সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ভাঙ্গছে কিশোর অপরাধের সিন্ডিকেট

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৯:৫১ পিএম, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪
  • ১০ থানায় কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রব বেশি
  • স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থে তরুণদের বিপথগামী করছে
  • আইনের মারপ্যাচে তাদের পৃষ্ঠপোষকরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকছে


সময়ের আলোচিত বিষয় কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রব কমে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর নানামুখি তৎপরতায় ভাঙ্গছে কিশোর অপরাধের সিন্ডিকেট। সারা দেশের তুলনায় ঢাকায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছে এবিষয়ে। ২০২২ সালে পুলিশ প্রতিবেদনে ঢাকায় ৬৬টি কিশোর গ্যাং এর উল্লেখ করা হলেও বর্তমানে সেটি কমে রাজধানীর ১০টি থানায় সীমাবদ্ধ। প্রধামন্ত্রীর নির্দেশনায় এবিষয়ে কাজ করছে স্বরাষ্ট্র ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে ঢাকায় কিশোর অপরাধ দমনে বিশেষ ভূমকা রাখছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান।

বাংলাদেশে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনী নানা উদ্যোগ নিলেও ‘কিশোর গ্যাং’ এর তৎপরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং বড় শহরগুলোর গণ্ডি ছড়িয়ে এ সমস্যা এখন বিস্তৃত হচ্ছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও। এমনকি অনেক জায়গায় একাধিক কিশোর গ্যাং একে অন্যের সাথে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে।

কিশোর অপরাধ দমন করতে পুলিশের বিশেষ ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, 

মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, যাত্রাবাড়িসহ ৫০টি থানার মধ্যে ১০টি থানায় কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রব বেশি। আমরা অনেকগুলো কিশোর গ্যাং চিহ্নিত করেছি, কিন্তু সরাসরি কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার ধরা যাচ্ছে না। আইনের মারপ্যাচে তাদের পৃষ্ঠপোষকরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকছে। তবে কিশোর গ্যাং নির্মূলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো গাফিলতি নেই।  

২৭ এপ্রিল ঢাকার এফডিসিতে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক আন্দোলন নিয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার।

তিনি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা প্রতিরোধে পুলিশের ওপর কোনো রাজনৈতিক চাপ না থাকলেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপ রয়েছে। রাজধানীতে ২১ জন কাউন্সিলরের কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকলেও তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে কিশোর অপরাধে পরিবার ও সমাজকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, খেলাধুলা, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার অভাবে কিশোররা অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ঢাকা শহরে শিশু-কিশোরদের সামান্য খেলার মাঠের জন্য আন্দোলন করতে হয়। আজকের শিশুরাই আগামীর বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে অপরাধমুক্ত সোনার মানুষ গড়ে তুলতে হবে। পুলিশ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছে মূলত কিছু রাজনৈতিক নেতার পৃষ্ঠপোষকতাই কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দায়ী। মাদক বাণিজ্য, চাঁদাবাজি এবং স্থানীয় পর্যায়ে কর্তৃত্ব তৈরির জন্য এলাকার শিশু কিশোরদের নিয়ে গ্যাং তৈরি করে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেন এলাকার প্রভাবশালীরা।

জানা গেছে, 

পুলিশ প্রতিনিয়ত ব্যবস্থা নিচ্ছে এসব গ্যাং এর রিরুদ্ধে। আটক, মামলা ও সংশোধনাগারে পাঠানো হচ্ছে অনেককে। কিন্তু শিশু কিশোরদের নিয়ে এ ধরনের কিশোর গ্যাং তারপরও বন্ধ হচ্ছে না মূলত কথিত কিছু বড় ভাই ও  পলিটিক্যাল নেতার কারণে।

কিছুদিন আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হয় কিশোর গ্যাং ইস্যুটি । ওই বৈঠকের পর, “কিশোর অপরাধীদের সংশোধনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন সরকার প্রধান ।

রাজধানীর উত্তরায় ২০১৭ সালে স্কুল শিক্ষার্থী আদনান খুনের ঘটনায় প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলো কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তখন বেশ কয়েকজন কিশোরকে আটক করেছিলো র্যাব যারা একই গ্রুপের সদস্য ছিল। সে সময় আলোচনায় এসেছিলো উত্তরা ডিসকো বয়েজ ও বিগ বস কিশোর গ্যাং নামের দুটো গ্রুপ। এরপর থেকে নিয়মিতই ঢাকাসহ নানা জায়গায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ে খবরাখবর প্রকাশ হচ্ছিলো গণমাধ্যমে। ২০১৯ সালে বরগুনায় রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার পর আলোচনায় আসে ‍‍`বন্ড ০০৭‍‍` নামের একটি গ্রুপ।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী মন্তব্য করেন, 

এরা হুট করে এসে ঘটনা ঘটায়। আর তাতে তাৎক্ষণিক ক্ষতি হয়ে যায় অনেকের। দেখা যায় কারও সাথে এদের একটু কথা কাটাকাটি হলে কিছুক্ষণের মধ্যে ৩০-৩৫ জন এসে হামলা শুরু করে। এলাকায় বস্তিতে বসবাস করে এমন কিশোরদের পাশাপাশি ভালো পরিবারের পড়ালেখা করে এমন কিশোরদেরও দেখা যায় এসব গ্রুপে।

রাজধানীসহ সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা কত বা কি পরিমান কিশোর, তরুণ এসব অপরাধে জড়িত তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে ২০২২ সালে পুলিশের  প্রতিবেদনে সারাদেশে ১৭৩টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় থাকার তথ্য দেয়া হয়েছিলো। এতে বলা হয়েছিলো ঢাকাতেই ৬৬টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে। আর এসব দলগুলোতে ১০ থেকে ৪০-৫০ জন করে সদস্য আছে।

গাংচিল, ম্যাক্স পলু, বাট্টু বাহিনী, পটেটো, কবজি কাটা গ্রুপ, লাল বাহিনী- এমন সব বাহারি নামের কিশোর গ্যাংগুলোর সদস্যরা খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, নারীদের উত্ত্যক্ত করা, জমি দখলে সহায়তাসহ নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ার তথ্য এসেছে গণমাধ্যমে।

তবে চলতি বছর জানুয়ারিতে ঢাকার মধুবাগে ব্যাডমিন্টন খেলাকে কেন্দ্র করে দু‍‍`দল কিশোরের সংঘর্ষে একজন নিহত হবার পর র্যাব জানায় যে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে ১ হাজার ১২৬ জনকে র্যাব আটক করেছে কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে। এর মধ্যে ২০২৩ সালেই আটক হয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশ।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি নানা ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচিও হাতে নেয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ ও র্যাব। কিন্তু তারপরও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়তে থাকার কারণ স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী নেতা ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষথেকে জানানো হয়, 

তারাই কিশোর তরুণদের বিপথগামী করছে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য। আমরা রাজনৈতিক নেতা বিশেষ করে কাউন্সিলর ও অন্যদের সাথে নিয়মিত মতবিনিময় করছি এবং উৎসাহিত করছি যাতে কিশোর গ্যাংকে কেউ প্রশ্রয় না দেয়। আবার অনেক মামলায় কিশোর গ্যাংয়ের ‘বড় ভাই বা মদদদাতা’ হিসেবে অনুসন্ধানে যাদের নাম উঠে এসেছে তাদেরকেও আসামি করা হয় বলে জানানো হয়।

এর আগে, পুলিশের প্রতিবেদনে ঢাকার একুশ জন কাউন্সিলের নাম উঠে এসেছিলো কিশোর গ্যাংয়ের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে। যদিও তাদের কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

তবে পুলিশ ও সমাজ অপরাধ গবেষকরা বলছেন, পরিবারের তরুণ সদস্যদের সঠিক নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে সব পিতা মাতা কিংবা পরিবার সঠিক ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিশেষ করে দরিদ্র অর্থাৎ প্রান্তিক পরিবারগুলোতে সঠিক অভিভাবকত্ব দেখায় না বলে সেসব পরিবারের কিশোররা সহজে ভুল পথে যায়, এমন অনেক উদাহরণের কথা তুলে ধরেন তারা।


একুশে সংবাদ/হ.ক.প্র/জাহা

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের আরো খবর