সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

ভারতবাসীর চা প্রীতি ও রাজনীতি

প্রকাশিত: ০১:৩৩ পিএম, এপ্রিল ২৪, ২০১৫
ঢাকা:  ভারতে চা সর্বাধিক জনপ্রিয় পানীয়। কিন্তু এই পানীয় যতটা তার গুনে ভারতীয়দের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে তার চেয়েও বেশি প্রচার প্রচারণার কারণে হয়েছে। কারণ এই ভারতেই চা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণামূলক প্রকল্প নেয়া হয়েছে ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে। ইউরোপে যেমন বড়দিন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কোম্পানি পণ্যের প্রসারের লক্ষ্যে বাড়তি প্রচারণা চালায় এবং ছাড় দেয়, তেমনি ভারতেও একটা সময় চা জনপ্রিয় করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। ভারতবর্ষে যেভাবে চা কোম্পানিগুলো রাজনীতির ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছিল সে সম্পর্কে দৃশ্যমান তথ্যাদি আছে একমাত্র প্রিয়া পাল নামের এক ভারতীয়র কাছে। ২০০৮ সালে প্রিয়া পাল তার কাছে থাকা বিভিন্ন নথিগুলোর ডিজিটাল ভার্সন তৈরি করেন এবং পরবর্তী সময়ে তার কাছ থেকেই ঐতিহাসিকেরা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গবেষক এই তথ্যগুলো নিয়েছেন। প্রিয়ার এই সংগ্রহশালার বিশাল অংশ জুরেই আছে চা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের পোস্টার এবং চা খাচ্ছে এমন নর-নারীর ছবি। মূলত ভারত তার উপনিবেশিক সময়েই চা এবং কফির স্বাদ গ্রহন করে এবং ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত করে। ১৮৩০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সর্বপ্রথম বিশেষ করে দার্জিলিংয়ে চা উৎপাদন শুরু করে। চায়ের উপর চীনের আধিপত্য হ্রাস করার লক্ষ্যেই মূলত ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে চা উৎপাদন শুরু করে। ফিলিপ লুজেনডর্ফ নামে এক ব্রিটিশের লেখা প্রবন্ধেই আমরা এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীনকে চায়ের একচেটিয়া বাজার থেকে হঠানোর জন্য ভারতে চা উৎপাদন শুরু করলেও, আসলে পশ্চিমের চায়ের যোগান মেটানোর জন্যই ভারতবাসীকে চায়ের সঙ্গে বিভিন্ন কায়দায় পরিচয় করিয়ে দেয় ব্রিটিশরা। ইতিহাসের বিভিন্ন দলিল ঘাটলে দেখা যায়, চা জনপ্রিয় করার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশরা বিভিন্ন ধনী ভারতীয়দের বিশেষ করে চায়ের আমন্ত্রন জানাতেন। আর যেহেতু ব্রিটিশদের প্রতি ভারতবর্ষের রাজন্যবর্গের বিশেষ প্রীতি ছিল তাই খুব সহজেই চা’কে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে মেনে নিতে অসুবিধা হয়নি তাদের। যদিও বর্তমানে ভারতে ধনী থেকে শুরু করে রাস্তার মেথরও নিয়ম করে চা পান করে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই ব্রিটিশরা ভারত থেকে বিদেশে চা রপ্তানি হতে শুরু করে। এরপর অবশ্য আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ব্রিটিশদের। ভারতীয় ধনীরাই নিজেদের তাগিদে চা ব্যবসাকে অনেক দূর নিয়ে যায়। তবে ভারতের মানুষ কিন্তু এক কথায় চা’কে তাদের নিত্যদিনকার পানীয় হিসেবে মেনে নেয়নি। তারা ব্রিটিশদের দেখানো চায়ের সঙ্গে দুধ এবং চিনি মিশিয়ে খেতে শুরু করে এবং সেটা এখনও অব্যাহত আছে গোটা এশিয়াতে। ১৯০৩ সালে ভারতীয় ব্রিটিশ সরকার চা বিষয়ক একটি প্রোপাগান্ডা ইউনিট তৈরি করে। ভারতের ইতিহাসে এটাই সর্বপ্রথম চা সংক্রান্ত কমিটি যাকে ‘টি সিজ কমিটি’ বলা হয়েছিল। ভারতবাসী ঠিক কি পরিমাণ চা পান করছে তা জানার জন্যই এই কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। মজার বিষয় হলো, এই কমিটির অধীনে চা বর্হিদেশে রপ্তানি করলে কোনো শুল্ক লাগতো না ভারতীয় চা ব্যবসায়িদের। ১৯৩৭ সালের দিকে এই কমিটিই ভারতীয় চা মার্কেট নামে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। চা, ভারতীয়দের জন্য যেমন বিদেশি পণ্য ছিল তেমনি ইউরোপের জন্যও কিছুটা ছিল। এবিষয়টা শুরুর দিকের চায়ের বিজ্ঞাপনগুলো খেয়াল করলেই সহজে বোঝা যায়। একই বিজ্ঞাপন ভারতে এবং ইংল্যান্ডে প্রচার করা হতো। বিজ্ঞাপনের অংশ এবং চা’কে ভারতের সকল শ্রেণির কাছে জনপ্রিয় করার জন্য ছোটো মিনি প্যাক তৈরি করা শুরু করলো ব্রিটিশরা। প্রতি প্যাকেট চায়ের দাম মাত্র এক পয়সা হওয়ার কারণে ভারতীয় নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত চা’কে গ্রহন করতে শুরু করে। বিশেষ করে যে স্থানগুলোতে ভারতীয়রা আড্ডা দিতে পছন্দ করতো সেই স্থানগুলো যেমন রেলস্টেশন, নৌবন্দর ইত্যাদি স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চায়ের দোকান বসানো শুরু হয়। অবশ্য ভারতের মাটিতে চা জনপ্রিয় করার কাজে শেষ পেরেকটি ঠোকে খোদ মহাত্মা গান্ধী। চা বিষয়ে গান্ধী লিখেছিলেন, ‘চা মূলত চীন দেশিয় পণ্য। ওই দেশে এর বিশেষ ব্যবহার রয়েছে। চীনের নিয়মানুযায়ী কেউ ফুটন্ত পানি ছাড়া অন্য কোনো পানিকে বিশ্বাস করতে পারে না তাদের নিরাপত্তার জন্য। চায়ের ব্যবহার নিয়ে আমার মতামত হলো, তারা যে কারণে একটু দুধ যুক্ত ফুটন্ত গরম পানি পান করে ঠিক সেই কারণেই আমাদের এখানেও ফুটন্ত পানির সঙ্গে একটু দুধ এবং চিনি মেশানো হয়।’ গান্ধীর পেরেক ঠোকার পর দ্বিগুন উৎসাহে চা’এর প্রসারে এগিয়ে আসেন মূলত পারসিয়ানরা এবং বাঙালি বাবুরা। ১৯১১ সালে এক্সপ্রেস পত্রিকায় থমাস লিপটন কোম্পানির দেয়া এক বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, সেখানে চা’কে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে এদেশিয় বাদামী চামড়ার উপনিবেশিক মানুষদেরই উৎপাদিত এই চা, যা কিনা তারা সুন্দর-পরিপাটি পোশাক পরিহিতা ব্রিটিশ নারীরা এবং ভদ্রলোকদের মাঝে বিতরন করছে। আর সেই দৃশ্যের পেছনে এমন একটি বাংলো দেখানো হয়েছে যা পুরোপুরি ব্রিটিশ রীতিতে গড়া। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ভারতের স্বাধীনতার পর আন্দোলনকারীরা এই চা’কেই শতভাগ স্বদেশি পণ্য হিসেবে জনতার সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়।

বিভাগের আরো খবর

You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'ORDER BY bn_content.ContentID DESC LIMIT 8' at line 1