সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

প্লাস্টিক পণ্যের দাপটে শীতল পাটি শিল্পের অচলাবস্থা

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৫:৪৭ পিএম, ৩১ মার্চ, ২০২৩

গ্রামীণ শিল্প ও ঐতিহ্যের অন্যতম নাম শীতল পাটি। সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ঝাঐল ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের শীতল পাটি শিল্পের বিপুল সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি সময়ের সাথে চলতে না পেরে এবং বর্তমানে প্লাস্টিক পণ্যের দাপটে প্রান্তিক এই শিল্পটি হারানোর পথে।

 

উপজেলা থেকে চাঁদপুর গ্রামের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। একটা সময় চাঁদপুরের এই শীতল পাটি উপজেলা এবং জেলার চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করা হতো। কিন্তু কালের আবর্তে এখন আর গ্রাম বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য শীতল পাটি কোথাও বিক্রয়ের ছবি খুবই কম দেখা যায়। আর্থিক সঙ্কট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, উপকরণের দুষ্প্রাপ্য এবং ক্রেতা স্বল্পতার কারণে এই শিল্পের কারিগরেরা চরম দুর্দিনে দিন কাটাচ্ছেন।

উপজেলার এই গ্রামটির বেশিরভাগ মানুষই হিন্দু। এ গ্রামে নারী-পুরুষেরা বাপ-দাদার আমল থেকেই শীতল পাটি শিল্পের সাথে জড়িত। শীতল পাটি বুনে ও বিক্রি করেই তাদের সংসার চলে। বর্তমানে প্লাস্টিকের পণ্যের দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শীতল পাটি শিল্পটি। বেচা বিক্রি বেশী না থাকায় কারিগর পাচ্ছে না পরিশ্রম অনুযায়ী ন্যায্যমূল্য। এর পরও এই এলাকার নারীরা শত কষ্টে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। এ গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবারের প্রায় ৮০০ নারী-পুরুষ তাদের এই জাতি পেশা হওয়ায় এখনো টিকিয়ে রেখেছেন এ শিল্প।

 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের তরুণ, বৃদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম সম্প্রদায়ের সকল ধর্মের কারিগর রয়েছেন। পুরুষেরা জমি থেকে পাটি বেত কেটে আনছেন। পরে সেগুলো দা দিয়ে এক ধরনের বেতী সুতা বানিয়ে সিদ্ধ করে রোদে শুকানো হচ্ছে। বেতী সুতাগুলো রোদে শুকানোর পর বাহারি রং দিয়ে আবার রোদে শুকানো হচ্ছে। বেতী সুতা রোদে শুকানোর পর নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা নিপুণ হাতে তৈরি করছে শীতল পাটি। প্রকারভেদে এক একটি শীতল পাটি বিক্রি হয় প্রায় ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

সোহাগী,অনিতা, সিথী রানী, রাত্রী, ও বৃষ্টি এই নারী কারিগরেরা বলেন, তাদের শীতল পাটির টাকায় চলে সংসার। শীতল পাটির কদর অনেকটা কমে গেছে। শীতল পাটির দাম কিছুটা বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি। পাটির আকার অনুযায়ী কারিগরেরা পান ২২০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। তাদের একটি পাটি বুনতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগে। একটা পাটি বুনতে যে পরিশ্রম আর সময় লাগে সে অনুযায়ী ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না বলে জানান।

 

গ্রামের শীতল পাটি শিল্পের তরুণ উদ্যোক্তা ধনান্জয়  বলেন, শীতল পাটি শিল্পটির বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবস্তা করলে ভালো হয়। আমার পূর্ব পুরুষেরা স্বাধীনতার পর থেকেই শীতল পাটির সঙ্গে জড়িত। শীতল পাটি বুনিয়ে ও বিক্রি করেও তার সংসার চলে। বর্তমানে প্লাস্টিকের পাটি ও মোটা পলিথিন কাগজসহ নানা প্লাস্টিক পণ্যের জন্য শীতল পাটির কদর কমে গেছে।

 

ঝাঐল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন ঠান্ডু বলেন, আমরা স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে সকল সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছি। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটিকে যেন কোনো ভাবেই হারিয়ে না ফেলি এইজন্য সবসময় চাঁদপুর গ্রামের শীতল পাটি শিল্পের সাথে জড়িতদের সবার খোঁজ খবর নিয়ে থাকি।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শহিদুল্লাহ সবুজ বলেন, উপজেলার ঝাঐল চাঁদপুরের গ্রামের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যগত ভাবে কাজ অত্র এলাকার গরীব সাধারণ মানুষ করে এবং এই শিল্পটা আগে যেভাবে বিস্তৃত ছিল এখন একটু সংকোচিত হয়ে আসছে। এই শীতল পাটির সবচেয়ে বড় গর্ব এটি দেশের বাইরেও বিভিন্ন মহাজন ও ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি হয়। অথচ সেই শীতল পাটির কাঁচা বাণিজ্যের চাষ এবং উৎপাদন সংকুচিত হচ্ছে। আমরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কারিগরদের সাথে বিভিন্ন পরামর্শ করে থাকি ইতিমধ্যে আমরা সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে একটা ঋণের ব্যবস্থা করেছিলাম। আরো সহযোগিতার প্রয়োজন যাতে করে এই শিল্পটাকে আরও বেশি পরিমাণে বাজারজাত করা যায়। সেক্ষেত্রে আমি কুটির শিল্প মন্ত্রণালয় এবং এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করি যাতে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। এই শীতল পাটি শিল্পের মাধ্যমে আরো কর্মসংস্থানের সৃষ্টি এবং শীতলপাটি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা বিদ্যমান।

 

এ বিষয়ে কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেরিনা সুলতানা বলেন, কামারখন্দে যে পাটি পল্লি আছে এটা একটা ঐতিহ্যবাহী পল্লী বহু বছর আগে থেকেই এরা পাটি তৈরির কাজে লিপ্ত আছেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। প্রতিবছরে ২/৩ বার তাদেরকে প্রশিক্ষণের আওতায় এনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে কিভাবে তারা নতুন নতুন প্রোডাক্ট তৈরিতে করতে হবে। তারা যে শীতল পাটি তৈরি করছে সেই শীতল পাটিকেই কিভাবে আরো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগাতে পারে মানুষের চোখে পড়ার মত হয় এবং মানুষ যেন সেটা কিনতে আগ্রহী হয় সেই প্রশিক্ষণ গুলোই দেওয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে তাদের যে সমস্যাটা হচ্ছে প্লাস্টিক পণ্য বাজার দখল করে ফেলেছে। তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে গেলে অবশ্যই তাদেরকে আরো সতর্ক হতে হবে এবং উন্নতমানের পাটি তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি আমরা উপজেলার কোন প্রোগ্রামে উপলক্ষে গিফট অথবা স্মারক হিসেবে তাদের তৈরি প্রোডাক্ট আমরা দিয়ে থাকি এ থেকে তাদের যেমন বিক্রি হলো পাশাপাশি আমাদের ঐতিহ্যবাহী প্রোডাক্টটি সম্পর্কে অতিথিবৃন্দ জানতে পারবে এর বাইরে যদি তাদের কোনো পরামর্শ থাকে যে এইভাবে করলে আমরা আরো ভালো হবে তাহলে তারা আমাদেরকে বিষয়টি অবহিত করলে আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

 

একুশে সংবাদ/এসএপি
 

ফিচার বিভাগের আরো খবর