সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

কাঠগড়ায় সাংবাদিকতা

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০২:৫৮ পিএম, ২৯ মে, ২০২১

বাংলাদেশে নিরাপত্তা বিষয়ক সাংবাদিকতার অ্যাকাডেমিক পঠন-পাঠন এবং সাংবাদক্ষেত্রে এর চর্চা খুব বেশি দেখা না গেলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট তথ্য বা সংবাদ প্রকাশে বেশ সাবধানতা অবলম্বন করা হয়। কারণ সাংবাদিকরা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এবং দায়িত্বশীল পেশার ধারক-বাহক হিসেবে দেশের নিরাপত্তা বিঘিœত হয় এমন তথ্য প্রচার বা প্রকাশ করেননা।

সাংবাদিকরা যেমন সমাজের বিবেক তেমনি জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট তথ্যের অতন্ত্র প্রহরীও বটে। একজন প্রতিবেদক কোন তথ্য গণমাধ্যম অফিসে জমা দিলেই তা প্রকাশিত হয় না, বরং তা সাংবদিকতার নিয়ম-কানুন ও রাষ্ট্রীয় আইনী কাঠামোয় যাচাই-বাছাই-পরিশীলিত হয়ে বা সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। 

এজন্য গণমাধ্যম নিরেট তথ্যের অতন্ত্র প্রহরী। এখানে সাংবাদিক বলতে প্রকৃত সাংবাদিকদেরকেই বুঝাচ্ছি। কারণ বর্তমানে ভূয়া সাংবাদিক, হলুদ সাংবাদিক, অপেশাদার সাংবাদিকসহ রঙ-বেরঙের বহু ধরনের সাংবাদিকের দেখা মেলে যারা মূলত ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য বিপদজ্জনকও বটে। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম নিশ্চয় এসব অপেশাদার সাংবাদিকতো নয়ই, বরং তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে দেশে-বিদেশে সমাদিত ও পুরুস্কৃত।

তিনি যে সাংবাদত্রে কাজ করেন সেখানে তথ্য যাচাই-বাছাই বা ফিল্টারিং এমনভাবে হয় যে একজন রিপোর্টার যত বিখ্যাতই হোক না কেন সাংবাদ সম্পাদনার শেষ চেকপোস্ট হিসেবে যিনি থাকেন তার মাধ্যমে জ্ঞাতসারে কোন মানহানিকর তথ্য, ভূয়া তথ্য, গুজব বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে এমন তথ্য বা ধর্মীয় উম্মাদনা তৈরি করতে পারে এমন তথ্য প্রকাশিত হতে পারে না।

মানুষ মাত্রই ভুল করে। সাংবাদিকেরও ভুল হতে পারে। আমি দীর্ঘদিন এমন ধরনের সংবাদপত্রের একজন সংবাদ ব্যবস্থাপক বা সম্পাদনার চেকপোস্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বড়সড়
রির্পোটারের রিপোর্টও ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছি সাংবাদিকতার মাপকঠিতে ‘অগ্রহণযোগ্য তথ্য’ থাকার
কারণে। একটা সংবাদপত্রে প্রতিদিন যত তথ্য রির্পোটার সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন এভাবে তা যাচাই-বাছাই বা সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। আবার একজন প্রকৃত রিপোর্টার সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-কানুন ও নীতি অনুসরণ করেই তথ্য সংগ্রহ করেন। এসব রিপোর্টিং ও সম্পাদনা প্রক্রিয়ার নিয়মিত বা প্রতিদিনের কাজ।

এসব কথা বলার অর্থ এই যে সাংবাদিকতা একটা নিয়মসিদ্ধ পেশা। যা ইচ্ছে সংগ্রহ করলাম এবং তা প্রকাশ করলাম এমন কোন সস্তা প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির চর্চা সাংবদিকতায় স্থান নেই। রোজিনা
ইসলামের সাংবাদিকতার রয়েছে শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে কোন অপরাধ করেননি, বরং একজন স্বনামধন্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসেবে সাংবাদিকতার সকল নিয়ম-নীতি মেনেই সাংবাদিকতা করেছেন।

তাঁর বিরুদ্ধে যে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য চুরির অভিযোগে যেভাবে পাঁচ-ছয় ঘন্টা আটকে রাখা হয়েছে এবং মামলা করা হয়েছে তা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ করা হয়েছে। সামাজিক যেগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায় একদিকে তাকে “ছিঁচকে চোরের” মতো করে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে।

অন্যদিকে মামলা করার জন্য শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় “শীর্ষ সন্ত্রাসীদের” মতো শত শত পুলিশ প্রদর্শন করা হয়েছে। এসব কর্মকান্ড ও উপনিবেশিক আমলের আইনে মামলা দিয়ে
রোজিনা ইসলামের মতো একজন শীর্ষ সাংবাদিককেই অপদস্ত করা হয়নি, বরং দেশের সাংবাদিকতাকেই নির্মম কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।

সাংবাদিকতা একটা বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা। সারাবিশ্বের সাংবাদিকরা প্রকাশ্যে বা গোপনে সোর্সের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তথ্য যেভাবেই সংগ্রহ করা হোক না কেন তা কোনভবেই চুরি নয়, তা সাংবাদিকতার ভাষায় তথ্য সংগ্রহ।

রোজিনা ইসলামের সংগৃহীত তথ্য প্রকাশিত হলে এবং তাতে কোন ধরনের সমস্য মনে করলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আইনগতভাবে বিভিন্ন প্রতিকার নিতে পারতো। তা না করে আসলে উদেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুর্নীতির তথ্য আর যাতে প্রকাশিত না হয় সেজন্য শুধু কন্ঠরোধ করেননি স্বাস্থ্য মন্ত্রণলয়ের কর্মকর্তারা, তারা একজন নারী সাংবাদিককে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছেন, হেনস্থা করেছেন এমন ভিডিও ও ছবি দেখা গেছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ীও তা অপরাধ। জিম্মি ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগও করা যায়। ওই কর্মকর্তারা তার দেহ ও ব্যাগ তল্লাশি করেছে। জোরপূর্বক মেবাইলের পাসওয়ার্ড নিয়েছে। আইনসম্মত উপায়ে অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তল্লাশি করতে পারে। পুলিশ ছাড়া এই তল্লাশি ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে হস্তক্ষেপ আইনগতভাবে অপরাধ। আটক অবস্থায় অসুস্থ্য হলেও তাকে চিকিৎসা পযর্ন্ত দেওয়া হয়নি যা মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার বিষয়ক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দন্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এটা জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ এর ধারা ৯ অনুযায়ী এই কান্ড ফৌজদারী অপরাধ। পররাষ্ট্র মন্ত্রী এজন্যই বলেছেন বর্হিবিশ্বে এসবের জবাব দিতে হচ্ছে।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য আর্ন্তজার্তিক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।

কিন্তু এ ঘটনার মাধ্যমে সংবাদক্ষেত্রের কন্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ১৯২৩ সালের ব্রিটিশদের দ্বারা প্রণীত দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন এবং বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় শাহবাগ থানা পুলিশ মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণ (এফআইআর) গঠন করেছে। দন্ডবিধির ধারা দু’টি সাধারণ চুরি সংক্রান্ত অপরাধ।

একজন সাংবাদিকের মন্ত্রণালয়ে প্রবেশের অনুমতি থাকার পর ‘তথ্য সংগ্রহ’ কীভাবে ‘তথ্য চুরি’র অপরাধের মধ্যে পড়ে সেটা জানার জন্য নতুন সংজ্ঞায়ন জরুরি! ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায়
এবং সংবাদ সংস্থা এএনআই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু নথি প্রকাশ করলে তাকে চুরি আখ্যায়িত করে দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেয় ভারত সরকার।
২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে যুদ্ধ বিমান ক্রয় সংক্রান্ত মামলার শুণানীকালে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন এসব নথি অননুমোদিতভাবে ফটোকপি করে ফাঁস করা হয়েছে এবং এসব যুদ্ধবিমানের ক্ষমতা সম্পর্কিত হওয়ায় তা প্রকাশ জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক এবং ফান্সের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ
সর্ম্পকে নষ্ট করবে।

তথ্য অধিকার আইন ২০০৫ পাস হওয়ায় ভারতের ব্রিট্রিশ আমলের দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনটি এক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারিয়েছে বলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সরকারের
অভিযোগ ন্যাসাৎ করেন। ভারতে দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনের অধীনে বেশ কয়েকজন
সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছেন কিন্তু আদালতে শেষ পর্যন্ত তারা খালাস পেয়েছেন।

সবচেয়ে আলোচিত মামলা ছিল শান্তনু সাইকিয়ার বিরুদ্ধে। তিনি ভারতের মন্ত্রীসভার মিটিং অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই ফাঁসকৃত নথি নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। ১০ বছর কারাবন্দি থাকতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু দিল্লির আদালত তাকে মামলা থেকে খালাস দিয়ে বলেন সকল সরকারি তথ্য গোপন তথ্য নয়, তথ্য ফাঁস হলেই তা গোপন নয়।

একজন সাংবদিককে উপনিবেশিক ওই আইনে সাজা দেওয়া যায় না বলে আদালত মন্তব্য করেন।
রোজিনা ইসলাম বাংলাদেশে প্রথম একজন সাংবাদিক যিনি উপনিবেশিক ওই আইনে গ্রেফতার হয়েছেন।

অভিযোগ তথ্য চুরি। জনগণের করের টাকায় লক্ষ লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে
প্রকাশ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন নথি’ বলেছে সেটা কীসের ভিত্তিতে? অবশ্যই সেটা গুরুত্বপূর্ণ নথি হতে পারে। তবে দাপ্তরিক গোপনীতা আইন
১৯২৩ অনুযায়ী ‘নিষিদ্ধ এলাকার’ মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পড়ে না।

এ আইনের ২ (ঘ) উপধারা অনুযায়ী নিষিদ্ধ এলাকা অর্থ সরকার কর্তৃক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ‘নিষিদ্ধ এলাকা’। এখানকার তথ্য বা ডকুমেন্টস ওই ব্রিটিশী আইনের ‘গোপন তথ্যের’ মধ্যেও পড়ে না। রোজিনা ইসলামের কাজ ছিল তথ্য সংগ্রহ করে সংবাদ প্রকাশ তা কোনভাবেই ওই আইনানুযায়ী‘গুপ্তচরবৃত্তি’ নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা স্বার্থের পরিপন্থীও নয়, বরং জনস্বাস্থ্যের তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়াটি ছিল জনস্বার্থের জন্য।

বিদেশি কোন শক্তির স্বার্থে বা বিদেশি কোন সংস্থাকে দেওয়ার জন্যও রোজিনা ইসলাম কখনো তথ্য ব্যবহার করেননি বরং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির তথ্য জনস্বার্থে বা জনগণকে
জানানোর কাজটি করেছেন। ঘটনার দিন একইভাবে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বা স্বার্থ সর্ম্পকিত ‘গোপন তথ্য’ হলে সেটা কখনও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে থাকবে কেন?

এ ধরনের ‘গোপন তথ্য’ সংরক্ষণের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরই বিভাগীয় শাস্তি হওয়া উচিত। রোজিনাকে হেনস্থা করা ও মামলা করার পিছনে মূল কী কারণ তা
উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। তবে এ কথা না উল্লেখ করলেই নয় যে তিনি বড় বড় রাঘব-বোয়ালদের দুর্নীতির খনি বের করেছিলেন, রিপোর্ট করেছিলেন। সরকার তার অনুসন্ধানকৃত তথ্যে নিশ্চয় উপকৃত হয়েছেন। কারণ তাঁর অনুসন্ধানী তথ্য সরকারের দুর্নীতি দমনে শুধু সহায়ক নয়, অপরিহার্যও বটে।

সাংবাদিকতার কন্ঠরোধ করে দুর্নীতি ঢাকার কোন কৌশল রয়েছে কিনা তা বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ,
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এবং জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন ২০১১ থাকার পর উপনেবেশিক আমলের আইনটি কার্যকারিতা হারিয়েছে যা ভারেতের আদালতের এ
সংশ্লিষ্ট রায়গুলো দেখলেই পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।

রোজিনা ইসলামকে অবিলম্বে মুক্তি দিয়ে দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণভাাবে বলবৎ করতে হবে। তবেই জাতি জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধুু শেখ মুজিবুুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীনতার স্বাদ পাবে।

একুশে সংবাদ/মাহামুদুল হক

 

মতামত বিভাগের আরো খবর