সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বাহী ধান ভানা ঢেঁকি

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৪:২৪ পিএম, ৮ মে, ২০২৩

সেই চিরচেনা সুর আজও কানে বাজে ‘ও বউ ধান ভানেরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া ওবউ ধান ভানেরে” এ উক্তিটি প্রয়াত পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের।

 

চিরায়ত গ্রামবাংলার কৃষক পরিবারের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ঢেঁকি শিল্পকে নিয়ে রচিত। কিন্তু এই ঐতিহ্য এখন আর চোখে পড়েনা গ্রামঞ্চলে। সোনালী ফসলের এমন সময়ে আগেকার দিনে দেখা যেত গ্রামবাংলার বধূরা ঢেঁকি দিয়ে ধান ভানছেন। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় মানুষ যন্ত্রের মুহাবিষ্টতায় ধান ভানা, চাল, ডাল ও মসলার গুড়ো তৈরীতে ঢেঁকির পরিবর্তে বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্র ব্যবহারের কারণে এক সময়ের ধান ভানা,চাল,ডাল ও মসলার গুড়ো তৈরীর জন্য প্রধান মানুষ চালিত ছিল ঢেঁকি।

 

বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যর ধারক ঢেঁকি গৃহস্থের সচ্ছলতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রতিক হিসাবে প্রচলিত ছিল। আমাদের এ প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। এক সময় প্রত্যেক- গ্রামে প্রায় সব বাড়ীতেই ছিল ঢেঁকির প্রচলন ছিল। কিন্তু এখন এই ঢেঁকি প্রায় দুষ্কর হয়ে আছে। গ্রামের অভাবগ্রস্থ মহিলাদের উপার্জনের প্রধান জীবিকার মাধ্যম ছিল এই ঢেঁকি। গ্রামের বিত্তশালীদের বাড়ীতে যখন নতুন ধান উঠতো তখন অভাবগ্রস্থ মহিলারা ঢেঁকিতে ধান ছেঁটে চাউল বানিয়ে দিতো। তা থেকে তারা যা পেতো তা দিয়েই সংসার চলতো তাদের।

 

ঢেঁকিতে ধান ভানতে গিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের হাসি-তামাশার কথা বলতো আর মনের সুখ-দুঃখের গান গাইতো। অতীতে বিত্তশালী সহ প্রায় বাড়ীতে ঢেঁকি ঐতিহ্য বহন করতো। একসময় বর্তমান সময়ে ধান ভানা ধুম পড়তো প্রতি বাড়ীতেই। তাল, তেতুল ও অন্যান্য গাছের গড়ার  অংশ উপর লম্বা কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরী হত ঢেঁকি। ফাঁকা স্থানে বা ঘরের এক পাশে ছাউনি দিয়ে তৈরী করা হতো ঢেঁকি ঘর বা ঢেঁকি শিল্প।

 

সব মৌসুমে ধান ভাঙার জন্য ঢেঁকি ব্যবহার হতো। সন্ধ্যা হতে গভীর রাত পর্যন্ত চলতো মহিলাদের ঢেঁকিতে পাঁড়। সকালের ঘুম ভাঙতো ঢেঁকির ক্যাচ-কুচ, ডুক-ঢাক শব্দের আওয়াজ শুনে। ঢেঁকি দিয়ে ধান ভানতে সর্বনিম্ন দুই জন তবে চার জন মহিলা হলে চলতো। তারপর গভীর রাত অবধি চলতো পিঠা-পায়েস বানানো আর সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে খাওয়ার আমেজটা ছিল খুবই উপভোগ্য। এখন পিঠা বানানোর অন্যতম উপকরণ চালের গুড়া বানাতে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলায় বিভিন্ন গ্রাম এলাকায় ঢেঁকির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমাদের গ্রামাঞ্চল থেকে এখন ঢেঁকি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। কয়েক বছর আগেও গ্রাম-গঞ্জের বিত্তবানদের বাড়ীতে দেখা যেত ঢেঁকি।

 

স্থানীয় প্রবীন ব্যক্তি আব্দুর রহমান সহ অনেকেই জানান, এখন ঢেঁকির পরিবর্তে আধুনিক ধান ভাঙ্গার রাইস মিলে চাল ভানার কাজ চলছে। কোনো কোনো স্থানে ডিজেলের মেশিন ছাড়াও ভ্যান গাড়িতে ইঞ্জিন নিয়ে বাড়ী বাড়ী গিয়ে ধান ভানা ও মাড়াই করছে। যার কারনে গ্রামের অসহায় ও অভাবগ্রস্থ মহিলারা যারা ধান ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা বিকল্প পথ বেছে নেওয়া ছাড়া অনেকে ভিক্ষা করে দিন অতিবাহিত করছে। কেউবা কাজ করছে অন্যের বাড়ীর ধান শুকানো।

 

গৌরূপুরের স্হানীয় বাসিন্দা মো: আমিনুল ইসলাম (৭৫)এর সাথে আলাপ করে জানা যায়, ঢেঁকি আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির এক অপূর্ব নিদর্শন। যখন যন্ত্র চালিত ধান ভানা কল ছিল না তখন ঢেঁকির কদর বেশ ছিল। আর তখনকার সময়ের মানুষের জন্য এই ঢেঁকি আবিষ্কার ছিল যথেষ্ট। এখন এধরনের ঢেঁকি আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে হাস্যকর বা অজানা থেকে যেতে পারে। কারণ বর্তমানে ভিনদেশী চাকচিক্য সংস্কৃতি সমাজে প্রবেশ করে আমাদের পুরোনো নিজস্ব ঐতিহ্যকে পশ্চাতে ফেলে যেন জ্যামিতিক হারে এগিয়ে চলছে। ঠিক আমাদের পুরোনো সংস্কৃতি গাণিতিক হারের মত দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই এই দুর্বলতাকে পাশকাটিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে আমরাই লালন করতে হবে। তখন ইতিহাসের পাতায় পড়া ছাড়া বাস্তবে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। নতুবা কোনো যাদুঘরের কোণে ঠাঁই করে নিবে নিজের অস্তিত্ব টুকু নিয়ে। তখন হয়ত আমাদের নতুন প্রজন্ম এই ঐতিহ্য থেকে একবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সরকারী বা বেসরকারীভাবে আমাদের হারানো ঐতিহ্যগুলো নিয়ে বিশেষ মেলার আয়োজন করলে বর্তমান প্রজন্ম এই হারানো ঐতিহ্যগুলো চিনতে পারবে এবং রক্ষায় এগিয়ে আসবে।

 

একুশে সংবাদ/এসএপি
 

ফিচার বিভাগের আরো খবর