সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

কুমারবাড়ি চাকা ঘোরে, ঘোরে না কুমারের ভাগ্য

প্রকাশিত: ১১:২৮ এএম, মে ৩, ২০১৫
একুশেসংবাদ :  গ্রামের কুমার বাড়িতে এগারো মাস (বৈশাখ বাদে) কাঠের চাকা ঘোরে, কিন্তু ঘোরে না কুমারের ভাগ্যের চাকা। ঘুর্ণায়মান চাকার নাভিতে রাখা মাটির তালের ওপর কুমারের দক্ষ আঙুল নানা ভঙ্গিমায় নড়ে ওঠে। তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন মাটির পাত্র। এমন দৃশ্য অতীতে যুগ যুগ ধরেই দেখেছে গ্রামের মানুষ। কিন্তু আজ এমন দৃশ্য খুব একটা সহজ নয়। গ্রামে গিয়ে কুমার বাড়ি খুঁজে বের করতেও বেগ পেতে হয় এখন। বাজারে এখন মাটির বিকল্প বিভিন্ন তৈজসপত্র পাওয়া যায়। ভালো এঁটেল মাটিও এখন পাওয়া যায় না। ফলে বন্ধ হতে বসেছে প্রাচীন এই পেশা। গত ৩৫ বছরে পাবনায় প্রায় আটশ ভাটির মধ্যে প্রায় ছয়শ ভাটি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন প্রায় তিনশ মৃৎশিল্পী বংশগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বিরতিহীনভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু এ কাজ করে এদের সিংহভাগই সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে পারছেন না। পাবনা শিল্প নগরীর কর্মকর্তা জিতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, ‘মৃৎশিল্পীরা মাটি না পেয়ে তৈজসপত্র তৈরি করতে পারছেন না। অপরদিকে বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিকের তৈজসপত্র বাজার দখল করে ফেলেছে গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে। এ অবস্থায় তারা পেশা ধরে রাখতে পারছেন না। ঈশ্বরদী আরামবাড়িয়ার অনেক কুমার ভারত চলে গেছে। বর্তমানে এদের অনেকে বাঁচার তাগিদে অন্য পেশায় নিয়োজিত।’ পাবনা সদরে সিঙা, শালগাড়িয়া, মাঝিপাড়া, মির্জাপুর, গোবিন্দপুর, প্রভৃতি গ্রামে আগে কুমাররা বাস করত। তারা নদীয়া জেলা থেকে এসেছিলেন। তাদের আর দেখা পাওয়া যায় না। পাবনার কুমারেরা বৈশাখ মাসে তৈরি করেন না নরম মাটির তাল। ঘোরান না চাকা। পহেলা বৈশাখে তারা এই চাকার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ মাসে তারা শুধু চৈত্রের রোদে শুকানো কাঁচা মৃৎপাত্রগুলো পোড়ানোর কাজ করেন ভাটি জ্বালিয়ে। ব্যবস্থা নেন বিপণনের। বংশ পরম্পরায় এটা তারা মেনে আসছেন। কিন্তু পেশায় তাদের টিকে থাকতে মারাত্মক কষ্ট হচ্ছে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জরিপে পাওয়া যায়, পাবনায় মৃৎপাত্র তৈরির কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ১৩৭টি। কাজে নিয়োজিত লোক সংখ্যা ৪ হাজার ৩০৩ জন। index মৃৎশিল্পে পাবনার খ্যাতি পুরনো। ঈশ্বরদী আরামবাড়ীয়ার সোরাই (কুজা), চাটমোহরের মির্জাপুর ও পাশবর্তী ভাঙ্গুড়ার অষ্টমনিষায় কালো রঙের কোলা ও টেকসই চাড়ির বেশ সুনাম ছিল। সুজানগরের গোবিন্দপুর, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার নাটিয়াবাড়ী মৃৎশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। সাঁথিয়া উপজেলা বাজার সংলগ্ন পালপাড়ায় ও নাগডেমরার সোনা তলায় ৪০টি কারখানা রয়েছে। চাটমোহর উপজেলার মির্জাপুর গৌরিপুরের বেলগাছির পালপাড়ায় ৬০টি কারখানায় জার ও চাড়িসহ অন্যান্য পাত্র নির্মিত হয়। পাশবর্তী ভাঙ্গুড়া উপজেলার অষ্টমনিষায় রয়েছে প্রায় ৭০টি কারখানা। বেড়া উপজেলার খানপুরা পালপাড়া, নাকালিয়া মালদহপাড়া, পৌর এলাকার বনগ্রাম ও মাছখালীতে প্রায় ৫০টি কারখানা রয়েছে। এ এলাকায় গুড়ের কোলা বেশি তৈরি করা হয়।mrit_shilpo_08 জেলার কুমারেরা্ পাতকুয়ার পোড়ামাটির বেস্টনী (পাট), সঞ্চয়পাত্র (ব্যাংক), হাঁড়ি, কলস, ভাড়, দইয়ের খুটি, মালসা, ঝাঁজর, সরা, সানকি, চাড়ি, কোলা, ধূপদানি, ক্ষুদ্র সরা (মুচি), খই চালা, কলকে, ফুলের টব প্রভৃতি তৈরি করেন। যদিও আধুনিক সমাজে মৃৎপাত্র ব্যবহারের চল কমে আসছে। কমতে কমতে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, সানকি, মালসা, সরা ও খই চালার চল আর নেই বললেই চলে। কুয়োর পাট এখন সিমেন্ট ঢালাইয়ে তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া পাতকুয়ার ব্যবহারও কমে গেছে বলে এর চাহিদা আগের মতো নেই। বর্তমান বাজারে দই মিস্টির দাম বেড়ে দেড়গুণ হলেও ভাঁড় বা দইয়ের খুটির দর বাড়াতে দেননি ঘোষেরা। ঘোষেদের কাছে কুমারেরা এখানে জিম্মি হয়ে আছে। মৃৎশিল্পীদের খোঁজ নিতে সিঙ্গা মহল্লার পালপাড়ায় গিয়েছিলাম। সেখানেই কথা হলো ভোলানাথ পালের (৭২) সঙ্গে। তার তোবড়ানো গাল। টেকো মাথা। মসৃণ মুখ। মুখ দেখেই পড়ে নেওয়া যায় মনের কথা।  জীবনের প্রতি যেন আর কিছু চাওয়ার নেই তার। নিঃসন্তান মানুষ। এ বয়সে চাকরিজীবীরা অবসর যাপন করেন। কিন্তু তাকে এখনো কাজ করতে হয়। সংসার দেখার মতো কেউ নেই। সহধর্মিনীও স্বামীর কাজে হাত লাগান। তারও অবসর নেই। বাসি-পান্তা খেয়ে সাত সকালে বসে যান মাটি নিয়ে। দুপুরে চারটে মুখে দিয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে মাসে তিন হাজার টাকাও রোজগার হয় না- একথা নিজেই জানালেন তিনি। শ্রমিকদের কাছ থেকেই জানা গেল, বর্ষাকালটাই এই শিল্পের সবচেয়ে মন্দ সময়। লাগাতার বৃষ্টি হলে তৈরিকৃত মালামাল রোদে শুকানো যায় না। নিরাপদে রাখতে না পারলে ঝড় ঝাপটায়, বৃষ্টিধারায় গলে যায়। এই ধ্বংস দেখে তাদের আশা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। মৃৎপাত্রের মতোই তাদের স্বপ্ন ঠুনকো। ভেজা চোখ মুছে তারা ভেতর থেকে আবার জেগে ওঠেন। হাত লাগান কাজে। তারা ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমল পাড় করে এসেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সরকার তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। জানা গেল, সিঙে পালপাড়ায় ৯টি পরিবার রয়েছে। এক সময় মাটির কাজই তাদের একমাত্র জীবিকা ছিল। এখন তা নেই। পুরুষেরা অন্য পেশায় ঢুকে যাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকেই জানা গেল, ব্রিটিশ আমলে তাদের মাটি কিনতে হয়নি। পাকিস্তান সরকারের আমলে এক বিঘা জমির মাটি দুই আনা হলেই পাওয়া যেত। এখন ভালো এঁটেল মাটি টাকা দিয়েও সব সময় পাওয়া যায় না। বাড়ির পূর্ব পাশের ইছামতি নদীও মাটির যোগান দিত। সে নদীও দখল হয়ে গেছে। মাটি নেই। নদী এখন নর্দমা। যেনতেন রকমের মাটি কিনতে খরচ হয় চার থেকে পাঁচশ টাকা। কাজের সময় এ মাটির অর্ধেকই ফেলে দিতে হয়। এ কারণে তৈরিকৃত বাসনপত্রের খরচ বেশি পড়ে যায়। আগে ধান কাটার পর মাঠে থাকা নারা বিনামূল্যে পাওয়া যেত। বাঁশ ব্যবহার করা হতো জ্বালানী হিসেবে। এখন তা দুর্লভ। পালেরা তাই কাঠের গুঁড়া ও স-মিল থেকে কাঠের টুকরা সংগ্রহ করেন মণ হিসেবে। শীত এবং বসন্তকাল কুমারদের মৌসুম। এ সময় তারা কিছুটা টাকার মুখ দেখেন। কিছু সঞ্চয়ও হয়। চৈত্র ও বৈশাখ মাসে মেলাকে সামনে রেখে তারা নানান রকম ব্যবহারিক বাসনপত্র তৈরি করেন। অন্যান্য সময় তাদের হাত নামে মাত্র সচল রাখেন। দইয়ের খুটি বা ভাঁড়ের অর্ডার থাকে বারো মাস। পালেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পাত্র লাল না করা পর্যন্ত শান্তি পান না তারা। লাল মানে ভাটি থেকে নামানো। ১০-১৫ দিন পর পর ভাটিতে আগুন দেওয়া হয়। আগুন নেভার পর সারিবদ্ধ পাত্রের রঙ দেখে মনে তাদের আশা সঞ্চারিত হয়। যখন দেখেন ভাটিতে অনেকগুলো মাল ভেঙে গেছে তখন লোকসান আতংক ঘিরে ধরে তাদের।  
একুশেসংবাদ.ডটকম/আর কে০৩.৫.১৫

বিভাগের আরো খবর

You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'ORDER BY bn_content.ContentID DESC LIMIT 8' at line 1