সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা না দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ‘কৌশল’

একুশে সংবাদ প্রকাশিত: ০৭:৪৫ পিএম, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এক দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো এই সুবিধা ফিরিয়ে আনতে পারেনি বাংলাদেশ। জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের শর্ত হিসেবে ১৬ দফা অ্যাকশন প্ল্যান দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেগুলো বাস্তবায়ন করার দাবি করে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের অনুরোধ করা হলেও তা বার বার প্রত্যাখ্যান করে আরও উন্নতি করার পরামর্শ দিয়ে এসেছে দেশটি। এরপর আবারো ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘ইউএস-বাংলাদেশ টিকফা ইন্টারসেশনাল মিটিং’ -এ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শ্রমিক অধিকার রক্ষায় ১১ দফা অ্যাকশন প্ল্যান তুলে ধরা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এই অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নে জিএসপি সুবিধা প্রাপ্তির পথ সুগম হবে। কিন্তু এর যৌক্তিকতা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন।

জিএসপি হলো এমন একটি সুবিধা যার আওতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে ৯৭ থেকে শতভাগ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধাকিার পায়। যেটা বাংলাদেশ রপ্তানি আয়ের বড় বাজার ইউরোপ থেকে পেয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।

বাংলাদেশকে শ্রম অধিকার, অগ্নি ও ভবন মানদণ্ড লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা বৃদ্ধি ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞাসহ কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সুইপিং ক্ষমতাপ্রাপ্ত পরিদর্শক নিয়োগ দিতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করা এবং ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে ঋণ পাওয়া সহজতর হবে।

গত ২১ এপ্রিল ঢাকায় বৈঠকের পর বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেয়া বাণিজ্য বিভাগের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, বাংলাদেশে শ্রম অধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমরা শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পেতে পারি। মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতা এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলের সহকারী ইউএসটিআর প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কথা উল্লেখ করে বাণিজ্য সচিব বলেন, আমরা ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের ফান্ডের সুবিধাও নিতে পারি।

যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অ্যাকশন প্ল্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে ইউনিয়ন সংগঠক, শ্রমিক ও আইনি প্রতিবাদ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও হয়রানির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের প্রতিরোধ ও জবাবদিহি করতে অর্থবহ পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রমিক এবং কর্মীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগগুলো বাদ দিতে বা সুরাহা করতেও বলেছে যুক্তরাষ্ট্র।

সরকারকে বাংলাদেশ শ্রম আইনের অধীনে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী কারখানা মালিক, ব্যবস্থাপনা ও ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে এবং এ ধরনের লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত করতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। অ্যাকশন প্ল্যানে আরও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলাদেশ শ্রম আইন (বিএলএ) সংশোধন করতে হবে।

ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টার সময় শ্রমিকদেরকে অফিশিয়াল সংখ্যায় জানার অনুমতি দিতে বলা হয়েছে অ্যাকশন প্ল্যানে। পাশাপাশি রেজিস্ট্রার রাখতে না পারা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অনুমোদন দেয়ার শর্তও দেয়া হয়েছে।

আরেকটি প্ল্যানে বলা হয়েছে, ধর্মঘটের অধিকারের ওপর ‘অতিরিক্ত’ বিধিনিষেধ দূর করার এবং অবৈধ ধর্মঘটের জন্য কঠোর শাস্তির আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে ইপিজেডগুলোকে বাংলাদেশ শ্রম অধিকার আইনের আওতায় আনার কথা বলেছে। ২০২৫ সালের জুন নাগাদ ইপিজেডে শ্রম আইন বাস্তবায়ন করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।

বেশকিছু বিষয় স্ববিরোধী বলে মনে করছেন গার্মেন্টস শিল্প সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শ্রমিকরা যখন সহিংসতা করে, তখন বেশিরভাগ সময়ই পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। মামলার তদন্তও পুলিশ করে। এক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে যদি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে বলে তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এটি হলে শ্রমিকদের অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হবে।

তিনি বলেন, সরকার কিংবা বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ —কেউই অন্যায্য শ্রমের চর্চা চায় না। কোনো মালিক বা ব্যবস্থাপক আনফেয়ার লেবার প্র্যাকটিস করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি আমরাও চাই। তবে এক্ষেত্রে আগে চিহ্নিত করতে হবে, কোনগুলো আনফেয়ার লেবার প্র্যাকটিস।

তিনি আরও বলেন, শ্রমিকরা আমাদের কারখানা ভাঙচুর করলে, অগ্নিসংযোগ করলে বা আমাদের মিড লেভেল ম্যানেজমেন্টকে মারধর করলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র যদি তার নিজের দেশে এ ধরনের বিধান করে, তাহলে আমরাও তা মেনে নিতে রাজি আছি।

ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২০ শতাংশ শ্রমিকের স্বাক্ষর নেয়া বাধ্যতামূলক করার বিধানটি শিথিল করার বিষয়ে মালিকপক্ষ ইতিমধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয়ে মতামত দিয়েছে বলে জানান হাতেম। শ্রমিকদের ধর্মঘট ডাকার ওপর বিদ্যমান বিধিনিষেধকে ‘এক্সেসিভ’ বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশই শ্রমিকদের অবৈধ ধর্মঘট অনুমোদন করে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিএমইএ’র একজন পরিচালক বলেন, গত দশকে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে বিশাল অগ্রগতি অর্জন করেছে। সবুজ কারখানার পাশাপাশি আমরা প্রযুক্তিতেও প্রচুর বিনিয়োগ করেছি, যা শ্রম বিষয়ে সর্বোত্তম চর্চার প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতির পরিচায়ক। তা সত্ত্বেও যখন জিএসপি বা শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার বিষয়গুলো সামনে আসে, তখন বারবার ট্রেড ইউনিয়নের ইস্যুটি আনার এবং একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বিজিএমইএ’র ওই পরিচালক বলেন, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের এসব কঠোর বিধিনিষেধ সত্ত্বেও আমরা কার্যাদেশ বাড়িয়েছি। উত্থাপিত অভিযোগগুলো যদি সত্য হতো, তাহলে আমাদের শিল্পের প্রতি এরকম আস্থা তৈরি হতো না।

তার মতে, অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নগুলো রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এতে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে ইউনিয়নগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। এসবের বদলে আমরা কর্মীদেরকে তাদের অধিকার সম্পর্কে জানানোর এবং সম্মিলিত আলোচনায় আরও কার্যকর প্রতিনিধি হওয়ার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেয়া কর্মসূচিকে সমর্থন করি।

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র একটা টালবাহানা করছে। আমরা একটা করলে তারা আরেকটা দাবি করবে। যতক্ষণ তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারবো না, ততক্ষণ তারা আমাদের এগুলো করতে থাকবে। পরাশক্তির অনেকগুলো হাত। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতার লোভী না।

তিনি বলেন, আমেরিকা বড় শক্তি। তাদের অবশ্যই পরোয়া করতে হয়। তাই বলে আমাদের স্বকীয়তা বিলিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে আপস করতে রাজি না। যুক্তরাষ্ট্র যে সুপারিশ দিয়েছে, সেটা আমরা নেবো। তবে যাচাই-বাছাই করে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, জিএসপি সুবিধা থাকলে আমদানির শুল্ক দেয়ার প্রয়োজন হয় না। ফলে অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোর সাপেক্ষে বাংলাদেশের পণ্যগুলো প্রতিযোগিতা করার সুযোগ পায়। সেটা মাথায় রেখে আমদানিকারকরাও বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে উৎসাহিত হন। ফলে এটি পুনর্বহাল হলে অন্তত ওই খাতগুলোর পণ্যে একটা প্রভাব দেখা যেতো। তবে জিএসপি শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং এটি প্রত্যাহারের একটা রাজনৈতিক ইমেজগত বিষয় রয়েছে।


একুশে সংবাদ/এ.ট.প্র/জাহা

 

অর্থ-বাণিজ্য বিভাগের আরো খবর