গত বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায়। ফার্মগেট গোল চত্বেরে মিরপুর রোডের একটি পরিবহন যানজটে আটকে যায়। হঠাৎ করে জানালা দিয়ে মকবুল হোসেনের মোবাইল প্রকাশ্যেই ছিনতাই করে শটকে পড়ে ছিনতাইকারী। দুইদিন পর শনিবার দুপুরে রাজধানীর কামরাঙ্গীচরের লোহারব্রিজের পাশে চোরাই মার্কেটে পাওয়া গেলো সেই মোবাইল। কিন্তু বিক্রেতা কোনো প্রকার সঠিক তথ্য দিতে না পেরে লাপাত্তা হয়ে যায়। শুধু মকবুল নয়।
রাজধানীতে এ ধরনের অভিযোগ অনেরেই। রাজধানীর আবদুল্লাহপুরে ২৩ জানুয়ারি রাতে চলন্ত একটি গাড়ি থেকে এক যাত্রীর মোবাইল টান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জনতার হাতে ধরা পড়ে ছিনতাইকারী। যদিও ভুক্তভোগীর বাস ততক্ষণে আবদুল্লাহপুর ছেড়ে বহুদূরে। প্রতিনিয়তই এ রাস্তায় মোবাইল কিংবা মূল্যবান সম্পদ খোয়াচ্ছেন যাত্রীরা।
খোয়া যাওয়া মালামালের গন্তব্য কোথায়, সে প্রশ্নই ছিল আটক হওয়া ছিনতাইকারী মনির হোসেনের কাছে। ছিনতাইকারী বলেন, অন্যজন করেছে এটা, আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে চলে গেছে। আমি একটি মোবাইল ছিনতাই করলে ২’শ টাকা পাই।
অলিগলিতে ছিনতাই নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু প্রকাশ্য রাজপথে ভিড়ের মধ্যে এই ঘটনাটি একদিকে যেমন যাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি প্রকাশ পায়, অন্যদিকে পুলিশের আচরণে প্রশ্ন জাগে, তারা মানুষের নিরাপত্তা বিধানে আসলে কতটা আন্তরিক। ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পাশে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু নিশ্চুপ পুলিশ।
পুলিশ ও প্রত্যাক্ষদর্শী সূত্র বলছে, রাজধানীতে প্রকাশ্যে মোবাইল ছিনতাই চক্রের বেশির ভাগই বিভিন্ন ধরনের নেশায় আসক্ত তরুণ। নেশার টাকা জোগাড় করতে প্রকাশেই তারা হয়ে উঠছে ছিনতাইকারী। এসব ছিনতাইয়ের মালও বিক্রি হয় নেশার আখড়ায়। সেখান থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে চোরাই পণ্য।
প্রকাশ্যে কারা ছিনতাই করছে, আর মালামালগুলোই-বা কোথায় যাচ্ছে? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সাক্ষাৎ মেলে আব্দুল রহিম নামে এক ছিনতাইকারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ১০ হাজার টাকা মূল্যের মোবাইল ছিনতাই করে ২ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেই। যত দামি ফোন হউক ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যেই বিক্রি করি। আর সে টাকা নেশা করে খরচ করে শেষ করে দেই। ধরা পড়লে মাফ চাই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নেশার আখড়া থেকে হাতঘুরে চোরাই মোবাইলগুলো চলে যায় রাজধানীর প্রতিষ্ঠিত কিছু চোরাই মার্কেটে। মিরপুর ১১ নম্বরের বাউনিয়াবাঁধ এলাকায় নিশ্চিন্তে ব্যবসা চলছে চোরাই মোবাইলের। কাছে যেতেই কিছু চোরাকারবারি শটকে পড়লেও বাকিরা নিজেদের সৎ দাবি করেন।
এক মাছবিক্রেতা এনায়েত হাওলাদারের অভিজ্ঞতায় সব স্পষ্ট হয়। গত ৫ জানুয়ারী ফেজবুকে বিজ্ঞাপন দেখে একটি ফোন কিনে থানা পর্যন্ত যেতে হয়েছে তাকে। তিনি বলেন, পুলিশ আমাকে ফোন দিয়ে বলে মোবাইল কি দেবে নাকি জেলে যাবে? আমি বলছি, ফোনটা তো আমি কিনেছি। আমি তো চুরি করিনি। একপর্যায়ে পুলিশের কাছে মোবাইলটা দিয়ে দিয়েছি। পুলিশ জানায়, বাউনিয়াবাঁধ চোরাই মার্কেটের বেশির ভাগ দোকানির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
ডিএমপির পল্লবী জোনের সহকারী কমিশনার আবদুল হালিম বলেন, এদের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, আমাদের ব্যাক টু ব্যাক অভিযানেও কোনোভাবেই কিন্তু এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অসংখ্য মামলা আছে তাদের বিরুদ্ধে।
রাতের আধারে ঘটে ছিনতাই: টানা এক মাসে ৩ বার ছিনতাইকারীর ছোবলে পড়েন সোহেল হোসেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সদরঘাট হওয়ায় প্রতিদিন খিলক্ষেতের বাসায় আশা-যাওয়া করতে হয় লোকাল বাসে। তিনি বলেন, আমার যতবার মোবাইল ছিনতাই হয় সবই বাসের জানালা দিয়ে। গুলিস্তান কিংবা পল্টন সিগন্যালে বাস আটকে গেলে। ছিনতাইকারীরা টার্গেট করে মোবাইল জানালা দিয়ে নিতে আসেন। আর তার সঙ্গে থাকে আরো দুই তিনজন সহযোগী। যাত্রীরা চিৎকার করলেই ছুরি দিয়ে পোঁচ মারে।
তিনি বলেন, পুলিশের গাড়ি ছিনতাইকারীদের দেখে লাঠি দেখিয়ে বাঁশি বাজায়। বাসের সব যাত্রী পুলিশের গাড়ি দেখে চেঁচিয়ে বলে ভাই ধরেন... ধরেন... এরা ছিনতাইকারী। কিন্তু পুলিশের গাড়ি চলে যায়।
একবার ছিনতাইয়ের কবলে পরেন আইনজীবী মো. মহাসিন। তিনি বলেন, ‘আমি কোর্টের কাজ শেষে বাসে করে ফিরছিলাম। পল্টন সিগন্যালে ছিনতাইকারীরা জানালা দিয়ে আমার ফোন টান দেয়। নিতে না পেরে আমাকে ছুরি দিয়ে পোঁচ মেরে দেয়। ট্রাফিক পুলিশকে বললেও কিছু বলেনি। ছিনতাইকারী শটকে পরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান বলেন, পুলিশের আচরণে পরিবর্তন আনা জরুরী।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, একেক পুলিশের একেক ধরনের ডিউটি। নগরবাসীর সেবা করাই পুলিশের কাজ। ছিনতাইকারী ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।
একুশে সংবাদ.কম/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :