সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

মৃত্যুজালে জীবন!

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৭:৩৫ পিএম, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৩

অসুস্থ মাকে দেখভালের জন্য ১০ বছর পরে দেশে এসেছিলেন প্রবাসী লিমা। ইচ্ছে ছিল মা একটু সুস্থ হলেই দুজনে একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে উড়াল দেবেন। কিন্তু সে আশা পূরণ হলো না। ১৭ জানুয়ারী শরীয়তপুরে মাকে চিকিৎসা করাতে এসে সড়কে মায়ের সঙ্গে নিজের জীবন হারালেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মেয়ে। শুধু তাই নয়, এরসাথে আরো চার জন প্রাণ হারালেন।

 

সর্বত্র মৃত্যুজাল। জল-স্থল-আগুন এমনকি মানুষের কাছেও মানুষ নিরাপদ নয়। এমনি এক ঘটনার স্বাক্ষি হলো দেশবাসী। বুধবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে জাজিরা দূর্ঘটনা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সড়কে রক্তের ছাপ পড়ে আছে। গাড়িতে লেগে আছে রক্তের দাগ। স্বজনদের মধ্যে কেউ এসে কান্নায় মূছরা যান। উৎসুক দর্শকরা ঘটনা শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না।

No description available.

 

ঘটনাস্থলে কথা হয় শরিয়তপুরের বাসিন্দা মোবারক হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, কালকে টিভিতে খবর দেখলাম। আজ দেখতে এলাম। ঘটনা শুনে চোখের পানির ধরে রাখতে পারিনি। কীভাবে ছয়টি মানুষ স্পট ডেড হয়ে গেল। মেনে নেয়া যায়না।

 

এ বিষয়ে চার জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা হয়। তারা কেঁদে কেঁদে বলেন, বেচে থাকা খুব কঠিন। সবচেয়ে সহজ মারা যাওয়া। প্রতিটি পদে পদে মৃত্যুকে সঙ্গী করে আমরা উড়ে বেড়াই। তবে সৃষ্টিকর্তার চিত্রনাট্য যে কখনো কখনো আমাদের ভাবনার চেয়েও অধিক প্যাথেটিক। নিজ হাতে তৈরি রুহের বিনাশের দিনক্ষণও যে তিনি নিজের মত করেই সাজিয়েছেন। সেখানে আমরা কেবল আশ্চর্যান্বিত হওয়া দর্শক।

 

সূত্র বলছে, ১৭ জানুয়ারী হঠাৎ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন লিমার মা জাহানারা বেগম। বরিশালের ডাক্তাররা তাকে রেফার করেন ঢাকার বারডেমে। দ্রুত নিয়ে যেতে বললে রাতেই এ্যাম্বুলেন্সে রওয়ানা দেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে ছিলেন চাচাতো ভাই ফজলে রাব্বি ও তার শিক্ষক মাসুদ রানা। কিন্তু ভোররাতে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের নাওডোবা এলাকায় অ্যাম্বুলেন্সটি চলন্ত একটি ট্রাককে পেছন থেকে  ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান রোগীসহ গাড়িতে থাকা ছয়জন। কতগুলো ব্রাকেটবন্দী স্বপ্নের রক্তস্নাত মৃত্যু। এক নিমিষেই মানুষ থেকে লাশ। দুনিয়ার ফেরারি জীবন থেকে নিশ্চিত গন্তব্য।

 

প্রত্যক্ষদর্শী আসাদ হাওলাদার বলেন, আমি আপনিও রাস্তায় চলাচল করি, এভাবেই একদিন সবাই শুনবে একটি লাশ বেড়ে গেছে। এরপর হয়তো পরিচিতজনদের ভাবনার জগতে ১০ সেকেন্ড সময় নিবে, তারপর অতীত। বড়জোর কেবল দিন তিনেকের শোক। মৃতদের কেউ মনে রাখেনা, বিস্মৃতির অতীত ভেবে ভাবনার জগৎ থেকে দূরে রাখে। সোনায় মুড়িয়ে রেখে গেলেও খুব কম মানুষই স্মরণ করবে।  অলাভজনক শোকে এক মিনিট ব্যয় করতেও রাজি না যে আমরা।

 

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সুফিয়া বেগম বলেন, জীবনটাকে রোবট বানিয়েছি আমরাই। অথচ এক সেকেন্ডের গ্যারান্টি নেই। এখন সম্পদ বানাই, শেষ বয়সে ভোগ করবো। কিন্তু ভাগ্যের লিখন সবসময় যে পক্ষে যায় না। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ফ্যাসাদে দাফন-কাফনেই দেরি হবে অনেকের। অনেকের ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তার কাছে সন্তানের দুটো হাতও উঠবেনা কোনদিন। সম্পদের ভাগ কম পেয়েছে বলে আক্ষেপ থাকবে তাদের। কি অদ্ভুত মানবজনম। জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর অলিখিত চুক্তি, সারাক্ষণ সঙ্গী করে ঘুরে বেড়াই, কিন্তু সঙ্গীকে ভাবনায় রাখিনা। বেঁচে থাকা খুব কঠিন। সবচেয়ে সহজ মরে যাওয়া। প্রতিটি পদে পদে মৃত্যুকে সঙ্গী করে আমরা উড়ে বেড়াই।

মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রাণ হারালেন মেয়ে

 

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লুৎফুন নাহার লিমার বোনের মেয়ে লিনা নাহার বলেন, গত মঙ্গলবার ভোরে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে নাওডোবা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মা-মেয়েসহ ছয়জন নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মেয়ে ক্যানসার আক্রান্ত মাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছিলেন। জাজিরায় আমার নানি, খালা, অ্যাম্বুলেন্স চালক ও হেলপারসহ সবার প্রাণ দিতে হয়। এ ঘটনা শোনার পর পরিবার ও স্বজনরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে।

 

নিহত জাহানারা বেগমের মেয়ে শিল্পী আক্তার জানান, তার মায়ের ক্লোন ক্যানসার ছিল। গত সোমবার রাতে ব্রেইন স্ট্রোক করায় তার মাকে প্রথমে বরিশালের বেলভিউ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় রাতেই মাকে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হন তার বোন (লিমা)সহ স্বজনরা। পথে জাজিরার পদ্মা সেতু প্রান্তে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান তারা। তিনি বলেন, আমার বাবা ২০০০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় থাকেন। চিকিৎসা করাতে এসেছিল লিমা। চিকিৎসা করিয়ে কিছুটা সুস্থ করে মাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লিমা আর মায়ের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া হলো না। এই শোক আমরা কী করে বহন করব।

 

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে সারাদেশে সড়কপথে ৫ হাজার ৭০টি দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৭৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে রেলপথে ২৫৬টি দুর্ঘটনায় ২৭০ জন এবং নৌপথে ৭৭টি দুর্ঘটনায় ২০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে গেল বছর সড়ক, রেল ও নৌপথে ৭ হাজার ২৪টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ১০৪ জনের মৃত্যু এবং ৯ হাজার ৭৮৩ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া অপ্রকাশিত তথ্য ও হাসপাতালে ভর্তির পর এবং হাসপাতাল থেকে রিলিজের পর আনুমানিক ১ হাজার ৮৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর সবচেয়ে বেশি ৬৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে মার্চে এবং সবচেয়ে কম ৩৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে অক্টোবর মাসে।

 

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আইন তো অনেক আছে, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয় কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য পুলিশকে অ্যাকটিভ হতে হবে। বিদেশে দেখেন রাস্তায় এতো মানুষ, এতো গাড়ি-কেউ কিন্তু আইন ভাঙে না, কারণ পুলিশ অনেক টাকা জরিমানা করে। আসলে ভয় দেখানোর মতো আইন প্রয়োগ করলে শৃঙ্খলা আপনা আপনি আসবে।

 

হাইওয়ে পুলিশ ফরিদপুর সার্কেলের এএসপি মারুফ হাসান বলেন, হঠাৎ করেই থানার পাশে বিকট চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে দেখি ঘটনাস্থলেই ৬ জনের মৃত্যু। আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও দক্ষিণ থানা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে লাশ উদ্ধার করে জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। সুরতহাল শেষে লাশগুলো স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দিই। যেহেতু অ্যাম্বুলেন্সে থাকা সবাই মারা গেছেন তাই প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি অ্যাম্বুলেন্স চালক তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল অথবা ঘন কুয়াশার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে।

 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী মহাসড়কের উভয় পাশে ১০ মিটার খালি রাখার বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে দুর্ঘটনা বাড়বেই। তা ছাড়া সর্বত্র মৃত্যুজাল। জল-স্থল-আগুন এমনকি মানুষের কাছেও মানুষ নিরাপদ নয়। মৃত্যুজালে জীবন। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ থেকে লাশ হচ্ছে প্রতিনিয়তই। তবুও মানুষের মধ্যে সচেতনা নেই। সড়ক আইন মেনে কেউ পথ চলছে না।

 

যেসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হয়: ১. বেপরোয়া গতি; ২. বিপদজনক অভারটেকিং; ৩. রাস্তা-ঘাটের ত্রুটি; ৪. ফিটনেসবিহীন যানবাহন; ৫. যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা; ৬. চালকের অদক্ষতা; ৭. চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার; ৮. মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো; ৯. রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা; ১০. রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা; ১১. ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ; ১২. ছোট যানবাহন বৃদ্ধি; ১৩. সড়কে চাঁদাবাজি; ১৪. রাস্তার পাশে হাট-বাজার এবং ১৫. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো।

 

উল্লেখ্যে, নিহত জাহানারা বেগম পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আমেরিকা প্রবাসী লতিফ মল্লিকের স্ত্রী। আর লুৎফুন্নাহার লিমা তাদের মেয়ে। ২০১০ সালে বাবার কাছে যান লিমা। পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার লিমা সেখানকার একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিল। মা গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। মায়ের চিকিৎসা করাতে লিমা তিন মাস আগে দেশে আসে। চিকিৎসা করিয়ে কিছুটা সুস্থ করে মাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তার।

 

একুশে সংবাদ/এসএপি

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের আরো খবর