সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

টিউলিপ সিদ্দিক: বহির্বিশ্বে বাঙালি তারুণ্যের অহংকার

প্রকাশিত: ০৮:০৮ পিএম, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২০
খায়রুল আলম : একজন নারী এমপি বাচ্চা জন্মদানের ঠিক দু’দিন আগে সংসদে এসেছেন হুইল চেয়ারে করে। ধৈর্য নিয়ে পার্লামেন্টের আলোচনা শুনছেন এবং অংশ নিচ্ছেন। নিজের সিজার অপারেশনের তারিখ পিছিয়ে দিয়েছেন শুধু ব্রেক্সিট ইস্যুতে ভোট দেবেন বলে। আর এটি নিয়েই ব্রিটেনজুড়ে আলোচনার ঝড় উঠল। মানুষের জন্য রাজনীতি। রাজনীতির জন্য মানুষ নয়। পার্লামেন্টের নিয়ম দিয়ে একজন দেশ সেবকই শুধু নয়, একজন মা ও শিশুর ভবিষ্যৎ বিপন্ন করা চলে না। তবে ব্রেক্সিটের মতো বিষয়কেওতো গুরুত্ব না দিলে চলে না। তাই ওই সংসদ সদস্যের ঘটনা জন্ম দিল প্রক্সি ভোট দেওয়ার মতো নতুন নিয়ম। এখন ব্রিটেনের সংসদ সদস্যরা অসুস্থ হলে তার শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে ভোট দেবার দরকার নেই, তার বদলে নির্ধারিত আরেকজন সেই ভোট দিয়ে দিতে পারবেন। ব্রিটেনের এই আলোচিত সংসদ সদস্য হচ্ছেন টিউলিপ সিদ্দিক। ব্রিটেনের মর্যাদাপূর্ণ ও জনপ্রিয় পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান তাকে অভিহিত করেছে ভবিষ্যতের অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের একজন `One to Watch’। আর সানডে টাইমস বলেছে, লেবার পার্টির উদীয়মান তারকা’। ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার ম্যাগাজিনের সেরা ১০০ প্রভাবশালী ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যান্ড ইন্সপায়ারেশনের তালিকায় এসেছে তার নাম। এ ছাড়া ইংল্যান্ডের শীর্ষ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের তালিকায়ও আছেন টিউলিপ। ২০১৫ সালে ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি বিবিসির সেরা ১০০ ভাষণের একটি বিবেচিত হয়েছে। টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক ১৯৮২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর লন্ডনের সেন্ট হেলিয়ার হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটেনের লেবার পার্টি এমপি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি, বিশ্বশান্তির অগ্রদূত, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ভগ্নিকন্যা ও শেখ রেহানার বড় কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকের জন্মদিন আজ। টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার পার্টি এবং কো-অপারেটিপ পার্টির রাজনীতিবিদ। তিনি ২০১৫ সাধারণ নির্বাচনে লন্ডনের হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। এর পূর্বে তিনি রিজেন্ট পার্কের কাউন্সিলর এবং ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলের কালচার অ্যান্ড কমিউনিটির সদস্য ছিলেন। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন নামের গুরুত্বপূর্ণ আসনে তিনবার সংসদ সদস্য হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন পরপর লেবার পার্টি থেকে। গত নির্বাচনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় উপবিষ্ট হতে পারেনি যদিও, তবে টিউলিপ লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রী সভার শিক্ষা ক্যাবিনেটের উপমন্ত্রী হয়েছেন। এর মানে টিউলিপ সিদ্দিকী লেবার পার্টির একজন প্রভাবশালী সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব নিঃসন্দেহে। তিনি এখন ব্রিটেনের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর। প্রতি বছর লন্ডনের ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড ব্রিটেনের বিভিন্ন সেক্টরের প্রভাবশালীদের নিয়ে ১ হাজার জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকায় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের ক্যাটাগরিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের মতো ব্যক্তিদের পাশে স্থান পেয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিকী। এছাড়াও তিনি নারী ও সমতাবিষয়ক যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টারি সিলেক্ট কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। টিউলিপের স্বামী ক্রিস পার্সি একজন ব্রিটিশ। ২০১৩ সালে রিজেন্ট পার্ক এলাকার কাউন্সিলর থাকার সময় যুক্তরাজ্যের এই নাগরিককে বিয়ে করেন টিউলিপ। তার শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ব্রুনাই, ভারত, সিঙ্গাপুর ও স্পেনে। ১৯৯৮ সালে ১৫ বছর বয়সে তিনি উত্তর লন্ডনে আসেন এবং এ লেভেল করেন। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডন থেকে ইংরেজি সাহিত্যে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি ও লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে রাজনীতি, নীতি ও সরকারবিষয়ে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। শৈশবেই দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন মেন্ডেলার সঙ্গে সাক্ষাৎলাভের ও যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে অতিথি হওয়ার সুযোগ হয়েছে তার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি লেবার পার্টিতে যোগ দেন। তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, গ্রেটার লন্ডন অথরিটি, ফিলিপ গোল্ড অ্যাসোসিয়েট, সেভ দ্য চিলড্রেন ছাড়াও ব্রিটিশ এমপি ওনা কিং, সাদিক খান ও হ্যারি কোহেনের সঙ্গে কাজ করেছেন। টিউলিপ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। ২০০৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামার পক্ষে প্রচারণা চালান। ২০১০ সালের মে মাসে টিউলিপ সিদ্দিক ক্যামডেন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রথম বাঙালি নারী প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তিনি প্রায়ই নানা কারণে আলোচনায় আসেন। তার আলোচনায় আসার কারণগুলো খুবই যৌক্তিক ও অভূতপূর্ব। ব্রিটেনে কয়েক বছর আগেও সংসদে মাতৃত্বকালীন ছুটি কম ছিল। নারী সংসদ সদস্যদের শিশু জন্মদানের ৬ সপ্তাহ পরেই কাজে যোগ দিতে হত। সরকারি/বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা মাতৃত্ব কালীন ছুটি বেশি পায় ব্রিটেনের এমপি বা সংসদ সদস্যদের চেয়ে। টিউলিপের প্রথম সন্তান জন্মের পরপরই কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়ার ফলে শারীরিক সমস্যায় পড়েছিলেন তিনি। ২য় সন্তান জন্মের সময় অবশ্য আইন পরিবর্তনের ফলে কিছুটা ছুটি পেয়েছেন। তবে তিনি সব সময় কাজের কথা মাথায় রেখেছেন। সংসদ সদস্যদের নিয়ে গড়া হোয়াটস অ্যাপের গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ চালিয়ে নিচ্ছিলেন। রক্তে রাজনীতি হলেও কোনো পারিবারিক সুবিধা নেননি টিউলিপ সিদ্দিকের গল্পটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের উপমহাদেশীয় রাজনীতির যে পারিবার কেন্দ্রিক নেতৃত্বের ধারাবাহিক সংস্কৃতি, তা তাকে স্পর্শ করেনি। কথাটা হয়তো অবিশ্বাস্য। কিন্তু এটাই সত্যি। তার পারিবারিক ইতিহাস তার রাজনৈতিক পরিচয় তৈরিতে আমাদের দেশে যেভাবে সাধারণত নেতাকর্মীদের সহায়তা করে, সেভাবে টিউলিপকে করেনি। তিনি চাইলেই পারিবারিক সূত্রে বাংলাদেশে এসে খুব সহজেই রাজনীতি করতে পারতেন। কিন্তু বাংলাদেশকে ভালোবাসলেও এদেশের রাজনীতিতে অভিষিক্ত হননি। জন্মেছেন লন্ডনে, তাই ইংল্যান্ডকেই বেছে নিলেন কর্মে, মর্মে। রক্তে তার রাজনীতি। প্রেরণা পেয়েছেন মা শেখ রেহানা, খালা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নানা বঙ্গবন্ধু’র অসাধারণ গল্প ও রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে। কিন্তু এর বাইরে আক্ষরিক অর্থেই ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক আর্থ সামাজিক আবহে বেড়ে উঠে ব্রিটেনের রাজনীতির জটিল ও বিশাল মঞ্চে কৃতিত্বের সাথে একের পর এক সাফল্য অর্জন করে যাচ্ছেন শুধু নিজের সততা, কর্মতৎপরতা ও যোগ্যতা দিয়ে। লেবার পার্টি নয় ব্রিটেনের উদীয়মান নেতৃত্ব টিউলিপ সিদ্দিক টিউলিপ মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টিতে যোগ দেন। রাজনীতিতে যোগ দেবার পেছনে তার বাবার অসুস্থতা একটি বড় কারণ ছিল। স্কুলে পড়াকালীন বাবা শফিক সিদ্দিক স্ট্রোক করেন এবং বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার চিকিৎসা জন্য ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। এই সেবা নিতে গিয়ে রাজনীতি সচেতন টিউলিপ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সবসময়ে জনসেবা ও পার্টির সাথে কার্যকরভাবে যুক্ত থাকায় লেবার পার্টি ২০১৫ সালে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে। এই আসনটি লন্ডনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন, রীতিমত একে ক্ষমতার ভাগ্য নির্ধারণী আসন বলা হয়। প্রতিবছর হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজনৈতিক লড়াই হয় এ আসনটিতে। টিউলিপ প্রথমবারেই জয়ী হন এবং তারপর ২০১৭ এবং সর্বশেষ ২০১৯ এর ডিসেম্বরে এই তৃতীয়বারের মত জিতে হ্যাটট্রিক করলেন। তার কাজ ও কথায় জনগণ সন্তুষ্ট। বিশেষত নিজ দল ক্ষমতায় না থাকলেও কোন আসন থেকে বিজয়ী হওয়া ধারাবাহিকভাবে, এক অসাধারণ রাজনৈতিক সাফল্য। সিরিয়ান শরণার্থীদের বিষয়ে এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বন্ধের পক্ষে তিনি ডেভিড ক্যামেরনকে চিঠি লিখেছিলেন। এছাড়া ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন বন্ধে ও নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধের পক্ষেও তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন লেবার পার্টির পক্ষ হয়ে। তাছাড়া তিনি নারী-পুরুষের সমান বেতন এর জন্যও আন্দোলন করেছেন। ব্রেক্সিটের বিপক্ষে থাকায় হুমকিও পেয়েছেন, যদিও তিনি কোন হুমকিতে ভয় পান না। ব্যক্তি জীবনে টিউলিপ সিদ্দিক টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের রাজনীতিতে আরও পথ পাড়ি দেবেন সফলভাবে তা একরকম নিশ্চিত। তবে তার পারিবারিক যোগসূত্র বাংলাদেশের সঙ্গে গভীর। একজন মা হওয়া এবং একই সঙ্গে একজন রাজনীতিবিদ হওয়া সহজ নয় বলে জানিয়েছেন টিউলিপ। সব সময় মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। শিশুদের বেশিরভাগ সময় যত্ন নেন তার স্বামী ক্রিস, পুরো নাম ক্রিস্টিয়ান উইলিয়াম সেন্ট জন পার্সি। তাই, কর্মজীবী মায়েদেরকে পারিবার থেকে সহায়তা ও অনুপ্রেরণা দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। টিউলিপ সিদ্দিক এর এই ‘মনে করা’ খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, হয়তো তার এই ভাবনাই সর্বত্র সবার মাঝে ছড়িয়ে যাবে, একদিন সমাজকে পরিবর্তন করবে, মানবিক করবে। নিজ দক্ষতা, যোগ্যতাবলে অবস্থান গড়ে তোলার পথেই হাঁটছেন তিনি। তাকে জানান দিতে হবে ‘স্বপ্ন-সম্ভাবনা-সমাধান-সাফল্যের’ কথা। টিউলিপকে ঘিরে সাফল্যের আশা আছে। এই অল্পবয়সে বিদেশের রাজনীতিতে যে তারুণ্যদীপ্ত ‘ভাইব্রেশন’ জাগাতে সমর্থ হয়েছেন তা ধরে রাখতে সক্ষম হবেন তিনি। কিন্তু তার জয়যাত্রার পুরো পথটিই এখনো বাকি। এই পথচলার সুস্থ-সুন্দর-নিরাপদ সূচনা হোক একেবারে তৃণমূল থেকেই। শুধু বঙ্গবন্ধুর নাতনী হিসেবে নয়, টিউলিপের রাজনৈতিক পরিচিতি গড়ে উঠুক বাঙ্গালী তারুণ্যের ‘আইকন’হিসেবে, আপন সততায় আর দৃঢ়তায়। লেখক : যুগ্ম সম্পাদক , ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)
একুশে সংবাদ/এআরএম/সি.আই/১৬/০৯/২০২০

বিভাগের আরো খবর

You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'ORDER BY bn_content.ContentID DESC LIMIT 8' at line 1