সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ভেঙে ফেলা হচ্ছে কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের স্বর্ণকমল

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৫:১০ পিএম, ৪ জানুয়ারি, ২০২৩

কুখ্যাত খুনী এরশাদ শিকদারের বিলাসবহুল বাড়ি ‘স্বর্ণকমল’ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ভবনটির একাংশ ভেঙে সেখানে তৈরি করা হবে ১০ তলা বিল্ডিং। বুধবার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে দোতলা এ বাড়িটির একাংশ ভাঙতে দেখা গেছে শ্রমিকদের। তবে এ বিষয়ে এরশাদ শিকদারের পরিবারের কেউ সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

 

তবে বাড়ি ভাঙার কাজে নিয়োজিত শ্রমিক রবিউল জানান, স্বর্ণ কমলের অর্ধেক ভেঙে ফেলা হবে। যেখানে ১০ তলা বিল্ডিং করা হবে। এরশাদ শিকদারের ছেলেরাই ১০ তলা বিল্ডিং করবে।

 

খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গার মজিদ স্মরণিতে দাঁড়িয়ে ছিল তার বিলাসবহুল বাড়িটি। এরশাদ শিকদারের বহু অপকর্মের সাক্ষী ছিল এ বাড়ি। কোনো এক সময় এ বাড়ি দেখার জন্য ভিড় লেগে থাকতো।

 

২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর করার পর জৌলুশ হারানো বাড়িটি ছিল রহস্যে ঘেরা।

 

জানা যায়, এরশাদের দুই স্ত্রী খোদেজা বেগম ও সানজিদা নাহার শোভা। এরশাদ শিকদারের তিন ছেলে রয়েছে। তারা হলেন মনিরুজ্জামান শিকদার জামাল, কামাল শিকদার ও হেলাল শিকদার। যারা পেশায় ব্যবসায়ী। এছাড়া সুবর্না ইয়াসমিন স্বাদ ও জান্নাতুল নওরিন এশা  নামে এরশাদ শিকদারের দুই মেয়ে ছিল। যার মধ্যে এশা ২০২২ সালের ৩ মার্চ আত্মহত্যা করে মারা যান।

 

কথিত আছে, এরশাদ শিকদারের বিলাসবহুল বাড়ি স্বর্ণকমল যে বানিয়েছিল তাকেও নির্মমভাবে মরতে হয়েছিল এই ভয়ানক খুনি এরশাদ শিকদারের হাতে। তার অপরাধ ছিল, এই বাড়িটি বানানোর সময় কিছু অংশ ঢুকে গিয়েছিল অন্যের জমির ভেতরে।

 

জানা যায়, এরশাদ শিকদার যখন জীবিত ছিলেন তখন অবৈধ উপায়ে হাজার হাজার কোটি টাকা অর্জন করেছিলেন। ছিনতাই,খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, চোরাচালানি, ভূমি জবরদখল সহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করতেন না। এই অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা তিনি ব্যাংকে রাখার পাশাপাশি এলাকায় বিভিন্ন ধরনের  দাদন ব্যবসা, সুদের ব্যবসা, জমি ক্রয় বিক্রয় ও বিভিন্ন দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের ধার দিয়ে তাদের সঙ্গে সু সম্পর্ক বজায় রাখতেন। আর এই অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা দিয়েই তিনি এই বিলাসবহুল বাড়ি স্বর্ণকমল তৈরি করেছিলেন। সেই সময়ে বাড়িটিতে গোপন কুঠরি এবং অস্ত্র ভাণ্ডারের ছিল বলে শোনা যায়। ওই বাড়িটির বিভিন্ন গোপন স্থানে নগদ কয়েক কোটি টাকা লুকানো ছিল। প্রায়ই জলসা বসত বাড়িটিতে। শহরের নামীদামী ব্যক্তিরা যেতেন সেখানে। এক সময় সাধারণ মানুষের খুব আগ্রহের একটি জায়গা ছিল ‘স্বর্ণকমল’। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ বাড়িটি দেখতে আসত। আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ওই বাড়িটি।

 

সারা দেশে আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার হিসেবে এরশাদ শিকদারের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল তার উত্থানের পর পরই। সেই প্রতিপত্তির নমুনা হিসেবে তার আস্তানা তৈরি হয় বিশাল এক বাড়িতে, নাম ‘স্বর্ণকমল’। খুলনার সে সময়ের সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়ি ছিল স্বর্ণকমল। ভারত থেকে নকশা করে আনা হয়েছিল এই বাড়ির। দেশ বিদেশের দামী দামী সব আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো এই বাড়ির ভেতরেই লুকিয়ে থাকার জন্য ছিল বাংকার। এরশাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ৭০টি অস্ত্র থাকার তথ্য পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে পুলিশ সেই বাংকার থেকে উদ্ধার করেছিল কেবল একটা বিদেশি বন্দুক ও আর একটা পিস্তল।

 

এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে প্রায় ৬০ টিরও বেশি খুনের অভিযোগ ছিল। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর দুধ দিয়ে গোসল করতেন তিনি ও তার সহযোগীরা। অসংখ্য নারী ধর্ষণ, একাধিক বিয়েসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা এরশাদ শিকদার তার জীবদ্দশায় করেননি।

 

এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার বাবার নাম বন্দে আলী। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি তার জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় চলে আসেন। খুলনায় আসার পর এরশাদ সেখানে কিছু দিন রেলস্টেশনের কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করত এমন দলের সঙ্গে যোগ দেন। পরে তিনি তাদের নিয়ে নিজেই একটি দল গঠন করেন ও এলাকায় ‘রাঙ্গা চোরা’ নামে পরিচিতি পান। ১৯৭৬-৭৭ সালে তিনি ‘রামদাবাহিনী’ নামে একটি দল গঠন করেন, যারা খুলনা রেলস্টেশন ও ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকত। এ রামদাবাহিনী নিয়েই এরশাদ ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখল করেন এবং এর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।  

 

১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তিনি তৎকালীন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের (বর্তমান ২১ নম্বর ওয়ার্ড) কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর এরশাদ শিকদার বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর এরশাদ আবারও দল পরিবর্তন করেন। ১৯৯৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার সময়ও তিনি ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি ৪ নম্বর ঘাট এলাকা থেকে রফিক নামে একজন বরফকলের মালিককে ভয় দেখিয়ে বিতাড়িত করে বরফকল দখল করেন। সব ব্যবসায়ীকে তার কল থেকে বরফ কিনতে বাধ্য করেন।

 

হাসতে হাসতে নির্মম পৈশাচিক অত্যাচার করে মানুষ হত্যা করতো এরশাদ শিকদার। বরফকল ছাড়াও খুলনা শহরের বিভিন্ন জায়গায় কতগুলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানিয়েছিল সে। রেলওয়ে এলাকার পুরাতন পানির টাংকি, বরফকলের পেছনে পরিত্যক্ত মঠ এসব জায়গায় ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পগুলোর কোনোটাতে মানুষ মারা হতো ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে, কোনোটায় গুলি করে।

 

জেমস বন্ড সিনেমার ব্লোফেল্ডের মানুষখেকো পিরানহা মাছের সেই ভয়ঙ্কর পুলের মত এরশাদ শিকদার তার বস্তির ভেতরে বানিয়েছিলেন ১০ থেকে ১২ হাত গভীর একটা হাউজ। ওই হাউজে চাষ হত রাক্ষুসে আফ্রিকান মাগুর। পৈশাচিক কায়দায় মানুষ খুনের পর লাশ ফেলে দেয়া হত এই হাউজে। একেকটা রক্ত মাংসের মানুষের শরীর হয়ে উঠত রাক্ষুসে মাগুরের খাবার।  

 

একুশে সংবাদ/আ.হো.প্রতি/এসএপি

সারাবাংলা বিভাগের আরো খবর