সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

গরুর খামার গড়ে স্বাবলম্বী প্রতিবন্ধী ইকবাল

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৬:০৬ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

পরনির্ভরশীল না হয়ে প্রতিবন্ধী ইকবাল হোসেন নিজেকে স্বপ্ন দেখেন নিরন্তর পথচলার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যে সমাজের প্রতিটি উন্নয়ন কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন, তাকে না দেখলে বোঝায় যাবেনা। তাঁর জন্ম থেকে দুই পায়ের গোড়ালি বাঁকানো, স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। ভারী কোন কাজ করতে পারে না।

 

গরুর দুধ বেচে সংসার চালানোয় এলাকার মানুষের কাছে সে বেশ জনপ্রিয় দারিদ্রতাকে ঘোঁচাতে বিরামপুর উপজেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে ২০০৬ সালে নিয়েছিলেন ১০ হাজার টাকার ঋণ সেই ঋণে কিনেছিলেন দেশীয় জাতের একটি গরু। সেই গরু লালন পালন করে বাড়তে থাকে তার গোয়াল ঘরে আরও গরুর সংখ্যা। ৪ টি বাছুর বড় হলে সবমিলিয়ে বিক্রি করে এক মোটে ৮০ হাজার টাকা দাম পান। আর সেই গরু বিক্রি টাকা দিয়ে পাবনা জেলা থেকে ইকবাল হোসেন একটি জার্সি গুরু কিনে আনেন। এমনটি ঘটেছে দিনাজপুরের বিরামপুর পৌর শহর দোশরা পলাশবাড়ি মহল্লাতে। ইকবাল হোসেন পৌর শহরের দোশরা পলাশবাড়ী মহল্লার মৃত ইসাহাক আলীর ছেলে।

 

প্রতিবন্ধী হলেও ইকবাল হোসেন গরু পালন করে এলাকায় ব্যাপক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা সবার কাছে অনুকরণীয়।

 

জানা গেছে, উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে আরো ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ২০১৭ সালে দুটি এনজিও থেকে আরো ৮০ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে পাবনার সুজানগর থেকে একটি লাল বাছুরসহ একটি ফ্রিজিয়ান গাভী কিনেন ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকায়। তারপর থেকে আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রতিদিন দুধ দোহন করেন ২০০ লিটার। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি লিটার দুধ ৫০টাকা। তাঁর গরু পালনের মাধ্যমে সংসার চালানো দেখে এলাকায় অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়িতে খামার করতেছেন। সংসারের অসচ্ছলতা ও দারিদ্র্যের জন্য সৎ পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিজের চেষ্টা ও অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে আজও সংগ্রাম করেই পরিবার নিয়ে জীবন-যাপন করছেন ইকবাল হোসেন।

 

সময় বদলে যায় তার সাথে বদলে যেতে থাকে ইকবাল হোসেনের চিন্তা ভাবনা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাঁর গোয়াল ঘরে গরুর সংখ্যা। বর্তমানে ছোট বাছুর, গাভীসহ ফ্রিজিয়ান মোট ৯টি গরু তার গোয়াল ঘরে। দৈনিক সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ লিটার দুধ দোহন করেন এবং ডেইরীর্ফামে এবং স্থানীয় খোলা বাজারে লিটার প্রতি ৫০ টাকা দরে দুধ বিক্রি করেন।

 

এছাড়াও বাচ্চা ও বুড়ানি ছাগল মোট ১০টি ছাগল রয়েছে তার। এসব মিলিয়ে তাঁর বাড়িতে সেই ছোট্র গোয়ালঘরটা এখন রূপান্তর হয়েছে একটা বড় খামারে। ২৪ ঘণ্টা পরিচর্যা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের কারণে গরু, ছাগল গুলি বেশ হৃষ্টপুষ্ট। কারো কাছে দ্বারস্থ না হয়ে নিজের পরিশ্রমকে সম্বল করে সংসারের ভরণপোষণের জন্য জীবনযুদ্ধে প্রতিবন্ধী ইকবাল নিজের খামারে করেছে আত্মনিয়োগ।

 

ইকবাল হোসেনের বড় ভাই ১৯৯৬ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করেন। পরে বার্ধক্যজনিত কারনে ২০০০ সালে তারঁ পিতার মৃত্যু হয়। বজ্রপাতে তাঁর বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে দাখিল পর্যন্তই পড়ালেখার ইতি টেনে হাল ধরেন সংসারের। ছোটবেলায় নানা স্বপ্নও বুনতেন। রাতে ঘুমানোর আগে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার চিন্তায় ঘুম হতো না তার। এভাবেই চলে দীর্ঘদিন। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলতে থাকে তাঁর সংসার। বেঁচে থাকতে হলে স্বাবলম্বীতার বিকল্প নেই এই চিরন্তন সত্যকে বুকে ধারণ করে সদিচ্ছা, মেধা ও আত্মপ্রত্যয়কে পুঁজি করে তাঁর এই পথচলা। প্রতিবন্ধী ইকবাল হোসেনের উদ্যোগ ও একাগ্র চেষ্টার কারণেই গাভীর দুধ বেচার টাকায় ঘুরছে তাঁর সংসারের চাকা।

 

৪৮ বছর বয়সী এই ইকবালের সংসারে ৫ জন সদস্য ২ ছেলে এবং ১ মেয়ে। ছোট ছেলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি ও মেয়ে ৫র্থ শ্রেণিতে পড়ে। বড় ছেলের বয়স ১৭ বছর। প্রতিবন্ধী বাবার সাথে সর্বোক্ষণ গরু ছাগলের পরিচর্যা, বাজারে দুধ বিক্রি এবং সাংসারিক কাজে সহায়তায় করেন। একারণে পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত তাঁর বড় ছেলে।

 

ইকবাল হোসেন বলেন, বাবা মারা যাবার পর পারিবারিক ওসিয়তি ৫ বিঘা ফসলি জমি দিয়েই চলতো সংসার। ২ ভাতিজাদের পড়ালেখার খরচের দায়িত্ব নিয়ে তাদেরকেও শিক্ষিত করেছি। ২০১৭ সালে পারিবারিক কারণে ওসিয়তি ৫ বিঘা ফসলি জমি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। নিজের পরিশ্রমে কেনা মাথা গোঁজার অল্প পরিমাণের বসতভিটা ছাড়া আবাদি কোন নিজস্ব জমি নেই আমার।

 

তিনি আরো বলেন, পশুপালনের উপর বিরামপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে দুইবার প্রশিক্ষণ নিয়েছি। গরুর কোন রোগবালাই হলে বা যেকোন পরামর্শ উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কর্মকর্তাদের থেকে নিয়ে থাকি। মোটাতাজা করণের কোনো প্রকার ইঞ্জেকশন, রাসায়নিক সার ছাড়া সম্পূর্ণ দেশি খাবার দিয়েই গরুছাগল পালন করি। গরুর দুধ বেচে দৈনিক ১০ হাজার টাকা পাই, তা থেকে খাদ্য হিসেবে কাঁচা সবুজ ঘাস, খড়, খৈল, ভাত, ভূষি প্রভৃতি বাবদ দৈনিক প্রায় দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। খরচ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট  দিয়েই সন্তানদের লেখাপড়ার খরচসহ সংসারের ভরণ পোষণ চলে।

 

তিনি আরো বলেন, ২০২০ সালে এমপি শিবলী সাদিক মহোদয়ের বিশেষ বরাদ্দের প্রতিবন্ধী কার্ড পেয়েছি। কার্ড পেয়ে আমি খুশি, এমপি মহোদয়কে ধন্যবাদ ও তার জন্য দোয়া করি।

 

বিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রাজুল ইসলাম বলেন, আমরা গরীব ও দুস্থ প্রতিবন্ধীদের স্বাবলম্বী করতে খামার, দোকান বা বিভিন্ন কর্মমুখী উদ্যোগের জন্য উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ঋণ প্রদান করে থাকি যাতে তারা পর নির্ভরশীল বা ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় জড়িত না হয়।

 

একুশে সংবাদ/ন.হা/এসএপি/

কৃষি বিভাগের আরো খবর