সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

বিজু'তে জেগে ওঠে পাহাড়ের প্রাণ

প্রকাশিত: ১২:৪৪ পিএম, এপ্রিল ১০, ২০১৫
একুশে সংবাদ : বিভিন্ন জাতি ও জাতিসত্তার সমন্বয়ে আমাদের বাংলাদেশ। প্রতিটি জাতির রয়েছে আলাদা পার্বণ এবং সেই পার্বণ উদযাপনে উৎসবের ধরনও আলাদা। আবার জাতিভেদে রয়েছে একই উৎসবের ভিন্ন নাম। যেমন- বাঙালির কাছে যা পহেলা বৈশাখ, চাকমাদের কাছে এই উৎসবটির নাম ‘বিজু’ এবং মারমাদের কাছে ‘সাংগ্রাই’। অন্য দিকে রাখাইনরা বৈশাখ উদযাপন করে জলকেলী করে। এখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বর্ণাঢ্যতায় যুক্ত হয়েছে নতুন অনেক অনুষঙ্গ। যদিও এর পেছনে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ করে ফোন অপারেটরদের অবদান চোখে পড়ে। বলতে দ্বিধা নেই, এ ধরনের আয়োজনে বৈচিত্র এসেছে কিন্তু প্রাণটা পাওয়া যায় না। কোথায় যেন একটু শূন্যতা রয়েই যায়। অভাব অনুভূত হয় চিরায়ত বাংলার বুক থেকে উঠে আসা প্রাণ জুরানো মেঠো ঘ্রাণের। পহেলা বৈশাখ এখন আর শুধুই প্রাণের পার্বণ নয় বরং ওইসব প্রতিষ্ঠানের কাছে অসাধারণ এক পণ্যও বটে! পাঠক চলুন মাটি ও মানুষের সারল্য গায়ে মেখে, নির্ভেজাল এক বর্ষবরণের গল্প শুনি। এই গল্পে পাওয়া যাবে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের চাকমাদের ‘বিজু’ উৎসবের চিত্র। ইদানিং দেশের বিভিন্ন জায়গা, এমনকি বিদেশ থেকেও অনেক দর্শনার্থী পাহাড়িদের বর্ষবরণ উৎসব উপভোগ করতে পার্বত্য এলাকায় গিয়ে হাজির হন। আমরাও একবার সেই উৎসব দেখতে গেলাম। জানার ইচ্ছা ছিল উৎসব ঘিরে তাদের সংস্কার- তারা কী খান, কী ধরনের কাপড় পরেন এসব আরকি! ঢাকা থেকে রওনা হয়ে সোজা বাসে করে রাঙামাটি শহরে গিয়ে নামলাম। জায়গাটির নাম ভেদভেদী বাসস্ট্যান্ড। অদূরেই মনোগড়ের বড়বি আদাম (বড়বিপাড়া)-এ অপেক্ষায় ছিল আমাদের বন্ধু অবলিকিতেশ্বর চাকমা তুখলু। পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমন দুটোই চাকমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তারা এ সময় বিজু উৎসবে মেতে ওঠে। ‘বিজু’ অর্থ বিশেষ সুযোগ। বিশেষ সুযোগের এই উৎসব একাধিক পর্ব বা দিনে বিভক্ত। যথা- ফুলবিজু, মূলবিজু এবং গইজ্জা পইজ্জা। চৈত্রের শেষ অর্থাৎ বছরের শেষ দিন হলো ফুলবিজু। এ দিন পরিবারের নারী ও শিশুরা জঙ্গল থেকে ফুল তুলে আনে। সেই ফুল দিয়ে ঘরদোর সাজানো হয়। তার আগে ঘরদোর এমনকি কাপড়চোপড় সমস্ত কিছু ধুয়ে মুছে পরিস্কার করা হয়। ফুল দিয়ে কেবল ঘরদোর নয়, গরু-ছাগল ও অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীদেরও সাজিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও কৃষিকাজে ব্যবহৃত কোদাল, লাঙ্গল এবং অন্যান্য আরও সব সরঞ্জামও ফুল দিয়ে রাঙিয়ে তোলা হয়। মূলত এ সমস্ত নিয়ম পালনের মধ্য দিয়ে পালিত হয় ফুলবিজু। মূলবিজু হলো বছরের পয়লা দিন। এ দিন তারা সর্বাধিক আনন্দ করে। সকাল বেলা পরিবারের ছোটরা বেতের তৈরি পাত্রে ধান, কুড়া ইত্যদি নিয়ে দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি ঘুরে হাঁস, মুরগিকে খাওয়ায়। তারপর মুরুব্বীদের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেয়। এরপর শুরু হয় নিজেদের খাওয়ার পালা। এর আগে মুরুব্বীদের ভক্তি সহকারে খাওয়ানোর পর্ব সেরে নেওয়ার সময় বিশেষ কিছু নিয়ম পালন করা হয়। বেলা যখন মাথার উপর, ঠিক সেই সময় ঝরনা থেকে তুলে আনা পানিতে মুরুব্বীদের পরম শ্রদ্ধায় গোসল করানো হয়। এরপর বাড়ি বাড়ি ঘুরে চলে খাওয়ার পর্ব। উৎসব কেন্দ্র করে একটি শব্দ আমার নজর কাড়ল। তাদের ভাষায় ‘উদিজগর্বা’। বিজু উৎসবে এই শব্দটির গুরুত্ব রয়েছে। এর অর্থ হঠাৎ অতিথি। উৎসব চলাকালে যে কোনো বাড়িতে উদিজগর্বা এলে তারা ভীষণ খুশি হয়। আমরা একের পর এক বাড়িতে উদিজগর্বা হয়ে উপস্থিত হই। প্রথমে তুখলুর বন্ধু রাজীব চাকমার বাড়িতে গেলাম। ঘরে নিয়ে বসানোর অল্পক্ষণ বাদেই পরিবেশনের জন্য একের পর এক আসতে লাগল হরেক পদের খাবার। পাঁজন, বিরিয়ানি (মটর কালাইয়ের সঙ্গে মুরগি অথবা আলু দিয়ে রান্না করা), পিঠা, জিলাপী, রসগোল্লা, আচার, তরমুজ ইত্যাদি। সমস্ত খাবার ঘরে রান্না করা। এগুলোর মধ্যে ‘পাঁজন’ হলো গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহ্যবাহী একটা পদ। পাঁজন বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি, যেমন- কচি কাঁঠাল, কাচকলা, আলু, শিমুল (স্থানীয় বিশেষ ফুল), তারা (ঘাস বা বাঁশ প্রজাতীর উদ্ভিদ), মাশরুম ইত্যদি দিয়ে তৈরি। কমপক্ষে ৫ থেকে শুরু করে ৪৫ বা আরও অধিক প্রকার সবজি দিয়ে এই খাবার তৈরি করা চাকমাদের ঐতিহ্য। এই খাবার বিজু উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। আরেকটি হলো দুই ধরনের বিশেষ পানীয়- দোচোয়ানী ও জোগোরা। এগুলো সাধারণ চালের ভাত ও বিন্নি চালের ভাত থেকে তৈরি করা হয়। চাকমাদের ধারণা মূলবিজুর দিন স্বর্গের দুয়ার খোলা থাকে। তাই তারা বেশি বেশি পূণ্যের আশায় উদিজগর্বা দেখলেই বাড়ি নিয়ে আপ্যায়ন করার জন্য নিমন্ত্রণ করে। এ দিকে আমরা অল্প অল্প করে খাচ্ছি। কারণ এসে যখন পরেছি তখন অনেক বাড়ির আতিথেয়তা গ্রহণ করতে হবে নিশ্চিত! একে একে আমরা ৪-৫ বাড়িতে উদিজগর্বা হলাম। এভাবে যুক্ত হয়ে গেলাম স্থানীয় ১৫-২০ জনের এক দলের সঙ্গে। তারা ঘুরে ঘুরে একেক বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করছিল। এদের কারও বয়স ১৫, কারও ৫০। জুম চাষী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী কোনো ভেদাভেদ নেই।এই দিনের জন্য সকলেই সমান। তাদের সঙ্গে মিশে যেতে বেশি সময় লাগেনি। জড়তা কাটাতে বয়সে সকলের বড় রঞ্জদা ও শিমুলদা বললেন, এই দিনের জন্য ছোট-বড় সকলেই সমান। অতএব, আনন্দ করো। মাঝ বয়সী একজন শুধু গেয়েই যাচ্ছেন। কখনও মাঝের এক লাইন, কখনও শেষের এক লাইন গাচ্ছেন। তিনি দেখলাম ইংরেজি গানও জানেন! গান গাইতে গাইতে যে বাড়িতেই ঢুকি সেখানেই বসে যায় জম্পেশ আসর। খেতে খেতে পরিস্থিতি বেগতিক। রণে ভঙ্গ দিতে চাইলে একজন বলল, এই তো আর এক ঘরে যেতে হবে। এভাবে এক ঘর, দুই ঘর করতে করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। পর দিন গইজ্জা পইজ্জা। অর্থাৎ কেবলই শুয়েবসে দুই দিনের বেশুমার খাওয়াদাওয়া ও আনন্দের ক্লান্তি ঝেরে ফেলার দিন। তাদের আন্তরিক আতিথেয়তা ও আপন করে নেওয়ার ঘটনা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পরের বছর বিজু উৎসবে পুনরায় আসব কথা দেওয়ার পর তাদের কাছ থেকে বিদায় মিলল। তাদের এই উৎসবে কোনো কিছুই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া মনে হলো না। কারো মধ্যে ভণিতা চোখে পড়ল না। আদীকাল থেকে পালিত হয়ে আসা ঐতিহ্য আজও তারা ধরে রেখেছে। স্বাভাবিক নিয়মে যতটুকু পরিবর্তন হওয়া দরকার ঠিক যেন ততোটুকুই হয়েছে। লোক দেখানো বিষয় তাতে নেই। নেই মাইকের চিৎকার, চেঁচামেচি। নেই কর্পোরেট কালচার! তারা যতটুকু করে তার সবটুকুই ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এবং সেই ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান রেখে। একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১০-০৪-০১৫:

বিভাগের আরো খবর

You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'ORDER BY bn_content.ContentID DESC LIMIT 8' at line 1