সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

কম ঘুষে ঘোরাঘুরি, বেশি ঘুষে কাজ হয় তাড়াতাড়ি

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৭:২৩ পিএম, ১ এপ্রিল, ২০২১

শিল্প কারখানা নগরি গাজীপুর দ্রুত গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে এখানকার জমির দামও। আর এ কারণেই ভূমি সংক্রান্ত বিরোধও বেড়েছে বহুগুণ। বিরোধে জড়িয়ে বা এ ধরনের ঝামেলা এড়াতে শ্রীপুর উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ, মিস কেসসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ভূমি সংক্রান্ত কাজ করতে গিয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি), তহশিলদার থেকে শুরু করে পিয়নদের পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে। 

ভূমি অফিসে আসা অধিকাংশ ভুক্তভোগীর মুখে একই কথা-হয়রানি আর ভোগান্তি কী তা এখানে না এলে বোঝা যায় না। অফিস নিয়মে প্রত্যেক ধাপে ঘুষ দিয়েই ফাইল এসিল্যান্ডের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছানো হয়। এতে সহযোগিতা করে অফিসের কর্মচারী-দালাল সিন্ডিকেট।

শ্রীপুর উপজেলা ভূমি অফিস এবং উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন তহশিল অফিসে মাসে কমপক্ষে কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে ভূমি সংশ্লিষ্ট সেবা নিতে আসা সরকারি এসব অফিসে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ভূমি মালিকদের। 

অভিযোগ উঠেছে, সহকারী কমিশনার (ভূমি), কানুনগো, সার্ভেয়ার, তহশিলদার, অফিস সহকারী, পিয়ন-দালাল সবাই ঘুষ বাণিজ্যের সঙ্গে কমবেশি জড়িত। উপজেলা সহকারী ভূমি প্রশাসক (এসিল্যান্ড) যোগদানের পর থেকে প্রতিনিয়তই হয়রানি বেড়ে চলে। অবৈধ লেনদেনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী জালিয়াত চক্র, কর্মচারী-দালাল সিন্ডিকেট। ঘুষ দিয়েই অফিসের অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করাসহ এক দাগের জায়গার মালিক অন্যজনকে করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।  

গত এক সপ্তাহ ধরে শ্রীপুর উপজেলা ভূমি অফিস ও উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের তহশিল অফিস নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় । এসময় জমির ক্রেতা-বিক্রেতাদের কাছ থেকে ঘুষ, দুর্নীতি আর অনিয়মের বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নাম প্রস্তাব, সার্ভে রিপোর্ট, নামজারি, ডিসিআর সংগ্রহ, মিস কেস ও খাজনা দাখিল থেকে শুরু করে সব কিছুতেই এখন ঘুষের কারবার। জমির দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে উপজেলা ভূমি অফিসসহ প্রতিটি ইউনিয়নের তহশিল অফিসে ঘুষ লেনদেন কার্যক্রম। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কারও তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসা ভুক্তভোগীদের কাছে অনেকটা প্রকাশ্যেই ঘুষের অংক নির্দিষ্ট করে দিচ্ছেন। বলে দিচ্ছেন, ঘুষ না দিলে ফাইল নড়বে না। ঘুষ ছাড়া কোনও কাজই হচ্ছে না সেখানে।

জমির ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘুষ নেওয়ার নতুন পন্থাও উদ্ভাবন করেছেন ভূমি কর্মকর্তারা। নামজারির আবেদনপত্র উপজেলা ভূমি অফিসে জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে ইউনিয়ন ভূমি অফিসসহ সব অফিসের নামজারির আবেদন উপজেলা ভূমি অফিসে জমা না নিয়ে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হচ্ছে। 

উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের আবদার গ্রামের মুত আব্দুল কাদির মিয়ার ছেলে শামসুদ্দিন অভিযোগ করেন, তার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সাত  শতাংশ জমির নামজারি করতে গেলে তেলিহাটি ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা অফিস সহায়ক হেলাল উদ্দিন সরকার ১৫ হাজার টাকা নিয়ে খারিজ করে দেন। এর পর শামসুদ্দিন তার মামার ২১ শতাংশ জমির নামজারি করতে গেলে তেলিহাটি ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা অফিস সহায়ক হেলাল উদ্দিন সরকার চল্লিশ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে অনেক দর কসাকসির পর ত্রিশ হাজার টাকার মাধ্যমে কথা ফাইনাল করে নগত ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে নেন হেলাল উদ্দিন সরকার,দুই বছর নানান তালবাহানা করে হেলাল উদ্দিন ঘুরাতে থাকেন। এবং হেলাল উদ্দিন সরকার বদলী হয়ে কাওরাইদ ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অফিস সহায়ক হিসাবে যোগদান করেন। এবং শামসুদ্দিনকে তেলিহাটি ইউনিয়নের ভূমি অফিসের শফিকুল ইসলামকে ২১ শতাংশ জমির নামজারি করতে বলেন। কিন্তু শফিকুলকে টাকা না দেওয়ায় আবেদন জমা নেওয়া হয়নি। বৃহস্পতিবার ১এপ্রিল বেলা ১২ টার দিকে কাওরাইদ ভূমি অফিসে শামসুদ্দিন অফিস সহায়ক হেলাল উদ্দিন সরকা কে ত্রিশ হাজার টাকা ফের চাইলে হেলাল উদ্দিন সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে শামসুদ্দিনকে খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করে অফিস থেকে বের করে দেন। এমতাবস্থায় শামসুদ্দিন নিরুপায়  হয়ে শ্রীপুর উপজেলা সহকারী ভূমি প্রশাসক (এসিল্যান্ড) বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

গাজীপুর ইউনিয়নের গাজীপুর হাছেন আলী জানান, তিনি তার এক আত্মীয়কে নিয়ে ধনুয়া মৌজায় নিজেদের কেনা ও পৈতৃক জমির নামজারি ও জমাভাগ করার জন্য ২৩৬৯/২০-২১ নথিতে আবেদন করেন। এ কাজটি করতে অফিস খরচের নামে মাওনা ইউনিয়ন সহকারী ভূমি অফিসের দালাল আলাল উদ্দিন ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু, তিনি এতে রাজি না হওয়ায় তার নথি বাতিল হয়ে গেছে বলে জানানো হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে নথি টির সন্ধান পাওয়া গেলেও কি কারনে বাতিল করা হলো তা জানা যায়নি। 

এ ব্যাপারে তেলিহাটি ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আব্দিুল লতিফ কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবিষয়টি আমার জানা ছিলনা তবে হেলাল উদ্দিন সরকার একটা টাউট,আমার অজান্তে অনেকর কাছ থেকে নামজারির কথা বলে অনেক টাকা পয়সা নেওয়া অবিযোগ পাচ্ছি সে চলে যাওয়ার পর। এবিষয়টি আমি উপরে স্যারদের সাথে কথা বরবো। তবে শামসুদ্দিন আমার কাছে আসেনি এবিষয়ে আমার জানা ছিলোনা এখন জেনেছি তার খারিজ আমি করে দিব। কিছু কাগজপত্রে গড়মিল থাকায় তার আবেদনটি বাতিল করা হয়েছে। 

তেলিহাটি ইউনিয়নের তেলিহাটি গ্রামের মোহাম্মদ আলী মৃধা অভিযোগ করেন, তার এলাকার ৩৮২,৩৮৩ দাগের সরকারি পুকুর লিজ নিয়ে প্রতি বছর সরকারকে রাজস্ব দিতেন। কিন্তু তেলিহাটি ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফকে তার চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় তার লিজ নবায়ন করা যাচ্ছে না। এদিকে, ভূমিদস্যুরা সরকারি এই পুকুরটি কর্মকর্তাদের যোগসাজসে অবৈধভাবে দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন।

একই ইউনিয়নের মূলাইদ গ্রামের আফাজ উদ্দিন অভিযোগ করেন, আরএস ১০ দাগের ৩ একরের সরকারি পুকুর রহস্যজনক কারণে গ্রায় ১৫ বছর ধরে ইজারা দেওয়া হচ্ছে না। তেলিহাটি ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ ও শহিদুলের যোগসাজসে অধিকাংশ জায়গা বে-দখল হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করেও সরকারি ভূমি রক্ষা করা যাচ্ছে না।

শ্রীপুর উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও উপজেলা ভূমি অফিসের সমন্বয়ে চলে ভূমি সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম। প্রতি অর্থ বছর ১০ হাজারের ওপর নামজারির নথি সম্পন্ন হয়। ১ একরের কম নথিতে ঘুষের নামে অফিস খরচ নির্দিষ্ট করা আট হাজার টাকা। এরপর নথি অনুমোদনের পর ভূমি উন্নয়ন কর ও ডিসি আর ফি জমা দিতে হয়ে। সব মিলিয়ে ছোট নথিতে ভূমি মালিকের সর্বনিম্ন খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। আর এভাবেই প্রতিবছর হাতিয়ে নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা। যদিও সরকার রাজস্ব পায় ডিসি আর ফি বাবদ ১১৫০ টাকা ও পরিশোধিত ভূমি উন্নয়ন কর।


উপজেলা ভূমি অফিসসহ সাতটি তহশিল অফিসে রয়েছে দালালদেরও দৌরাত্ম্য। কর্মকর্তাদের নিজস্বভাবে নিয়োগ করা উমেদাররা (দালাল) নিয়ন্ত্রণ করেন ভূমি সংক্রান্ত কার্যক্রমসহ টাকা লেনদেন। ভূমি অফিসগুলোতে উমেদাররা চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্র (দলিল) নিয়ে কাজ করেন। ফলে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে সরকারি দলিলপত্র।

তেলিহাটি ইউনিয়নের সাইটালিয়া গ্রামের নূর মোহাম্মদ অভিযোগ করেন, তার ছেলে ও মেয়ের নামে ৩৩ শতাংশ জমি নামজারি করতে আবেদন জমা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তা শহিদুলের ব্যক্তিগত কর্মচারী পরিচয় দিয়ে তাজাম্মুল নামে এক লোক ফোন করে ১০ হাজার টাকা নিয়ে অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন। এই টাকা দিতে বাধ্য হওয়ার পর তার নথি অনুমোদিত হয়। নূর মোহাম্মদসহ ভূমি অফিসে আসা অধিকাংশ ভুক্তভোগীর মুখে একই কথা- হয়রানি আর ভোগান্তি কী তা এখানে না এলে বোঝা যায় না। অফিস নিয়মে প্রত্যেক ধাপে ঘুষ দিয়েই ফাইল এসিল্যান্ডের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছানো হয়। এতে সহযোগিতা করে অফিসের কর্মচারী-দালাল সিন্ডিকেট।

মাওনা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ভূমি কর্মকর্তার নিয়োগকৃত উমেদার জহির, জাহাঙ্গীর, আলাল, মাহাবুব ভূমি মালিকদের ফোন করে করে টাকা আদায় করেন। কোনও মালিক সরাসরি ভূমি কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ভূমি কর্মকর্তা তার নিজস্ব কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

শ্রীপুর পৌর ভূমি অফিসে ভূমি কর্মকর্তার নিয়োগকৃত উমেদার রাকিব, আজিজুল, রনিসহ আরও কয়েকজন ভূমি মালিকদের সঙ্গে মধ্যস্থতায় ব্যস্ত থাকেন। এছাড়াও শ্রীপুর উপজেলার ভূমি অফিসে নামজারি সহকারী আলমগীরের নিয়োগকৃত উমেদার নিজামউদ্দিন, আবুল বাশারের নিয়োগকৃত উমেদার সাইফুল ইসলাম ও জহিরুল ইসলাম সাধারণ ভূমি মালিকদের সঙ্গে মধ্যস্থতায় ব্যস্ত থাকেন।

রাজস্ব আদায়ের নামে নিজের পকেট ভারি করার কাজে ব্যস্ত থাকেন ভূমি কর্মকর্তারা। মূলাইদ গ্রামের  আফতাব উদ্দিন অভিযোগ করেন, তার জমির ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে গেলে উপ-সহকারী কর্মকর্তা শহিদুল হক তার কাছে সাত হাজার টাকা দাবি করেন। অবশেষে ছয় হাজার টাকা দিলে তার হাতে ধরিয়ে দেন ১৬৭০ টাকার রশিদ। এভাবেই ভূমি উন্নয়ন করের কোনও চার্ট বা তালিকা জনগণকে অবহিত না করায় যাচ্ছেতাই ভাবে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করছেন ভূমি কর্মকর্তারা।

এদিকে, নামজারিতে ঘুষ বাবদ অতিরিক্ত অর্থ খরচ হওয়ায় ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধে উৎসাহ হারাচ্ছেন ভূমি মালিকরা। জমিতে মালিকানাসংক্রান্ত ঝামেলা, দখল না থাকলে অফিস খরচ লাখ টাকার ওপর ছাড়িয়ে যায়। টাকা দিলে সবকিছু সম্ভব সরকারি ওইসব ভূমি অফিসগুলোতে।

শ্রীপুর ভূমি অফিসে প্রতি মাসে কম করে হলেও এক হাজার মিউটেশন (নামজারি) হয়। এ কাজে ডিসিআর (ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ) বাবদ এক হাজার ১৫০ টাকা ফি আদায়ের বিধান থাকলেও খরচ হয় পাঁচ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। কেবল এ বাবদই এসিল্যান্ড থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত হাতিয়ে নেয় ৮০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা। কম ঘুষ দিলে বেশি ঘোরাঘুরি, আর ঘুষের পরিমাণ বেশি দিলে কাজ হয় তাড়াতাড়ি। ঘুষ দেওয়ার পরও সরকারের বেঁধে দেওয়া ৪৫ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করার রেকর্ড নেই বললেই চলে।

উপজেলা ভূমি অফিস কানুনগো মতিয়ার রহমান বলেন,লিখিত অভিযোগ পেয়েছি হেলাল উদ্দিনকে ডেকে অফিসে এনে এই টাকা উদ্ধার করে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিব। এর আগেও লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে অন্য আরেক জনের টাকা উদ্ধার করে দেওয়া হয়েছে।

এ সব অভিযোগের ব্যাপারে প্রশাসনের নজরদারির কি রকম তা জানতে চাইলে সহকারী ভূমি (এসিল্যান্ড) আব্দুল্লাহ্ আল মামুন বলেন,আমি আমাত্র দুইদি হলো যোগদান করেছি। ভূমি অফিসে কোনও ধরনের ঘুষ বাণিজ্য হওয়ার বিষয়ে কোনও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তদন্ত করে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


একুশে সংবাদ/সা/আ

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের আরো খবর