সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ষোল বছরে পা রাখলো পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ১২:০৮ পিএম, ৫ জুন, ২০২৩

ষোল বছরে পা রাখলো পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: কী দেখেছি, কী দেখছি, কী দেখতে চাই...

 

আলাপটা দীর্ঘ হওয়া দরকার, কিন্তু ফেসবুকে সেটা সম্ভব নয়। তবুও কিছু কথা বলা দরকার। বিশ্ববিদ্যালটি আজ পনেরো বছর পূর্ণ করে ষোলতে পা রাখলো। শিশির ভট্টাচার্য্যের ‍‍`বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস: আদিপর্ব‍‍`, রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‍‍`জীবনের স্মৃতিদ্বীপে‍‍`সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত শ-খানেক বই আমার সংগ্রহে আছে; সেগুলোর যতটুকু পড়েছি, তাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি মজবুত হওয়া এবং সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রধানতম দিকটি হলো- শিক্ষকদের পঠন-পাঠন, ন্যায়নিষ্ঠতা, দক্ষতা, গবেষণা, পাঠদান কার্যক্রম প্রভৃতি।

 

তাই এদেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকে গৌরবের যে দিকগুলো সবচেয়ে প্রশংসা পেয়েছে, সেটি হলো শিক্ষকদের জ্ঞানসাধনা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যলয়, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যা কিছু অহঙ্কার এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জ্ঞানসাধনা, কর্মদক্ষতা ও গবেষণা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও সেটি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়েছে খুব কম, যা উল্লেখ করার মতো নয়। গত দেড় দশকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নীতিনির্ধারণী কাজে যে কজন শিক্ষক দায়িত্বে ছিলেন, গবেষণার কাজে তাঁরা কতটুকু সময় ব্যয় করেন? এক্ষেত্রে গত দশ-পনেরো বছরে তাদের অবদানই বা কী? সেটা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।

 

০১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম এক দশকে যাঁরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তাঁরা প্রায় সকলেই গবেষণাজগতে কিংবদন্তী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রমেশচন্দ্র মজুমদার, হরিদাস ভট্টাচার্য ; এঁদের কাজগুলো দেখলেই আমার কথার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে গত দেড় দশক যেসব শিক্ষক নেতৃত্ব দিচ্ছেন আর যাই হোক গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁদের অধিকাংশের অবদান শূন্যের কোটায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বহুতল ভবন উঠেছে, বিশের অধিক বিভাগ খোলা হয়েছে, মসজিদ-মন্দির হয়েছে, এমন আরও বহু কিছু হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু আসল যে কাজ, সেটি হলো গবেষণামুখী শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে খুব কম। আর সব যেভাবেই চলুক গবেষণাটিই এখানে সবচেয়ে উপেক্ষিত। তাই অনেক কাজ জোর কদমে চললেও এবারেও অর্থাৎ ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষেও এমফিল/পিএইচডি পর্যায়ে একজন গবেষকও ভর্তি হয়নি, মানে সার্কুলারই দেওয়া হয়নি!

 

০২. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার সুন্দর পরিবেশে একটি বিশেষ শর্ত শিক্ষকদের সুন্দর সহাবস্থান। দুশো শিক্ষকের মধ্যে দল, উপদল, গ্রুপের বিভাজনের মাত্রা এতটাই যে, তা শিক্ষার জন্য মারাত্মক হুমকি। এই গ্রুপিংয়ের কারণে গত প্রায় চার বছর শিক্ষক সমিতির নির্বাচন পর্যন্ত আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এতে নেপথ্যের কলকাঠি কিন্তু সংশ্লিষ্ট সময়ের ভিসি ও তাঁর পার্ষদবর্গ থেকেই নাড়া হয়েছে!

 

০৩. গত দেড় দশকের আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হলো - ৯৯% শিক্ষককে লাইব্রেরি/ল্যাবরেটরিমুখী করা যায়নি। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসাদের সিংহভাগই এ স্রোতে গা ভাসাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে বিশ হাজারের বেশি বইয়ের সংগ্রহ আছে এবং আরও কয়েক গুণ সংগ্রহের কাজ চললেও ৯৯% শিক্ষক এক সেকেন্ডের জন্যও লাইব্রেরিতে বসেন না! গত দেড় দশকে আমি যেটা দেখেছি, তা হলো - শিক্ষকদের ভিড় ভিসির কক্ষের সামনে, সেখানে ঢুকতে সিরিয়াল দিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এক সময় সকাল ৯ টা থেকে রাত ২-৩টা পর্যন্ত এ দৃশ্য চোখে পড়তো। এই যে ভিড়, শিক্ষকরা সেখানে কি করেন? এক কথায় উত্তর ভিসির সুনজরে থাকার জন্য যা যা দরকার, সবই করেন। আর ভিসির সুনজরে থাকলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর কিছুর দরকার হয় না। এমনও দেখেছি ভিসির সুনজরে থাকা কিছু শিক্ষক মাসের পর মাস ক্যাম্পাসেই আসতেন না।

 

০৪. বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষাপদ্ধতিতে প্রচুর গলদ আছে, গলদের পরিমাণ এতটাই যে, এখান থেকে পাস করা অধিকাংশ গ্রাজুয়েট কর্মের বাজারে সেভাবে দাঁড়াতে পারছে না। বেশিরভাগ বিভাগে রয়েছে শিক্ষকস্বল্পতা। ফলে শিক্ষার্থীরা সার্টিফিকেট একটি পাচ্ছে বটে; তাতে তাদের দক্ষতা, জ্ঞানের গভীরতা এসব তেমন হচ্ছে না।

 

০৫. এখন যেটা করা দরকার, তা হলো -

ক. গবেষণাবিমুখ, মধুলোভী অধ্যাপকদের নীতিনির্ধারণী কাজ থেকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে তাঁদের লাইব্রেরি বা ল্যাবরেটরিমুখী করতে হবে। তা না করলে নতুন শিক্ষকরাও তাঁদের পথ অনুসরণ করবে। সেজন্যো শিক্ষকদের স্রোত ভিসির দপ্তর থেকে লাইব্রেরি/ল্যারেটরির দিকে ধাবিত করতে হবে।

খ. বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, ইউজিসি/মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে সবকিছু সিস্টেমেটিক করতে হবে, যাতে ভিসি যিনিই আসুন, সবকিছু চলবে সিস্টেমমাফিক।

গ. শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। সেইসঙ্গে উন্নতমানের লাইব্রেরি ও গবেষণাগার স্থাপন করতে হবে।

ঘ. চালু থাকা বিভাগগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ না করে আর কোনো নতুন বিভাগ চালু না করা।

ঙ. শিক্ষকদের দলাদলি/গ্রুপিং বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

চ. কথা ও সো অফ কম করে কাজ বেশি করতে হবে। যেমন- ২০১৫ সালে একবার ঢাকঢোল পিটিয়ে অটোমেশন কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়েছিলো, কিন্তু কিছুই অটোমেশন হয়নি; এবারও আরও বেশি ঢাকা পিটিয়ে অটোমেশন কার্যক্রম আবার উদ্বোধন হলো, এই উদ্বোধন উদ্বোধন খেলা বন্ধ করে কাজ দেখাতে হবে।

 

শেষ কথা: দেড় দশক বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়টি সত্যিকারের জ্ঞানমুখী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক, এটাই প্রত্যাশা।

 

লেখা: ড. এম. আব্দুল আলীম, সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, পাবিপ্রবি।

 

একুশে সংবাদ/এসএপি
 

ফিচার বিভাগের আরো খবর