সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

এক লাখ টাকায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেরিব্রাল পলসির চিকিৎসা

প্রকাশিত: ০৪:০১ পিএম, ১৪ নভেম্বর, ২০২০

আমাদের দেশের দরিদ্রতা, অশিক্ষা ও নারীর প্রতি অবহেলা -এই তিনটি কারণে সেরিব্রাল পলসি রোগের বিস্তৃতি বাংলাদেশ বেশি। শনিবার (১৪ নভেম্বর) দুপুরে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে সেরিব্রাল পালসির সার্জিক্যাল চিকিৎসা সংক্রান্ত সেমিনারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, পুষ্টিহীনতা ও বাচ্চা হওয়ার সময় পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পাওয়া। এ দুটি সমস্যার কারণে এ রোগটি হয়েও যেতে পারে। তাই আমাদের প্রথম কাজ হবে এটি প্রতিরোধ করা। যদি রোগটি হয়ে যায় তাহলে সার্জিকেল অপারেশন করা। সার্জিকেল অপারেশন এ রোগ ভালো হয়। চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অপারেশনে তিন থেকে চার লাখ টাকা নেই। আমরা কিন্তু এক লাখ টাকায় এ চিকিৎসা দিচ্ছি।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, ফেসিয়াল পলসির অর্থ হলো ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস (মুখ বেঁকে যায়, চোখ খোলা থাকে)। সেরিব্রাল পলসিও ঐরকম একটা রোগ। যেখানে ব্রেইনের কিছু কিছু অংশ নষ্ট হতে থাকে বা নষ্ট হয়। সোজা কথায় সেরিব্রাল পলসি মানে আমরা বলতে পারি আংশিক ব্রেইন প্যারালাইসিস।

তারা বলেন, সাধারণত জন্মের পর পর নবজাতক ভালোভাবে নিশ্বাস নিতে না পারার জন্য শরীরে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। এই অক্সিজেন স্বল্পতাই সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্রেইন। আমাদের দেশে ১০০০ বাচ্চা জন্মগ্রহন করলে তনমধ্যে ৩.৫ জন বাচ্চা আক্রান্ত হয় সেরিব্রাল পলসিতে। যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় ১.৫ গুণ বেশি। এই সমস্ত রোগীদের অধিকাংশ খিচুনী হয়। যখন খিচুনী হয় তখন বাচ্চা নিশ্বাস নিতে পারে না। এভাবে বারবার খিচুনী হলে ব্রেইন অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে ব্রেইন বারবার ক্ষতি হতে পারে।

এই সমস্ত বাচ্চাগুলি হাবা-গুবা হয়, হাটা চলাফেরা করতে পারে না, ঘাড় শক্ত করতে পারে না, পরিবারের সবার সাথে কমিউনিকেট করতে পারে না, মুখ দিয়ে লালা পড়ে, বাচ্চা শক্ত খাবার খাইতে পারে না,  রোগ যখন তীব্র হয় তখন বাচ্চা তরল খাবারও খাইতে পারে না। অনেক বাচ্চা কথাও বলতে পারে না, অনেক রোগী চোখে দেখে না, অনেক রোগীর হাত-পা শক্ত হয়ে যায় এবং এরা নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারে না। সব রোগীর ক্ষেত্রে সব গুলি লক্ষন থাকবে তা কিন্তু নয়। এই সমস্ত বাচ্চাদের মাথার খুলি ছোট থাকে।

এই সমস্ত বাচ্চাদের মাথার খুলি ছোট হওয়ার কারণে ব্রেইনের পর্দাও ছোট থাকে। মাথার খুলি যেহেতু বাড়ে না, কারণ মাথার জোড়া গুলো এক বছরের পূর্বে সম্পূর্ণ জোড়া লেগে যায়। যার ফলে ব্রেইন পুর্ণতা লাভের জন্য ৫ বছর পর্যন্ত বাড়তে হবে, তার আর সম্ভব হয় না।  

এমতাবস্থায় মাথার খুলি কেটে ব্রেইনের পর্দা কেটে প্লাস্টিক সার্জারী করে দিলে ব্রেইন  বাড়ার যথেষ্ট জায়গা পায়। যার ফলে দ্রæত ব্রেইন বৃদ্ধি পেয়ে পূর্ণতা লাভ করে এবং অন্যান্য উপসর্গ লোপ পায়।

সেরিব্রাল পলসির কারণ

১. জন্মকালে ব্রেইনে অক্সিজেন স্বল্পতা
২. ব্রেইনে সংক্রামন
৩. ২৮ সপ্তাহের পূর্বে বাচ্চার জন্মগ্রহন
৪. জন্মের পর অল্প ওজন থাকা
৫. গর্ভাঅবস্থায় ভাইরাস সংক্রম

অপারেশনকৃত সেরিব্রাল পলসি রোগীর পরিচয়

রোগীর নাম মোঃ সুমন, বয়স-১৩, বাবার নাম -ছুমর আলী, সখিপুর, টাঙ্গাইল। আমাদের এখানে ১০ দিন আগে ভর্তি হয়, বাচ্চা টাকা গুনতে জানত না, টাকা চিনত না, নিজে নিজে  চলাফেরা করতে পারত না। বাচ্চার খিচুনি হতো। জন্মের পর থেকেই বাচ্চার খিচুনি হতো। বাচ্চা সামান্য কিছুতেই ভয় পেত। পড়াশুনা করতে পারত না। ব্রেইনের সিটি স্ক্যান ও এমআরআই করলে দেখা যাচ্ছে এক পাশে ব্রেইনের কুঠুরি অনেক বড়। বামপাশের অক্সিপিটাল লোভ ক্ষতিগ্রস্ত (স্ট্রোক)। ডান পাশেরটাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে। অপারেশনের পর সাহস ফিরে পেয়েছে এবং টাকা গুনতে পারে ও চিনতে পারে। স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছে। বাচ্চার মাথার খুলিও স্বাভাবিকের মত বড় হচ্ছে।   এসময়ে সদ্য অশ্রপচারকারী সুস্থ্য সুমন উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশে উদ্ভাবিত অপারেশন পদ্ধতিঃ যা অধ্যাপক ডাঃ ফরিদুল ইসলাম বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে গত  ১ নভেম্বর খুলি কেটে সফল অশ্রপচার সম্পূর্ণ করেন।

রোগীকে অজ্ঞান করে কানের এক পাশ থেকে অপর পাশ পর্যন্ত  কেটে মাথার চামড়া পুরোটুকু কেটে মাথার খুলিকে উন্মুক্ত করা হয়। তারপর মাথার খুলির দুই পাশ কেটে নেওয়া হয়। এরপর মাথার খুলির প্লাস্টিক সার্জারী করে পুনরায় প্রতিস্থাপন  করা হয়। কিন্তু তার পূর্বে মাথার খুলি যখন অপারেশন করা হয় তখন ব্রেইনের পর্দা বা আবরণ বা ডুরামিটার কেটে আর্টিফিশিয়াল পর্দা লাগিয়ে দেয়া হয়। যাতে ব্রেইন বাড়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা পায়। পরবর্তীতে সবকিছু জায়গামতো প্রতিস্থাপন করে চামড়া সেলাই করে দেয়া হয়।

সেরিব্রাল পলসির প্রচলিত চিকিৎসা প্রসঙ্গে নিউরোসার্জন অধ্যাপক ডা. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, সাধারণত উন্নত বিশ্বে অনেক স্পেশালিস্ট নিয়ে যেমন- নিউরোজ সার্জন, নিউরো মেডিসিন, ফিজিক্যাল মেডিসন, সাইক্রিয়াট্রিষ্ট, অর্থপেডিক সার্জন সবাই মিলে একটা টিম গঠন করে একটা চিকিৎসা দেয়। যে সমস্ত মেডিসিন ব্যবহার করা হয় তা হলো এন্ট্রিইনফ্লেমেটরি,  খিচুনী বন্ধ হওয়ার ঔষধ, বেঞ্জোডাইয়াজিপিন, বেকক্লোফেন, ডেনট্রোলিন, গাবাপেনটিন, কাবিডোপা-লিবোডোপা, বেঞ্জট্রপিন। ইনজেকটেবল ফরমে দেওয়া হয় বটোলিনিয়াম টক্সিন এবং সাথে ফিজিউ থেরাপি দেওয়া হয়। সার্জারী যেটা করা হয় তা হলো বেক্লোফেন পাম্প,  টেনডোম রিলিজ, হিপ রোটেশন সার্জারী, স্পাইল ফিউশন, স্ট্রেবিসমাস রিপিয়ার, ডিপ ব্রেইন এসটিমুলেশন।

আমরা ব্রেইনের ভল্ট কেটে,  ব্রেইনের পর্দাসহ প্লাস্টিক সার্জারী করে প্রতিস্থাপিত করলাম। এতে রোগীর অন্য কোন চিকিৎসা খুব একটা প্রয়োজন পড়ছে না।  তবে ফিজিউথেরাপি ও অন্যান্য সাপোর্ট রোগীকে দ্রুত সুস্থ করে দেয়। আমাদের এই রোগীটা টাকা গুনতে পারতো না, টাকা চিন্তনা, ছোট বেলা থেকে ১ ২ ৩ ৪ গুণতে পাড়তো কিন্তু অক্ষর চিন্তনা। বাবার মার পাশ ছাড়া অন্য কোথাও যেতে পারতো না খুব ভয় পাইতো, এখন তার এই সমস্ত সমস্যা  নাই।

সেমিনারে মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিউরোসার্জন অধ্যাপক ডা. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী।

এ সময় আরো বক্তব্য রাখেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরো সার্জান ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোস্তফা মাহবুব, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের সহকারি অধ্যাপক ডাক্তার নাজমুল হক, শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মেজবা উদ্দিন আহমেদ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. কণা চৌধুরী ‌।

একুশে সংবাদ/এআরএম

স্বাস্থ্য বিভাগের আরো খবর