সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

‘সুভাষকে বোঝা শক্ত’, সুভাষচন্দ্র ও তাঁর ভাবনা

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০২:০২ পিএম, ২৪ জানুয়ারি, ২০২১

‘বাঙালি কবি আমি, বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি…’, ১৯৩৯ সালের ২৭ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্রকে এক পত্রে এই কথাগুলিই লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর এই মূল্যায়ন যে কিছুমাত্র ভ্রান্ত ছিল না, তা সুভাষচন্দ্রের জীবন সম্পর্কে যাঁর কিছু মাত্র ধারণা আছে, তিনিই জানেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, যা তাঁর এই দেশনায়ক উপাধির যথার্থতা বারংবার প্রমাণ করেছে, তা নিয়ে বহু আলোচনা পূর্বেও হয়েছে, বর্তমানেও হয়ে চলেছে। সেই বিষয়ে আজ তাঁর জন্মদিনের দিনে আলোকপাত করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এর উদ্দেশ্য কিছু আলাদা। ব্যক্তিপুজোর চল বিশ্বের সর্বত্রই কম বেশি রয়েছে, বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি দেশবরেণ্য ব্যক্তি হন তাহলে তো কথাই নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ওয়াশিংটন, ইতালিতে মাতসিনি ও গ্যারিবল্ডি, আয়ারল্যান্ডে ডি ভ্যালেরা ও জেমস কনোলি, ভিয়েতনামে হো-চি-মিন, কিউবায় হোসে মার্তি, লাতিন আমেরিকায় কলম্বিয়া বা ভেনেজুয়েলায় সাইমন বলিভার – প্রত্যেক দেশেরই জাতীয় নেতাদের ঘিরে একপ্রকার ব্যক্তিপুজোর মনোভাব থাকে, যেমন আমাদের দেশে আছে মহাত্মা গান্ধি বা নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে। কিন্তু এই মনোভাবের সমস্যা আছে। কী সমস্যা? কবির ভাষাতেই– “তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি”। ব্যক্তিপুজো আমাদের শুধু ব্যক্তির পুজোই শেখায়– তাঁদের মতো আর পথকে শেখায় না, তাঁদের ভাবনাকে মোহমুক্তভাবে বিচার করতে শেখায় না। আর শেখায় না বলেই দিনের শেষে মূর্তিতে শুষ্ক মালা আর মুখস্থ করা কটা উদ্ধৃতির মধ্যেই মনীষী স্মরণ হয়। এই লেখাটির উদ্দেশ্য তাই আজ সুভাষের জন্মদিনে সংক্ষেপে তাঁর রাজনৈতিক মত নিয়ে আলোচনার একটি প্রচেষ্টা করা।


সুভাষচন্দ্রের ভাবনায় একপ্রকার দার্শনিক দীক্ষা ও বাস্তববোধের অপূর্ব মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বিবেকানন্দ পাঠ করেই সুভাষ সিদ্ধান্তে আসেন জীবনে পূর্ণ মনুষ্যত্বের বিকাশের মাধ্যমে লক্ষ্যে উপনীত হতে গেলে তিনটি বিষয় দরকার। সেগুলি হল – অতীতের সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়া, বর্তমানকে সঠিক ভাবে অনুধাবন করা, ভবিষ্যতের ঝোঁক দক্ষতার সঙ্গে অনুমান করা। এই পন্থায় চলতে হলে আত্মত্যাগ ও আত্মনিবেদনের পথে হাঁটা একান্ত প্রয়োজন। তাঁর নিজের জবানিতেই ‘In order to fully realise an ideal, you must be prepared to renounce everything for its sake.’ সৈনিকের মতো লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে সন্ন্যাসীর মতো ত্যাগ প্রয়োজন – বিবেকানন্দ থেকে সুভাষ যে শিক্ষা নিয়েছিলেন তার এক বাক্যে চুম্বক এটিই। তাঁর ভাবনার আধ্যাত্মিকতা ও অতীন্দ্রিয়বাদও স্বামীজির থেকেই প্রাপ্ত। কিট্টি কুর্টি বলেছেন সুভাষ ছিলেন ‘….a mystic, a spiritual man.’। এই মিস্টিসিজম বা স্পিরিচুয়ালিজম কিন্ত ফাঁপা কর্মবিমুখ আধ্যাত্মিকতা নয়। সুভাষ স্বয়ং লিখেছেন – ‘নানা কারণে আমাদের জাতির কর্মের দিকটা শূন্য হয়ে এসেছে, তাই এখন আমাদের দরকার রজোগুণের “double dose”’। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন, সুভাষের এই ধর্মীয় চেতনা থাকা স্বত্তেও বা হয়তো তা থাকার জন্যই – সুভাষ ধর্ম ও অতীন্দ্রিয়বাদের দ্বারা রাজনীতিকে প্রভাবিত করার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি ধর্মের নাম করে ভন্ডামিরও ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর জবানীতেই – ‘…আজকাল ধর্মের নামেই যত অধর্ম হইতেছে-তীর্থস্থানেই যত পাপ।’

তিনি আরও লিখেছিলেন ‘…ধর্মোন্মত্ততার প্রতিকার হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং বৈজ্ঞানিক শিক্ষার চেয়ে উৎকৃষ্টতর আর কিছু নেই। এই ধরণের শিক্ষা অন্য একটি দিক থেকো প্রয়োজনীয়, কারণ এই শিক্ষা আমাদের অর্থনৈতিক চেতনা জাগ্রত করে। অর্থনৈতিক চেতনার উন্মেষ ধর্মোন্মত্ততার মৃত্যু ডেকে আনে। একজন মুসলিম কৃষক এবং একজন মুসলমান জমিদারের মধ্যে যতটা মিল তার চেয়ে ঢের বেশি মিল একজন মুসলমান কৃষক এবং একজন হিন্দু কৃষকের মধ্যে। তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ কোথায় নিহিত আছে জনসাধারণকে শুধু সেই শিক্ষা দিতে হবে, এবং একবার এই কথাটা বুঝতে পারলে তারা আর সাম্প্রদায়িক বিবাদে নিজেদের ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে দিতে রাজি হবে না।‘

 

জাতীয়তাবাদ সুভাষচন্দ্রের মতাদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। কিন্তু জাতীয়তাবাদের উগ্রতার বিপদ সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। ১৯২৮ সালের ৩ মে, মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে সুভাষ বলেন ‘…ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সঙ্কীর্ণ, স্বার্থপর অথবা আগ্রাসী কোনটাও নয়। এই জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণা মনুষ্যজাতির সর্বোচ্চ আদর্শ – অর্থাৎ সত্যম (সত্য), শিবম (শুভ), সুন্দরম (সুন্দর)’। ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ আমাদের মধ্যে সত্যনিষ্ঠা, সততা, পৌরুষ এবং সেবা আর ত্যাগের মনোভাব সঞ্চারিত করেছে।’ তাঁর জাতীয়তাবাদ ছিল বুকবাজানো পতাকা নাড়া রাষ্ট্রপুজোর দেশপ্রেম না, তাঁর জাতীয়তাবাদ ছিল দেশের মানুষের প্রতি সুগভীর ভালোবাসা সঞ্জাত দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ।

সমাজতন্ত্র ছিল সুভাষচন্দ্রের ভাবনার তিনটি প্রধান দিক – আধ্যাত্মিকতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কম আলোচিত অথচ অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুভাষ মনে করতেন সমাজতন্ত্রের ধারণা কোন বাইরে থেকে আগত বিদেশী ভাবনা নয়, যারা একে বিদেশী মতবাদ মনে করেন, তাঁরা ভারতের ইতিহাসের মূল সুর জানেন না।

 

‘সাম্যবাদ’ পাশ্চাত্য বিধান নয়’-এই মত তিনি বারংবার রেখেছেন। তবে কিছু সাম্যবাদীর ‘one size fits all’-এর তত্বে তিনি বিশ্বাস করতেন না। বারংবার মনে করেছেন, সমাজতন্ত্রের রাস্তায় চলার পথ প্রত্যেক দেশের ক্ষেত্রে তার ইতিহাস ও ভূগোলের ভিত্তিতে ভিন্ন। তাঁর জবানীতেই – ‘আমার বিশ্বাস অনাগত ভবিষ্যতে ভারতবর্ষে একটি আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক পরিকাঠামো উদ্ভাবন করতে সমর্থ হবে যা অনেকাংশে পৃথিবীর সামনে একটি আদর্শ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে প্রতিভাত হবে, যেমনভাবে বর্তমানকালে বলশেভিজম মানুষকে অনেক প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি না যে বিমূর্ত নীতিগুলি একই উপায়ে, রূপে এবং পরিমাণে বিভিন্ন জাতি বা দেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। রাশিয়ায় যখন মার্কসবাদ অনুসরণ করা হয় তখন রাশিয়ার প্রচলিত অবস্থার জন্যই বলশেভিজমের উদ্ভব হয়। অনরূপভাবে ভারতে যখন সাম্যবাদ অনুসরণ করা হবে তখন ভারতের প্রচলিত অবস্থা এক নতুন ধরণের সাম্যবাদ গড়ে তুলবে যাকে আমরা ভারতীয় সাম্যবাদ বলে স্বাগত জানাব। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, জাতিগত মনোভাব, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এ সবই কলমের এক খোঁচায় বাতিল করা যায় না। যে কোন আদর্শ যা আমরা বাস্তবে রূপায়িত করতে চাই এগুলি তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে বা তার পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য’ তবে অন্তিম লক্ষ্য নিয়ে তাঁর কোন দ্বিধা ছিল না। দৃপ্ত কন্ঠেই তিনি ঘোষণা করেছেন – ‘যা বলেছি, সংক্ষেপে তা হল আমি চাই ভারতবর্ষ এক সমাজতন্ত্রী প্রজাতন্ত্র।‘ এবং দ্বিধাহীন ভাবে বলেছেন – ‘আমার নিজের মনে কোনও সন্দেহ নেই, যে ভারতের এবং বিশ্বেরও মুক্তি নির্ভর করছে সমাজতন্ত্রের ওপর’।
সুভাষের সাম্যবাদ তাঁর ভাবনার অপর স্তম্ভ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু প্রখ্যাত সমাজতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী নেতা জেমস কনোলির মতোই সুভাষ এই দুইয়ের মধ্যে বিভেদ খুঁজে পাননি। তিনি মনে করেছিলেন ভারতীয় জনগণের সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতা – সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক – এর জন্য এই দুই আদর্শেরই দরকার। জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন রাজনৈতিক স্বাধীনতার নিমিত্ত এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতার নিমিত্ত প্রয়োজন সাম্যবাদ।

 

সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে আরেকটি অভিযোগ তোলা হয়, যে তিনি ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিলেন। এই যুক্তিও ভ্রান্ত যুক্তি। একথা অনস্বীকার্য মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের প্রতি তাঁর একদা আকর্ষণ জন্মেছিল ও সাম্যবাদ-ফ্যাসিবাদের সমন্বয়ের কিছু ভাবনাও তিনি ভেবেছিলেন। কিন্তু নাৎসি জার্মানি সম্পর্কে ড. থিয়েরফেলডারের লেখা চিঠিতে তাঁর এই উক্তিও প্রণিধানযোগ্য – ‘…জার্মানীর নতুন জাতীয়তাবাদ কেবল সঙ্কীর্ণ এবং স্বার্থপর নয় তা উদ্ধতও বটে।…এই নতুন জাতিগত দর্শন এক দুর্বল বৈজ্ঞানিক যুক্তির ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। তার উদ্দেশ্য হল সাধারণভাবে শ্বেতকায় জাতি, বিশেষ করে জার্মান জাতির গৌরব প্রচার। হের হিটলার সারা পৃথিবীতে শ্বেতকায় জাতির প্রভুত্ব করার অধিকারের কথা বলেছেন।…হের হিটলারের বক্তৃতার পর আমি একটি তীব্র প্রতিবাদপত্র ভারতীয় সংবাদপত্রের নিকট পাঠিয়েছি।’ ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অক্ষশক্তির যে সাহায্য তিনি নিয়েছিলেন, সেও ছিল কৌশল মাত্র। জাপানী সমরবাদের পূর্ব ভয়াবহতা বা জাপানী অধিকৃত পূর্ব এশিয়া বা আন্দামানে ভারতীয়দের উপর কি নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়েছে, তা সম্ভবতঃ তিনি জানতেন না, বা অবগত থাকলেও হয়তো পরিস্থিতির চাপে তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু করতে পারেননি। কিন্তু এই প্রসঙ্গে তাঁর মনোভাব বোঝা যায়, যখন দেখি তিনি জাপানী সহায়তায় ভারতীয় স্বাধীনতাকে ‘worse than slavery’ বলছেন। অনেকে শুধু অক্ষশক্তির সহযোগিতা নেওয়ার জন্য সুভাষকে ফ্যাসিবাদী চিহ্নিত করেন – এই যুক্তিতে ফরাসী রাজতন্ত্রের সাহায্য নেওয়ার জন্য ওয়াশিংটনকে রাজতন্ত্রী বা জার্মান সাম্রাজ্যের সহায়তা নেওয়ার জন্য লেনিনকে সাম্রাজ্যবাদী বলতে হয়।


পরিশেষে এইটাই বলার এই লেখার মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে সুভাষের ভাবনার বিপুল সিন্ধুর খুব সামান্যই এখানে লেখা সম্ভবপর হল। সুভাষচন্দ্র বসুর কর্মজীবন নিয়ে প্রচুর আলোচনা হলেও, তার ভাবনার আলচনা বিরল। অথচ তিনি নিজেই বলেছেন – ‘I was originally fashioned by nature to be first and foremost, a thinker, but circumstances have forced me into a life of hectic political activity…’। সুভাষের কর্মের প্রভুত পর্যালোচনা হয়, বছরের পর বছর তার স্তুতি কীর্তন হয়, কিন্তু তার অনুকরণ বা অনুসরণ হয় না। কেন ? আমার মতে তার কারণ হল, সেই কর্মের পশ্চাতে যে ভাবনা ছিল, তার যথার্থ পর্যালোচনার অভাব রয়েছে। সেই অভাব অতি সামান্য ভাবে, সেতু বন্ধনে কাঠবিড়ালির মতো, আজকের দিনে যদি এই লেখাটি পূর্ণ করতে পারে তাহলেই দেশগৌরব সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে ভারতের প্রতিটি নাগরিকের মতো আমারও যে ঋণ আছে তা সামান্য হলেও পরিশোধ হবে এই আশা রাখি।

 

একুশে সংবাদ/এম.এস/আ
 

সাহিত্য বিভাগের আরো খবর