব আকর্ষণীয় শিরোনাম দিয়ে বিদেশি সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের বহুমাত্রিক গুণাবলির বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের বিশ্লেষণে উঠে আসে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর জনমত সংগঠিত করার এক অদ্ভুত জাদুকরী শক্তির কথা। আরও উঠে আসে তার দূরদর্শিতা, ত্যাগ, সততা, নেতৃত্ব কৌশল, সাহস, ক্যারিশমা, মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা। এমনকি বঙ্গবন্ধুর বিদেশ নীতির প্রসঙ্গও তুলে ধরা হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য অবজারভারের ২৮ মার্চ ১৯৭১ সংখ্যায় ‘বেঙ্গলস নিউ হিরো’ শিরোনামে সিরিল ডান লিখেছেন, ‘হোয়াটএভার মে বি সেইড অ্যাগেইনস্ট হিম, হি ইজ নট এ পলিটিক্যাল অপরচুনিস্ট।’ অর্থাৎ শেখের বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হোক না কেন, তিনি রাজনৈতিক সুবিধাবাদী নন। সিরিল ডান তার লেখায় অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছরেরও কম সময়ে শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করা, আন্তব্যক্তিক যোগাযোগে তার কথা বলার ভঙ্গিমা, মানুষকে সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতার ওপর আলোকপাত করেছেন।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের ৯ ডিসেম্বর ১৯৭০ সংখ্যায় ‘আনডিসপুটেড লিডার অব দ্য বেঙ্গলিস’ শিরোনামে র‌্যালফ ব্লুমেন্টাল লিখেছেন, ‘দুই দশক ধরে তিনি তার দলের প্রতি মানুষের সমর্থন আদায় করেছেন, মানুষের আস্থা সৃষ্টি করেছেন।’ দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার একাধিক সাংবাদিক ঢাকায় আসেন। তাদেরই একজন টিলম্যান ডুরডিন। ৫ মার্চ ১৯৭১ পত্রিকাটিতে ‘হিরো অব দ্য ইস্ট পাকিস্তানিজ’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ও মেলামেশায় তিনি অত্যন্ত হাসিখুশি ও প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ।’

যুদ্ধ ও সহিংসতায় এম্বেডেড ও স্পন্সর সাংবাদিকতা দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশ করায় মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সাংবাদিকরা যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে একদমই তথ্য না পাওয়ার চেয়ে কৌশল হিসেবে এম্বেডেড ও স্পন্সর সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। কিন্তু যারা নিজ উদ্দেশ্য সাধনে প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার জন্য এ ধরনের সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করেন তারা কি আদৌ সফল, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মুক্ত সাংবাদিকতার ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণে এম্বেডেড সাংবাদিকতার মাধ্যমে লক্ষ্য পূরণ যেমন সফল হয়নি, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও পাকিস্তান সরকারের স্পন্সর সাংবাদিকতাও সফল হয়নি। অ্যান্থনি মাসকারহানস, মার্কটালি, সাইমন ড্রিং, ড্যান কগিনসসহ আরও অনেক বিদেশি সাংবাদিক অবরুদ্ধ সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যা মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে দারুণভাবে সহায়তা করে।

 

একুশে সংবাদ/আ.ক.প্র/জাহা

 

 

মতামত বিভাগের আরো খবর