ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত ‘দার্জিলিং’ কে বলা হয শৈল শহরের রানী । অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। দার্জিলিং ছিল প্রাচীন গোর্খা রাজধানী। পরে সিকিমের মহারাজা ব্রিটিশদেরকে এই অঞ্চলটি উপহার দিয়েছিলেন। একসময় দার্জিলিং ব্রিটিশদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই ব্রিটিশ শাসনআমল থেকেই পৃথিবীর সবত্র দার্জিলিং এর সৌন্দর্যের সুনাম ছড়িয়ে যায়। আজও দার্জিলিং তার অনাবিল সৌন্দর্য এবং মনোরম জলবায়ুর কারণে ভারতের একটি জনপ্রিয় ছুটির গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
দার্জিলিং ভূ-পৃষ্ট থেকে ৭ হাজার ১০০ ফুট উচ্চতার এক জনপদ। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই শহরে প্রায় পুরো বছর জুড়েই ঠাণ্ডা থাকে। মেঘের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দার্জিলিং তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, চা এবং রেলওয়ের জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। দার্জিলিংয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য ও টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখার সাথে সাথে অসংখ্য দর্শনীয় স্থানের জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক এই শহরে ভিড় জমায়। সাধারণত তিনদিন অবস্থান করলেই দার্জিলিং মোটামুটি ঘুরে দেখতে পারবেন। তবে এই মায়াবী শহরের মোহময়ী স্বাদ পেতে চাইলে এখানে থাকতে হবে কমপক্ষে একসপ্তাহ।
কোনো এক মেঘমুক্ত ভোরে পৌঁছে গেলেন টাইগার হিলে। সন্ধ্যায় সোনালী আলোতে মাখা কাঙ্চনজঙ্ঘা দেখতে পারেন। টয় ট্রেনে চড়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন পাহাড়ী রাস্তা ধরে। কোনো চা বাগান বা মোনাস্ট্রি ঘুরেও কাটিয়ে দিতে পারেন সারাটাদিন। কোনো এক অলস বিকালে ব্যালকনিতে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে উপভোগ করতে পারেন পাহাড়ের কোলে অস্তমিত সূর্যের রূপ।
দার্জিলিং এর দর্শনীয় স্থানসমূহঃ
ছোট বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য অনেকগুলো আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে দার্জিলিং জুড়ে।
· পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশন ‘ঘুম’।
· সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয় দেখা।
· পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা স্থান- ঘুম মোনাস্ট্রি।
· দার্জিলিং চিড়িয়াখানা।
· সর্বপ্রথম এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-রক- এর স্মৃতিস্তম্ভ।
· কেবল কারে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ভ্রমণ।
· হ্যাপি ভ্যালি টি গার্ডেনে বসে তাৎক্ষণিকভাবে পৃথিবীখ্যাত ব্ল্যাক টি পানের সুযোগ।
· যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থী কেন্দ্র তিব্বতিয়ান সেলফ হেলপ্ সেন্টার।
· সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় আট হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত দার্জিলিং গোরখা স্টেডিয়াম।
· নেপালি জাতির স্বাক্ষর বহনকারী দার্জিলিং মিউজিয়াম।
· পৃথিবীর বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার জাপানিজ টেম্পল।
· ব্রিটিশ আমলের সরকারি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র কাউন্সিল হাউস ‘লাল কুঠির’
· অসাধারণ শৈল্পিক নিদর্শন খ্যাত ‘আভা আর্ট গ্যালারি’।
· শতবর্ষের প্রাচীন মন্দির ‘দিরদাহাম টেম্পল’।
· পাথর কেটে তৈরি ‘রক গার্ডেন’ এবং গঙ্গামায়া পার্ক।
· মহান সৃষ্টিকর্তার বিশাল উপহার হিমালয় কন্যা কাঞ্চনজংঘা।
· বিশুদ্ধ পানির অবিরাম বয়ে যাওয়া ভিক্টোরিয়া ফলস।
· মেঘের দেশে বসবাসরত এক সুসভ্য জাতির সংস্কৃতি।
খরচঃ
দার্জিলিং ভ্রমণে মোটামুটি বাজেটের কথা চিন্তা করলে ঢাকা থেকে দার্জিলিংয়ে যাতায়াত, থাকা, খাওয়া বাবদ ৪ দিন থাকতে জনপ্রতি ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। আর কম খরচে ঘুরতে চাইলে কয়েকজন মিলে গ্রুপ করে গেলে এবং শেয়ার জীপে যাতায়াত, হোটেলে শেয়ার করে থাকা ও খাওয়া দাওয়া এই সবকিছুতে মিলেমিশে করলে জনপ্রতি ১০-১২ হাজার টাকার মধ্যেও সুন্দর করে ঘুরে আসা সম্ভব।
থাকাঃ
দার্জিলিং-এ বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল ও হোমস্টে রয়েছে। বাজেট হোটেলের মধ্যে হোটেল টাওয়ার ভিউ, দেজং রেট্রেট, এভারেস্ট গ্লোরি, কি কিবা ধী, হোটেল ইভি ক্যাসেল, হোটেল এভারেস্ট গ্লোরি, পাহাড়ি সোল, বেনু’স এর মতো হোটেল গুলোতে ৬০০-৮০০ এর মধ্যে দুই জনের জন্য থাকার রুম পেয়ে যাবেন।
আবার একটু বেশি বাজেটের মধ্যে হলেও পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয় নিউ সিঙ্গালিয়া পার্ক হোমস্টে, হিমশিখা হোমস্টে, ফ্রাতেরনিতি হোমস্টে, মাউন্টেইন হোমস্টের মতো হোমস্টে গুলোতে ৯০০-২০০০ টাকার মধ্যে দুইজন থাকতে পারবেন।
অনালাইনে রুম বুকিং এর ক্ষেত্রে booking.com, hotels.com, expedia এর মতো সাইটগুলো চেক করে দেখতে পারেন। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী অনেক হোটেল পেয়ে যাবেন।
কেনাকাটাঃ
দার্জিলিং থেকে শীতের ভালো জামা কাপড় কেনা যাবে। শীতের শহর দার্জিলিং (মল রোড) কম দামেই শীতের পোশাক কিনতে পাবেন। তাছাড়া দার্জিলিং এর চায়ের প্যাকেট কিনতে পারেন। অন্য সব কেনাকাটা শিলিগুড়িতে করতে পারেন।
খাওয়াঃ
দার্জিলিং খাওয়ার জন্য সিমলা রেস্টুরেন্টের খাবার খুবই ভালো। এ ছাড়াও মুসলিম হোটেলে খাওয়ার জন্য বড় মসজিদের সামনে যেতে পারেন।
যেভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে বাসেঃ সড়ক পথে যেতে চাইলে আপনার ফুলবাড়ি দিয়ে ভিসা করা থাকলে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা সীমান্তে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে ফুলবাড়ি থেকে বাসে শিলিগুড়ি জংশন যেতে হবে। চেংড়াবান্ধা দিয়ে ভিসা করা থাকলে ঢাকা থেকে লালমনিরহাটের বুড়িমারি সী্মান্তে ইমিগ্রেশনের প্রক্রিয়া শেষ চ্যাংড়াবান্দা থেকে বাসে শিলিগুড়ি চলে আসুন। যেভাবেই যান তারপর শিলিগুড়ি জিপ স্টেশন থেকে দার্জিলিংগামী টাটা সুমো বা কমান্ডার জিপের টিকিট কেটে সরাসরি দার্জিলিং চলে আসতে পারবেন। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলং যেতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে।
ঢাকা থেকে বিমানেঃ
ঢাকা থেকে বিমানে যেতে চাইলে ঢাকা – কলকাতা – বাগডোগরা ফ্লাইটে যেতে হবে। বাগডোগরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে সেখান থেকে ট্যাক্সিতে দার্জিলিং যেতে পারবেন।
কলকাতা থেকে দার্জিলিংঃ
কলকাতা থেকে ট্রেনে দার্জিলিং যেতে চাইলে ট্যুরিস্টদের জন্য নির্ধারিত কাউন্টার ফেয়ারলি প্যালেস থেকে টিকেট সংগ্রহ করুন। দার্জিলিং-এ যাওয়ার সবচেয়ে কাছের রেলওয়ে স্টেশন হচ্ছে নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশন। এই রেলস্টেশন থেকে দার্জিলিং-এর দূরত্ব ৮৮ কিলোমিটার। কলকাতার শিয়ালদহ রেল স্টেশন থেকে সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটের দার্জিলিং মেইল ট্রেন ছেড়ে যায়। পরদিন সকাল ১০টায় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেন পৌঁছাবে। জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে রিকশায় শিলিগুড়ি জিপ স্টেশন এসে দার্জিলিংগামী টাটা সুমো বা কমান্ডার জিপে দার্জিলিং পৌঁছাতে পারবেন।
পরামর্শঃ
· আপনার পাসপোর্ট ও ভিসার সকল প্রকার কাজ শেষ হলে এই পাসপোর্ট এবং ভিসার ৫-৬ টি সেট ফটোকপি করে সঙ্গে রাখবেন। এই ফটোকপিগুলো ইমিগ্রেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় লাগতে পারে।
· দার্জিলিং শহরে উন্মুক্ত ধুমপান করা দন্ডনীয় অপরাধ তাই ধুমপান থেকে বিরত থাকুন।
· বর্ষাকালে দার্জিলিং ভ্রমণ না করাই ভালো।
· বাংলা টাকা চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডারে রুপীতে পরিবর্তন করে নিন। কেননা দার্জিলিং এ রেট খুবই কম পাওয়া যায়।
একুশে সংবাদ.কম/জ/বাইজীদ_সা’দ
আপনার মতামত লিখুন :