সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

তীব্র দাপদাহে লোডশেডিং, ভুগছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ১২:৫৫ পিএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৩
ছবিঃ সিয়াম শেখ

গ্রীষ্মের দাপদাহে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার কথা মাথায় রেখে তিন মাসের (এপ্রিল থেকে জুন) গড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ।

 

মঙ্গলবার (১৮এপ্রিল) বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ১৫ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড করেও চাহিদা পূরণ করতে পারেনি।  সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার ২২১ মেগাওয়াট। এ কারণে মানুষ শুধু প্রচণ্ড গরমে ভুগছে না-তারা বোরো ধানের খেতে পানি দিতে পারছে না।

গত কয়েকদিন ফেনী ও ময়মনসিংহ বিভিন্ন স্থানে  বিক্ষুব্ধ মানুষ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।

 

জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভ দেখে দ ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মঙ্গলবার জেলা পুলিশ সুপারের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র বা স্থাপনাসমূহ ও তার সহকর্মীদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

 

দাপদাহের সময় অসহনীয় লোডশেডিংয়ের কারণে সম্মানিত গ্রাহকগণ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন এবং সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে চিঠিতে উল্লেখ করেন তিনি। দিনে ১০ থেকে ১৯ বার পর্যন্ত বিদ্যুৎ চলে যায়। দিনে মোট ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না তারা।

বিদ্যুত বিভাগ সুত্র জানায়, গত বছর বিতরণ কোম্পানিগুলো আগে থেকেই লোডশেডিংয়ের সময় সূচি প্রকাশ করেছিল।কিন্তু এবার কখন কোথায় বিদ্যুৎ যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। গ্রাহকদের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কম।

 

রমজানের প্রথম ৩ সপ্তাহ ঢাকা মহানগরীসহ অন্যান্য শহরাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দিনে দিনে গরমের তীব্রতা যতই বাড়ছে, অন্য শহরগুলোতে ভোগান্তি বাড়ছে।

 

দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। কিন্তু, কিছু কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ বা জ্বালানি সংকটের কারণে বন্ধ রাখতে হয় বলে  পিডিবির মুখপাত্র শামীম হাসান।

 

তিনি বলেন, আমরা আমাদের পরিকল্পনা মতোই বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। প্রতিনিয়ত রেকর্ড উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এখন মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিরিক্ত গরম। এই সময় এত গরম পড়বে, সেটা ধারণারও বাইরে ছিল।

 

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার বর্ষা গ্রামের বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ জানান, দিনের বেলা বাড়ি থেকে বের হলে আগুনে পুড়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়। আর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে রাতে বাড়িতে থাকাও সমান কষ্টকর। মনে হয় সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।

 

রংপুর জোন-৩ এর নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহাবুবুল হক বলেন, ‍‍`জোনের অধীনে দৈনিক চাহিদা প্রায় ১৪ মেগাওয়াট কিন্তু গত ৩ দিন ধরে দৈনিক মাত্র ৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।

 

বিদ্যুত বিভাগ সুত্র অরো জানায়, গত ৬ এপ্রিল থেকে দিনে ৭৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে ভারতের আদানি গ্রুপ। দেশের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা থেকে এখন পাওয়া যাচ্ছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বেশি। তবে নিজস্ব কয়লায় চালিত বড়পুকুরিয়ায় একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে আছে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তিন দিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরুর পর ইতিমধ্যে কেন্দ্রটি কয়েক দফায় বন্ধ হয়েছে। কারিগরি কারণে আশুগঞ্জ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিট বন্ধ হয়ে আছে।

বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে জ্বালানির (গ্যাস, তেল, কয়লা, পানি) অভাবে উৎপাদন করা যাচ্ছে না দুই হাজার মেগাওয়াট। আর যান্ত্রিক ত্রুটি ও রক্ষণাবেক্ষণে থাকার কারণে উৎপাদন করা যাচ্ছে না ৩ হাজার ২৪১ মেগাওয়াট।

চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে ঢাকার বাইরে।

 

পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার  বলেন, রামপালসহ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ আছে। সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে। চাহিদা মেটাতে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এখনো সর্বোচ্চ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা চলছে।

 

লোডশেডিংয়ে ময়মনসিংহের বেশির ভাগ এলাকার মানুষ ভুগছেন। পিডিবির ময়মনসিংহের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ময়মনসিংহের ছয় জেলায় চাহিদার তুলনায় সরবরাহের ঘাটতি ৩০০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত।

 

নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই লোডশেডিংয়ের কোনো রুটিন মানা যাচ্ছে না।

 

গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ৫৫ শতাংশ তাদের অধীনে। গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে গ্রাম এলাকাতেও। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাটতি বেশি হচ্ছে। রাতেও হচ্ছে কিছু কিছু।

সংস্থাটির সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী   বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করা হচ্ছে। লোড ভাগাভাগি করে লোডশেডিং করা হচ্ছে।

 

রাজধানী ঢাকাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুটি সংস্থার তথ্য বলছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। চাহিদামতো সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন আধুনিকায়ন করা হয়নি। তাই এখন বাড়তি সরবরাহ নিতে পারছে না কোনো কোনো বিদ্যুৎ বিতরণ ট্রান্সফরমার। আকস্মিকভাবে ট্রিপ (বন্ধ হয়ে যাওয়া) করে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।  গ্রীষ্মে ডেসকোর সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এবার ১ হাজার ২৯১ মেগাওয়াট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। এ সময় ডিপিডিসির স্বাভাবিক চাহিদা থাকার কথা ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার ৮৬৫ মেগাওয়াট।

 

গরমের কারণে অনেকে নতুন করে এসি বসাচ্ছেন। এতে অনুমোদনের চেয়ে বেশি লোড ব্যবহার করছেন বিদ্যুৎ গ্রাহকেরা। ফলে গ্রাহকের লাইন চাপ নিতে না পারায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও তাই ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ না পেয়ে লোডশেডিংয়ের অভিযোগ করছেন গ্রাহকেরা।

 

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান  বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। লোডশেডিং করা হচ্ছে না। কিছু কারিগরি সমস্যা হচ্ছে। তবে কোনো গ্রাহক লোড বাড়ানোর আবেদন করলে তা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও ভোক্তা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। তবুও গরমে কষ্ট পাচ্ছেন মানুষ।

 

ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম  বলেন, দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। বিদ্যুতের ঘাটতি গ্রামে পাঠিয়ে দেন কর্তারা। সমতার ভিত্তিতে বণ্টন করলে এটা সহনীয় হতো। আর সমাজের সুবিধাভোগীরা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পড়লে এ খাতের সমস্যারও সমাধান হবে। এখন গরম থেকে স্বস্তি পেতে বিদ্যুৎ নয়, বৃষ্টির ভরসায় থাকতে হবে।

 

বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন বলেন, এবার তাপপ্রবাহ প্রায় ৫০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। এ কারণে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও দেশে লোডশেডিং হচ্ছে।

 

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন,  এ বছর গ্রীষ্ম সেচ মৌসুম এবং রোজা একসাথে হওয়াতে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে সেটা আমরা ধারণা করেছিলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা পূর্ব প্রস্তুতির স্বাক্ষরও রেখেছি। কিন্তু গত ৫০ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে বর্তমানে নজিরবিহীন দাবদাহ চলছে। এর ফলে ধারণার চেয়েও বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। দেশের অনেক জায়গায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ভোগের জন্য আমরা আন্তরিক সহমর্মিতা ও দুঃখ প্রকাশ করছি।  আশা করছি খুব শীঘ্রই আবারও স্বস্তিদায়ক পরিবেশ ফিরে আসবে। ধৈর্যধারণের জন্য গ্রাহকদের ধন্যবাদ জানাই।

একুশে সংবাদ.কম/আ/বি.এস

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের আরো খবর