সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

পথহারা ছিন্নমূল শিশু

প্রকাশিত: ০১:৩১ পিএম, মার্চ ১৮, ২০১৫
একুশে সংবাদ : ‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই।’ গানের ভাষায় এমনটি বলা হয়ে থাকলেও, সব শিশুর জন্ম কিন্তু সাজানো বাগানে হয় না। রাজধানীসহ সারা দেশে এমন লাখ লাখ শিশু রয়েছে পথেই যাদের জন্ম ও বসবাস। পথে পথে বেড়ে ওঠা এমন শিশুদেরকে ‘টোকাই’, ‘পথকলি’, ‘ছিন্নমূল’ বা ‘পথশিশু’ বলা হয়ে থাকে। দেশে পথশিশুর সংখ্যার বিষয়ে সাম্প্রতিক কালে কোনো জরিপ না হলেও এ সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে তাতে সন্দেহ নেই। বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বর্তমানে দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। যার ৭৫ ভাগেরই বসবাস রাজধানীতে। পথশিশুদের নিয়ে সবচেয়ে উদ্বেগের দিক হচ্ছে তারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে পথশিশুরা। ফলে এরা বেড়ে ওঠার যথাযথ পরিবেশ ও পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত। ২০০৫ সালে ইউনিসেফ পথশিশুদের এক জরিপে বলেছে, বাংলাদেশে মোট ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৪৯ হাজার ২০০, চট্টগ্রামে ৫৫ হাজার ৮৫৬ এবং বরিশাল বিভাগে সর্বনিম্ন ৯ হাজার ৭৭১ পথশিশু রয়েছে। এ হারে বাড়তে থাকলে ২০১৪ সাল নাগাদ বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা হওয়ার কথা ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৪। আর ২০২৪ সাল নাগাদ এ সংখ্যা হবে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০ জন। সরকারের পক্ষ থেকে ২০০৫ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পথশিশুদের ওপর অ্যাপ্রোপ্রিয়েট রিসোর্স ফর ইমপ্রুভিং স্ট্রিট চিলড্রেন্স এনভায়রনমেন্ট (অ্যারাইজ) প্রকল্পের জরিপ পরিচালিত হয়। যেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের ৭৫ ভাগ পথশিশু রাজধানীতে, ৯ দশমিক ৯ ভাগ চট্টগ্রাম ও ২ দশমিক ৫ ভাগ সিলেটে বাস করে। পথশিশুদের মধ্যে শতকরা ৫৩ ভাগ ছেলে আর ৪৭ ভাগ মেয়ে। একই সময়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে ৫ লাখ ২৫ হাজার পথশিশু রয়েছে। গবেষণায় ২০১৪ সাল নাগাদ ওই সংখ্যা ৯ লাখ ৩০ হাজারে উন্নীত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। গবেষণায় এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, মোট পথশিশুর একটি বড় অংশই বসবাস করছে রাজধানীতে। যার অধিকাংশ একবেলা খাওয়া হয়, অথবা উপোস। নোংরা পরিবেশ আর অপুষ্টিতে বেড়ে ওঠা এসব শিশুর ৮৫ ভাগই রোগাক্রান্ত। এদের ৮০ ভাগেরই জন্ম ফুটপাথে। পথশিশুর মধ্যে দেশে চার লক্ষাধিক শিশু গৃহকর্মের মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। যাদের ৮৩ শতাংশই মেয়ে। আর এদের বয়সসীমা ৫ থেকে ১৮ বছর। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুরা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে দৈনিক গড়ে ১৫ ঘণ্টা কাজ করে থাকে। বেসরকারি সংস্থা অ্যাসিট্যান্স ফর স্লাম ডুয়েলার্স (এএসডি) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, অধিকাংশ গৃহকর্মী তিন বেলা খাবার পেলেও খাবারের পুষ্টিমান অত্যন্ত নিম্ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা পচা-বাসি খাবার পেয়ে থাকে এবং তা সময়মতো পায় না। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা খুবই কম। বর্তমানে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের গড় মাসিক মজুরি ৫০৯ টাকা। পথশিশুদের জীবনযাপন অত্যন্ত দুর্বিষহ। অধিকাংশ সময়ই রাস্তা, পার্ক, ট্রেন ও বাস স্টেশনে, লঞ্চঘাটে, সরকারি ভবনের নিচে ঘুমায় এবং প্রতিনিয়তই নাইট গার্ড কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। বিভিন্ন হোটেলের পচা-বাসি খাবার, এমনকি ডাস্টবিনে ফেলা দুর্গন্ধযুক্ত খাবারও খেয়ে থাকে। নোংরা স্থানে চলাফেরা ও ঘুমানোর কারণে চর্ম রোগে আক্রান্ত হয় বেশিরভাগ পথশিশু। বিশেষ করে, মেয়ে শিশুরা যৌনবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব শিশু বেঁচে থাকার তাগিদে ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবেও কাজ করে থাকে। পথশিশুদের একটি বড় অংশ শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ভাড়ায় কাউকে খুন করা, নাশকতামূলক কাজ করা, ছিনতাই, মাদক বিক্রি, চুরির মতো অপরাধের সঙ্গে অবলীলায় জড়িয়ে যাচ্ছে তারা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ‘মাদক প্রতিবেদন ২০১৩’-এর তথ্যানুযায়ী মাদক চোরাচালান, পরিবহণ ও বিক্রিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশই শিশু। যাদের বয়স ১৬ বছরের নিচে। এরা ছিন্নমূল পথশিশু। তবে শিশুদের প্রিয় মানুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের কল্যাণে ১৯৭৪ সালের ২২ জুন জাতীয় শিশু আইন (চিলড্রেন অ্যাক্ট) জারি করেছিলেন। যার মাধ্যমে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি, সব ধরনের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, খারাপ কাজে লাগানো ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে শিশুদের জন্য নিশ্চয়ই তিনি অনেক বড় কিছু করতেন। পরবর্তী সময়ে সব সরকারই পথশিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং পথশিশুদের পুনর্বাসনের নামে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে তা লোপাট করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। পথশিশুদের নিয়ে চট্টগ্রামে কাজ করছে ‘অক্ষর গাড়ি’ নামে একটি সংগঠন। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত ওই সংগঠনের অর্গানাইজার পলি রহমান বলেন, ‘আমরা ২০১৪ সাল থেকে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম-সংলগ্ন বস্তিতে ৩৫ জন পথশিশু নিয়ে কাজ করছি। খোলা আকাশের নিচে আমাদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে সপ্তাহে চার দিন তাদের শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়টি হচ্ছে অধিকাংশ শিশু ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত। ফলে এদের স্কুলে ধরে রাখতে ওই পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার এগিয়ে এলে কাজটি আরো সহজ হবে।’ রাজধানী ঢাকায় গরিব ও ছিন্নমূলদের নিয়ে কাজ করছে ‘প্রথম সূর্য’ নামে একটি সংগঠন। এর সভাপতি নাসিরুদ্দিন রুবেল বলেন, ‘২০১০ সাল থেকে পাঁচ থেকে ১০ বছরের মোট ১৫০ জন পথশিশুকে স্কুলে ভর্তি ও নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষা দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর পরীবাগে বর্তমানে একটি প্রোগ্রাম চলছে। সরকারসহ বিত্তশালীদের পথশিশু পুনর্বাসনে এগিয়ে আসা উচিত।’ পথশিশুদের জীবন উন্নয়নের বিষয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। অসহায় শিশুদের জন্য বিশেষভাতা চালু করা যায় কি না- সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা করছে সরকার। যদিও ভাতা চালু করার বিষয়টি কঠিন, তবে একেবারে অসম্ভব নয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে কাজে লাগানো যায় কি না, তাও বিবেচনা করা হবে।’ একুশে সংবাদ ডটকম/আর/১৮-০৩-০১৫:

বিভাগের আরো খবর

You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MySQL server version for the right syntax to use near 'ORDER BY bn_content.ContentID DESC LIMIT 8' at line 1