সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

নড়াইলের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য সেতার বাদক রবিশঙ্কর!

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০১:২৫ পিএম, ২২ জানুয়ারি, ২০২১

রবি শঙ্করের (ডাক নাম রবু)। আদি পৈত্রিক বাড়ি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার এখন (ডাক বাংলা) । ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারসে জন্মগ্রহণ করেন রবি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য শঙ্কর। রবিশঙ্কর ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তার বাবা শ্যাম শঙ্কর একজন প্রথিতযশা জ্ঞানী, রাজনীতিবিদ এবং আইনজ্ঞ ছিলেন।  রবির পুরো ছেলেবেলাই প্রায় বাবার অনুপস্থিতিতে কাটে। ফলে একরকম দরিদ্রতার মধ্যেই রবি শংকরের মা হেমাঙ্গিনী তাকে বড় করেন। বড় ভাই উদয় শঙ্কর ছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী।  ভারতীয় বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ সেতারবাদনে কিংবদন্তীতুল্য এবং বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত নাম রবী শঙ্কর। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাইহার ঘরানার স্রষ্টা আচার্য আলাউদ্দীন খান সাহেবের শিষ্য রবি শঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য এবং ভারতীয় সঙ্গীতকে পাশ্চাত্য বিশ্বের কাছে প্রথম তুলে ধরেন।  তার সাঙ্গীতিক কর্মজীবনের পরিব্যাপ্তি ছয় দশক জুড়ে। আর বিশ্ব সঙ্গীতে নিজের শ্রেষ্ঠ প্রমান করে ধীরে ধীরে তিনি গানের জগতে সত্যিকার পণ্ডিত হয়ে উঠেন। 

রবি শঙ্কর ১৯৩০ সালে মায়ের সঙ্গে প্যারিসে বড় ভাইয়ের কাছে যান এবং সেখানেই আট বছর স্কুলে শিক্ষা নেন। ১২ বছর বয়স থেকেই রবি শঙ্কর বড় ভাইয়ের নাচের দলের একক নৃত্যশিল্পী ও সেতার বাদক। ওই বয়স থেকেই তিনি অনুষ্ঠান করেছেন ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে।   সঙ্গীত জীবন ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে রবি শঙ্কর বড় ভাই উদয় শঙ্করের নাচের দল ছেড়ে মাইহারে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অমর শিল্পী আচার্য আলাউদ্দীন খান সাহেবের কাছে সেতারের দীক্ষা নিতে শুরু করেন। দীক্ষা গ্রহণকালে তিনি আচার্যের পুত্র অমর শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খানের সংস্পর্শে আসেন। রবি শঙ্কর ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর সেতারের ওপর দীক্ষা নেন।  উজ্জ্বল রায় নড়াইল জেলা প্রতিনিধি জানান, ১৯৩৯ সালে ভারতের আহমেদাবাদ শহরে এক উন্মুক্ত একক সেতার পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তার সাধনার শুরু হয়। সেই থেকে রবি শঙ্কর নিজেকে তুলে ধরেছেন একজন বৈশ্বিক সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীত স্রষ্টা, পারফর্মার এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একজন মেধাবী দূত হিসেবে। ১৯৪৫ সালের মধ্যে রবি শঙ্কর সেতার বাদক হিসেবে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একজন শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পান।   রবি শঙ্কর তার সাঙ্গীতিক সৃজনশীলতার অন্যান্য শাখায়ও পদচারণা শুরু করেন। তিনি সুর সৃষ্টি, ব্যালের জন্য সঙ্গীত রচনা এবং চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই সময়ের বিখ্যাত ধরত্রী কি লাল এবং নীচা নগর চলচ্চিত্র দুটির সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপ করেন। তিনি কবি ইকবালের সারে জাঁহাসে আচ্ছা কবিতাকে অমর সুরে সুরারোপিত করে ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীতের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।   ১৯৪৯ সালে রবি শঙ্কর দিল্লীতে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। একই সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বৈদ্য বৃন্দ চেম্বার অর্কেষ্ট্রা। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সঙ্গীত সৃষ্টিতে ব্যাপৃত ছিলেন। এ সময়ে তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হলো সত্যজিৎ রায়ের অপুত্রয়ী (পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার) চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা। পরবর্তীতে তিনি চাপাকোয়া (১৯৬৬) চার্লি (১৯৬৮) ও গান্ধীসহ (১৯৮২) আরও চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। ১৯৬২ সালে পন্ডিত রবি শঙ্কর কিন্নর স্কুল অব মিউজিক, বম্বে এবং ১৯৬৭ সালে কিন্নর স্কুল অব মিউজিক, লস এন্জেলেস স্থাপন করেন।   আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রবি শঙ্কর রবি শঙ্করের সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের দুটি ভিন্ন দিক রয়েছে- উচ্চাঙ্গ সেতার শিল্পী হিসেবে তিনি সব সময়ই ঐতিহ্যমুখী ও শুদ্ধতাবাদী। কিন্তু সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে তিনি সবসময়ই নিজের সীমাকে ছাড়িয়ে যেতেন। ১৯৬৬ সালে বিটলসের জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে যোগাযোগের আগে থেকেই তিনি সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা ও তার প্রভাব নিয়ে কাজ করেন। এ সময় তিনি জ্যাজ সঙ্গীত, পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছেন।  

১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাহক হিসেবে তার সেতারবাদনকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রথম তুলে ধরেন। এরপর ১৯৫৬ সালে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ সময় তিনি এডিনবার্গ ফেস্টিভাল এবং বিখ্যাত সঙ্গীত মঞ্চ রয়াল ফেস্টিভাল হলেও বাজিয়েছেন।   ১৯৬৫ সালে জর্জ হ্যারিসন সেতারের সুর নিয়ে গবেষণা শুরু করলে রবি শঙ্করের সঙ্গে তার যোগাযোগ তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে তা বন্ধুত্বে পরিণত হয়। এই বন্ধুত্ব রবি শংকরকে অতিদ্রুত আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিমণ্ডলে নিজস্ব অবস্থান সৃষ্টিতে সাহায্য করে।  

রবি শঙ্কর পপ সঙ্গীতের গুরু জর্জ হ্যারিসনের ‘মেন্টর’ হিসেবে পাশ্চাত্য সঙ্গীত জগতে গৃহীত হন। এর ফলে রবি শংকরকে এমন সব সঙ্গীত উৎসবে সঙ্গীত পরিবেশনের আমন্ত্রণ জানানো হয় যা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশনের উপযোগী পরিবেশ নয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘মন্টেরী পপ ফেস্টিভ্যাল’। এ অনুষ্ঠানে ওস্তাদ আল্লারাখা তবলায় সঙ্গীত করেছিলেন।   ১৯৬৭ সালে আমেরিকার অনুষ্ঠানমালা তাকে এক অভাবনীয় সফলতা এনে দেয়। অনুষ্ঠানের পর তাকে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এছাড়া ১৯৬৯ সালে তিনি উডস্টক ফেস্টিভ্যালে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।   ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে প্রচার ও মানবিক সহায়তার জন্য জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে সেতার বাজিয়েছিলেন। পন্ডিত রবিশঙ্করই মূলত এই অনুষ্ঠানের জন্য জর্জ হ্যারিসনকে উদ্বুদ্ধ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে  ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।   ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ হ্যারিসনের অনুষ্ঠানমালায় রবি শঙ্কর ও তার সঙ্গীরা উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন।  

পণ্ডিত রবি শঙ্করের অমর কীর্তি হচ্ছে পাশ্চাত্য ও প্রতীচ্যের সঙ্গীতের মিলন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বিখ্যাত বেহালাবাদক ইহুদী মেনুহিনের সঙ্গে সেতার-বেহালার কম্পোজিশন এক অমর সৃষ্টি যা তাকে আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের এক উচ্চ আসনে বসিয়েছে।   তিনি আরো একটি বিখ্যাত সঙ্গীত কম্পোজিশন করেছেন বিখ্যাত বাঁশিবাদক জ্যঁ পিয়েরে রামপাল, জাপানি বাঁশির সাকুহাচি গুরু হোসান ইয়ামামাটো এবং কোটো (ঐতিহ্যবাহী জাপানী তারযন্ত্র) গুরু মুসুমি মিয়াশিতার জন্য। ১৯৯০ সালে বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ফিলিপ গ্রাসের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনা প্যাসেজেস তার একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। পণ্ডিত রবিশঙ্কর ২০০৪ সালে ফিলিপ গ্রাসের ওরিয়ন প্রযোজনার জন্য সেতার অংশের সঙ্গীত রচনা করেন।   পারিবারিক জীবন একুশ বছর বয়েসে রবি শঙ্কর তার গুরু আচার্য আলাউদ্দীন খান সাহেবের মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবীকে বিয়ে করেন। পরে তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। এইঘরে তাদের পুত্রসন্তান শুভেন্দ্র শঙ্করের জন্ম হয়।   পরবর্তীতে আমেরিকান কনসার্ট উদ্যোক্তা স্যূ জোন্সের সঙ্গে রবি শঙ্কর সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তাদের সন্তান নোরা জোন্স একজন প্রথিতযশা জ্যাজ, পপ, আধ্যাত্মিক এবং পাশ্চাত্য লোক সঙ্গীতের শিল্পী ও সুরকার। নোরা জোন্স ২০০৩ ও ২০০৫ সালে দশটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।  

পরবর্তীতে রবি শংকর তার গুণগ্রাহী ও অনুরক্তা সুকন্যা কৈতানকে বিয়ে করেন। এই বিয়েতে তার দ্বিতীয় কন্যা অনুশকা শঙ্করের জন্ম হয়। বাবার কাছে শিক্ষা নিয়ে সেতার বাজিয়ে অনুশকা এখন নিজেও প্রতিষ্ঠিত।   পুরস্কার ও সম্মাননা ১৯৬২ সালে ভারতীয় শিল্পের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদক ভারতের রাষ্ট্রপতি পদক, ১৯৮১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সুশীল সমাজ পুরস্কার পদ্মভূষণ, ১৯৮৬ সালে ভারতের রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন, ১৯৯১ সালে ফুকোদা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজেস-এর গ্র্যান্ড প্রাইজ, ১৯৯৮ সালে সুইডেনের পোলার মিউজিক প্রাইজ (রে চার্লস্ এর সাথে) ১৯৯৯ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ভারতরত্ন, ২০০০ সালে ফরাসী সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান এওয়ার্ড লিজিয়ন অব অনার, ২০০১ সালে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক প্রদত্ত অনারারী নাইটহুড, ২০০২ সালে ভারতীয় চেম্বার অব কমার্সের লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডের উদ্বোধনী পুরস্কার, ২০০২ এ দুটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড, ২০০৩ সালে আই এস পি এ ডিস্টিংগুইশ্‌ড আর্টিস্ট এওয়ার্ড, লন্ডন, ২০০৬ সালে ফাউন্ডিং এম্বাসেডর ফর গ্লোবাল এমিটি এওয়ার্ড, স্যান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৪টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি, ম্যাগাসাসে অ্যাওয়ার্ড, ম্যানিলা, ফিলিপিন্স, গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর উপাধি- ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম, ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত পদ্মবিভূষণ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত দেশিকোত্তম   পণ্ডিত রবি শঙ্কর আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস্ অ্যান্ড লেটারসের অনারারি মেম্বর এবং ইউনাইটেড নেশনস্ ইন্টারন্যাশনাল রোস্ট্রাম অফ কম্পোজারসের সদস্য ছিলেন।

একুশে সংবাদ/উজ্জ্বল/অমৃ

বিনোদন বিভাগের আরো খবর